আইন নাকি দেওয়ানী আদালতের ক্ষমতা খর্ব করার কৌশল?
২১ নভেম্বর ২০২০ ১৫:১৫
ভূমি আইন, ২০২০ (প্রস্তাবিত) সংবিধানের অন্যতম মৌলিক কাঠামো ক্ষমতার পৃথকীকরণ এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ করেছে। এছাড়াও এ আইন সুপ্রতিষ্ঠিত আইন ও ন্যায়বিচারের মূলনীতি লঙ্ঘন করে। বাংলাদেশের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মোকদ্দমা ভূমি সংক্রান্ত। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ১২ কোটি মানুষ জড়িয়ে রয়েছে ভূমি সংক্রান্ত বিবাদে। ভূমি আইন, ২০২০ (প্রস্তাবিত)-এর মাধ্যমে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি সংক্রান্ত সকল ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগকে প্রদান করা হয়। অর্থাৎ দেওয়ানী আদালত তথা বিচার বিভাগের ক্ষমতাকে খর্ব করা হয়েছে।
খসড়া এ আইন অনুযায়ী কৃষি-অকৃষি জমিসহ দেশের সকল প্রকার ভূমির সুরক্ষা, অধিগ্রহণ, দখল, উচ্ছেদ, জরিপ, রেকর্ড, সংরক্ষণ, হালকরণ, হস্তান্তর ইত্যাদি সংক্রান্ত সকল ক্ষমতা দেওয়া হয় নির্বাহী বিভাগকে। ভূমি আইন, ২০২০ (প্রস্তাবিত)-এর ৬৪ ধারা অনুযায়ী প্রতিটি জেলায় জেলা প্রশাসক ও এর অধীনস্থ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে এবং তারা ভূমি সংক্রান্ত সকল জটিলতা নিরসন করবে। ওই আইনের ২৬৫ ধারা অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের জন্য কমিশনারের নিকট আবেদন করতে হবে অর্থাৎ মানুষকে আর আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে না।
খসড়া এ আইনের ৪,৫,১০,১৭ ধারা মতে এই আইন বাস্তবায়িত হওয়ার পরে দেওয়ানী আদালতের মামলা আর অগ্রসর হবে না। আর অগ্রসর হলেও দেওয়ানী আদালতের রায়, ডিক্রি বা আদেশের কোনো বৈধতা থাকবে না। এই আইনের ১৪টি স্থানে ধারা [ ৩,১৭(১),৪২,৬১,৭৯(৩), ১৭৬,১৬৬,২৩১,২৩২,২৬৩,২৬৪,২৬৫,২৭০ ও ২৭১] প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেওয়ানী আদালতের এখতিয়ার অস্বীকার বা খর্ব করা হয়েছে। অথচ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মূল ভিত্তি।
খসড়া এ আইনটিতে ভূমির মালিকানাসহ সব ধরনের বিবাদ নিষ্পত্তিতে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে নাগরিকেরা ভূমি অধিগ্রহণ বা হুকুম দখল সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশে বাধ্য থাকবেন। অমান্য করলে ৬ মাসের জেল। এখানে সাধারণ নাগরিকের বাকস্বাধীনতা কিছুটা খর্ব করা হলো। খসড়া এ আইনটি সংবিধানের ২৭ ও ৩১ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। খসড়া এ আইনের ১০২ ধারা অনুযায়ী একজন জেলা প্রশাসক জজ আদালত থেকে শুরু করে জেলা আদালত পর্যায়ে নথি তলব করতে পারবে যা সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানের ৪২ অনুচ্ছেদের রয়েছে সম্পত্তির অধিকার এবং এর সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে ৪৪ ও ১০২ অনুচ্ছেদে। অথচ এই আইন এই অনুচ্ছেদগুলোকে অগ্রাহ্য করে। সংবিধানের ১৪৪ ধারা অনুযায়ী নির্বাহী কর্তৃপক্ষের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধের বিচার করার কোনো সুযোগ নেই। সংবিধানের অন্যতম মৌলিক কাঠামো ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতি অনুসারে বিচার করার দায়িত্ব ও ক্ষমতা বিচার বিভাগের উপরই ন্যস্ত।
