শুধু তাত্ত্বিক শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ছে তরুণ সমাজ
২৪ নভেম্বর ২০২০ ১৫:০৩
বর্তমানে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় তাত্ত্বিক জ্ঞান চর্চা সর্বোচ্চ আকারে হয়ে থাকে, কিন্তু তাত্ত্বিক জ্ঞানকে বাস্তবে রূপ দিতে অতীব জরুরি ব্যাবহারিক শিক্ষা। ব্যবহারিকের সঠিক চর্চা না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা তাদের ব্যবহারিক জীবনে তাত্ত্বিক শিক্ষার প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। বিশেষ করে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবহারিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। বিজ্ঞান বিভাগে বেশ কয়েকটি ব্যবহারিক পরীক্ষা রয়েছে। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, আমাদের দেশের বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যবহারিক শিক্ষার গুরুত্ব খুবই কম। এছাড়া দেশের বেশিরভাগ স্কুল-কলেজে নেই কোনো ভালো পরীক্ষাগার, রয়েছে ব্যবহারিক শিক্ষার কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতা, ল্যাব সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য দক্ষ শিক্ষকের অভাবসহ নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে চলছে না ল্যাবগুলো।
গ্রাম অঞ্চলগুলোতে এমন প্রতিবন্ধকতা ও অব্যবস্থাপনা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। ফলে শিক্ষার্থীরা গতানুগতিক ধারার শিক্ষা নিয়ে উত্তীর্ণ হচ্ছে এক শ্রেণী থেকে পরবর্তী শ্রেণীতে। এজন্য দায়ী আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। দেশের ব্যবহারিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে মোটামুটি ব্যবহারিক শিক্ষার চর্চা থাকলেও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে এর চর্চা তুলনামূলক কম। এমন পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে আমাদের দেশে মুখস্তবিদ্যা দিয়ে পরীক্ষায় ভালো নম্বর অর্জনই শিক্ষা ব্যবস্থার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুই দিনের বেশি ব্যবহারিক পাঠদান করানো হয় না। ব্যাবহারিক জ্ঞান ছাড়াই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীরা ব্যাবহারিকে খুব ভালো নম্বর আদায় করছে, একটু ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বর্তমানে এক শ্রেণির মানুষ পারিশ্রমিকের বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক খাতার কাজ করে দিচ্ছে। এছাড়া বোর্ড পরীক্ষায় যেসব কেন্দ্রে ব্যবহারিক পরীক্ষা হয়, সেখানে টাকা পয়সার মাধ্যমে নম্বর বেচাকেনা হয়। এভাবে ব্যবহারিক জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা থাকায় পরবর্তীতে শিক্ষার্থীরা স্নাতক পড়তে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে অস্বস্তির শিকার হয়। সুপ্ত অবস্থায় থেকে যাচ্ছে প্রকৃত শিক্ষা। এতে করে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা অর্ধ-শিক্ষিত থেকেই তাদের শিক্ষা জীবন অতিবাহিত করছে। যার প্রভাব গিয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে।
একটি জাতির পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে ব্যবহারিক জ্ঞানের অপ্রতুলতা। কারণ দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা পরবর্তী পর্যায়ে গিয়ে লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পড়ে সবাই চিকিৎসক, গবেষক ইত্যাদি হতে পারছে না। অনেক শিক্ষার্থীকে দেখা যায় বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে পড়ালেখা করে ব্যাংকে চাকরি করছে। এমন পরিবর্তনের মূল কারণ মূলত তাত্ত্বিক শিক্ষাকে প্রাধান্য সবচেয়ে বেশি দেওয়া এবং ব্যবহারিক শিক্ষাকে গুরুত্ব না দেওয়া। এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ডিজিটাইজেশনের সময় নেই কোনো ভালো আইসিটি ল্যাব, গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানে ল্যাব থাকলেও বেশিরভাগেই হচ্ছে না পাঠদান। এতে করে কম্পিউটার শিক্ষা ও আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। যার প্রভাব গিয়ে পড়ছে চাকরির বাজারে। তাই কর্মমুখী শিক্ষার প্রাধান্য সর্বোচ্চ করা উচিত।
এছাড়া আমাদের দেশে প্রতিবছর বিজ্ঞান বিষয়ে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে বের হয়, সেই পরিমাণ চাকরি নেই। এছাড়া একদিকে যেমন সুযোগ কম পায় শিক্ষার্থীরা, অন্যদিকে পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায়ও অনেক শিক্ষার্থী ভিন্ন খাতে অবস্থান করছে। বর্তমানে শিক্ষার্থীরা নিজের চাহিদাগুলোর ব্যাপারে বেশি সচেতন নয়। অনেক পরিবারে মা-বাবার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষার্থীকে বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করতে দেওয়া হয় যা একজন শিক্ষার্থীর জন্য সুখকর স্মৃতি বয়ে আনতে সক্ষম হয় না। এছাড়া স্কুল জীবনের শিক্ষা, কর্মজীবনের জন্য পরিপূর্ণ রূপ তৈরি করতে পারছে না। কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা, যার পেছনে মূল কারণ তাত্ত্বিক শিক্ষার বাস্তব জ্ঞান অর্জন না করা।
কিন্তু তাত্ত্বিক জ্ঞানকে হাতে-কলমে প্রয়োগ করাই হচ্ছে আসল শিক্ষা। এটি একটি জাতির উন্নতির চাবিকাঠি। ব্যবহারিক শিক্ষা ব্যতীত একটি জাতি কখনো জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছাতে পারে না। একটি জাতি সুসংগঠিত ও শক্তিশালী হওয়ার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করে ব্যবহারিক শিক্ষা। হাতে-কলমে শিক্ষার প্রভাবেই মানুষ কুসংস্কার, জড়তা,ও হীনতা থেকে মুক্ত থাকতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দিয়ে জ্ঞান অর্জন হলেও সে জ্ঞানের পূর্ণতা আসে না।
কোনো জাতিকে বিশ্বের দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে বাস্তবিক জ্ঞানের বিকল্প নেই। তাই আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় তাত্ত্বিক শিক্ষা চর্চার পাশাপাশি ব্যবহারিক শিক্ষার চর্চা সমান তালে করতে হবে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গুরুত্বের সঙ্গে ব্যবহারিক শিক্ষায় পাঠদান করাতে হবে। সারাবছর এই পাঠদান চালাতে হবে। এছাড়া প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ল্যাব তৈরি, সঠিক পরিচর্যা,ব্যবহারিক কাজে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, ল্যাব চালাতে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। এবং শিক্ষকদের জবাবদিহিতা, প্রশিক্ষণ ও সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টির বিকল্প নেই। প্রকৃত সামগ্রিক শিক্ষাই পারে দেশ, জাতি ও সমাজকে বদলে দিতে।
লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বন্দর কলেজ, বিজ্ঞান বিভাগ