ভূমি আইন, ২০২০ (প্রস্তাবিত)-এর ৩ ধারায় সকল আইনের উপর এই আইনের প্রাধান্যের কথা বলা হয়েছে এবং ২৬৩ ধারায় বলা হয়েছে অন্য কোনো আইনে যাই থাকুক না কেন কেবল ভূমি সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকার বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে এই আইনের বিধানাবলী কার্যকর হবে। অর্থাৎ ভূমি সংক্রান্ত সকল পুরাতন আইন রদ করা হলো। অথচ ভূমি বিবাদ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট প্রতিকার কেবল সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন, ১৮৭৭ দ্বারাই সম্ভব।
দেওয়ানি কার্যবিধি আইনের ৫ (২) ধারা অনুযায়ী রাজস্ব সংক্রান্ত নিয়মাবলী ছাড়া দেওয়ানী প্রকৃতির অন্য কোনো বিষয় রাজস্ব বিভাগীয় কর্মকর্তা নিষ্পত্তি করতে পারবে না। তাছাড়াও এ আইন দেওয়ানী কার্যবিধির ৯ ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
প্রস্তাবিত ভূমি আইন, ২০২০-এর প্রধান লক্ষ্য যদি ভূমি আইনের আধুনিকায়ন, ভূমি মোকদ্দমার দ্রুত নিষ্পত্তি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমানো, সময় ও অর্থ সাশ্রয়, মামলার জট কমানো ও রাজস্ব বৃদ্ধিই হয় তাহলে তা কেন বিচার বিভাগের মাধ্যমেই করানো হচ্ছে না। একজন ডাক্তার যেমন বাড়ির নকশা করতে পারেন না ঠিক তেমনি একজন আইন না পড়ুয়া জেলা প্রশাসক সমাজে আইনের শাসন বাস্তবায়ন করতে পারেন না। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
ভূমি আইন ২০২০ (প্রস্তাবিত) বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি সংক্রান্ত সকল ক্ষমতা ওই সকল আমলাদের দেওয়া হবে যারা ইতিমধ্যে অনিয়ম ও দুর্নীতির দায়ে তাদের স্বচ্ছতা হারিয়েছে। আর তাদের সঙ্গে স্বার্থন্বেষী মহলের চাপ আর সখ্যতার কথা নাই বা বললাম। বাংলাদেশের ইতিহাসে বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগের চেয়ে অনেক বেশিই স্বচ্ছতার দাবীদার। বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান দেশের সার্বিক উন্নতির জন্য ভূমি কতটা প্রয়োজনীয় তা আমরা সকলেই জানি। সরকার এই গুরুত্ব উপলব্ধি করে দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূমি ব্যবস্থাপনা বিভাগ খুলতে বলেছে এবং ইতিমধ্যে দেশের ৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে খোলাও হয়েছে। খসড়া এ আইনটি যদি পাশ হয় তাহলে ভূমি ব্যবস্থাপনা বিভাগ খোলার হয়তো কোনো দরকার ছিল না।
বাংলাদেশের দেওয়ানী মোকদ্দমায় রয়েছে সুবিশাল জট। কিন্তু আমরা এই সমস্যার মূল কারণগুলো খুঁজে বের করে সমাধান না করে দেওয়ানী আদালতের ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছি। অন্য দেশের সাথে তুলনা করলে দেখা যায় বাংলাদেশে রয়েছে বিচারকের অনেক ঘাটতি এবং তারা যথেষ্ট পরিশ্রমী। বিচারক নিয়োগ তাই সময়ের দাবি।
দেশের দেওয়ানী ও ফৌজদারি উভয় প্রকৃতির ৬০-৭০ শতাংশ ভূমি বিরোধের মুল কারণ হলো ভূমির ভুল জরিপ এবং প্রথাগত কারণে প্রশাসন বিভাগ এ জরিপে থাকে। যে জরিপ বিভাগ অসংখ্য ভুল ত্রুটিপূর্ণ ভূমি জরিপ করে চলছে তাদের উপর পরবর্তী রেকর্ড সংশোধন, বণ্টনের দায়িত্ব দেওয়া কতটা যৌক্তিক তা প্রশ্নবিদ্ধ। জনগণের ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার জন্য ভূমি আইন,২০২০ (প্রস্তাবিত) আইনটি বাতিল বা সংশোধন হওয়াটা অতীব জরুরি।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া