যুবলীগ সদস্য ব্যারিস্টার ফাতেমাকে নিয়ে ‘কাণ্ডজ্ঞানহীন’ বিতর্ক
২৮ নভেম্বর ২০২০ ১৬:১৯
সম্প্রতি বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষিত হয়েছে। এর আগে, গত বছরের ২৩ নভেম্বর যুবলীগের সপ্তম কংগ্রেসে সংগঠনটির চেয়ারম্যান করা হয় বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির ছেলে শেখ ফজলে শামস পরশকে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক শেখ ফজলে শামস পরশ যুবলীগের নেতৃত্বে আসার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন ঘটন-অঘটনে আলোচিত সংগঠনটির নতুন শুরুর বিষয়ে আশাবাদী হয়ে ওঠেন অনেকে। গত বছর সংগঠনের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ ও সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল দায়িত্বগ্রহণের পরই যুবলীগের নতুন নেতৃত্ব সংগঠনটিকে যে ধারায় পরিচালনা করছেন তা সর্বমহলের প্রশংসা কুড়িয়েছে। মহামারি করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক খাদ্য সহায়ক কর্মসূচি গ্রহণ সহ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন যুবলীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা। এই এক বছরে যুবলীগ ফিরে পেয়েছে তার সঠিক দিশা। এরই প্রতিফলন ঘটেছে ১৪ নভেম্বর ঘোষিত ২০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে।
২০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষিত হওয়ার পর আরও বেশি প্রশংসিত হয় যুবলীগ। কেননা— ক্যাসিনোবাজ, টেন্ডারবাজ সহ যে কোনো ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িতদের জন্য যুবলীগের দরজা বন্ধ করা দেওয়া হয়। এবারের কমিটিতে এক ঝাঁক সাবেক ছাত্রনেতা ও মাঠে পোড় খাওয়া কর্মী নেতা হয়েছেন। কমিটির প্রত্যেক নেতা কেন্দ্রীয় যুবলীগের রাজনীতি করার জন্য যোগ্য এবং তাদের অতীত ইতিহাস পরিষ্কার। গত কয়েক বছরে আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনগুলোতে যে বহিরাগতদের স্রোত দেখা গিয়েছিলো, এবারের যুবলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তাতে ছেদ পড়েছে। তাই রাজনীতি নিয়ে যারা ভাবেন তারা বলছেন, যুবলীগের এবারের কমিটি একটি আদর্শ রাজনৈতিক কমিটি।
তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো— অনেক সময় যা না তা অর্থাৎ মিথ্যা অপবাদও বহন করতে হয় আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলোকে। আর দশটা কারণের পাশাপাশি দলীয় কোন্দলও এর অন্যতম একটি কারণ। “যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা”— এ ধরনের মনোভাবের লোকও আমাদের সমাজে আছে, যারা কারো গায়ে কালিমা লেপনে আনন্দ পায়। আর কারো গায়ে কালিমা লেপনের এই অপচেষ্টা শেষ পর্যন্ত গিয়ে পড়ে সংগঠনের উপর।
পুরো বিষয়টি বিস্তারিত বলি। এবারের যুবলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে নির্বাহী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার চৌধুরী মৌসুমী ফাতেমা কবিতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে এলএলবি অনার্স, মাস্টার্স ও এমফিল ডিগ্রিধারী ব্যারিস্টার চৌধুরী মৌসুমী ফাতেমা কবিতা যুবলীগের কমিটিতে স্থান পাওয়ায় মেধার মূল্যায়ন হয়েছে বলেই মনে করেছে সবাই। তিনি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে এলএলবি অনার্সও বিপিটিসি’র পর লিংকন ইন থেকে অর্জন করেছেন বার-অ্যাট-’ল। ২০০২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। এরপর ৯ নভেম্বরের ২০০৩ সালে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্য হন। সুপ্রিম কোর্টে আইন পেশায় সক্রিয় ব্যারিস্টার চৌধুরী মৌসুমী কবিতা বর্তমানে ইউজিসি, বিডব্লিউডিবি, বিটিসিএল, বিজিএফসিএল, সোনালী ব্যাংক, আরপিসিএল ও সোনালী ব্যাংকের প্যানেল আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ব্যারিস্টার চৌধুরী মৌসুমী ফাতেমা বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সক্রিয় সদস্য।
তবে দুঃখের সাথে লক্ষ্য করলাম— কে বা কারা এই মেধাবী নেত্রীকে বিএনপি ঘরনার বলে প্রমাণের হীন চেষ্টা করছে। বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাথে তার বেশ কিছু পুরনো ছবি ভাইরাল হয়েছে। ছবিগুলোতে দেখা যায়, বিএনপি নেত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে বা বসে আছেন তিনি। এনিয়ে শুরু হয়েছে কানাঘুষা। কেউ কেউ দাবি করছেন তিনি বিএনপি-জামাত মতাদর্শী। তার সম্পর্কে ভালো করে যাচাই না করেই যুবলীগের পদ দেওয়া হয়েছে।
তবে সংবাদমাধ্যমে আসা খবরে দেখতে পাই এই আইনজীবীর দাবি— তিনি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জড়িত ছিলেন, এ কারণে অনেকের সঙ্গে ছবি তুলেছেন। প্রতিপক্ষ গোষ্ঠী ছবিগুলো ছড়িয়ে দিয়ে ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা করছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংরক্ষিত আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য হতে চেয়েছিলেন। দলীয় মনোনয়ন ফরমও জমা দিয়েছিলেন।
কবিতা ফাতেমার সঙ্গে কথা বলে তার পরিবার ও রাজনৈতিক ক্যারিয়ার সম্পর্কে যা জানা গেছে তাতে কোনোভাবেই তিনি বিএনপি মতাদর্শের ছিলেন বলে প্রমাণ করে না। তিনি রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দির মেয়ে। বালিয়াকান্দি পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় হতে ১৯৯০ সালে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পাশ করেন। শিশুকাল থেকেই তিনি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন এবং জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেও একাধিকবার পুরস্কারপ্রাপ্ত হয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে চৌধুরী মৌসুমী ফাতেমা
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে শামসুননাহার হলের অনাবাসিক ছাত্রী ছিলেন। ওই সময় সরাসরি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত না থাকলেও ছাত্রলীগ সমর্থিত ছাত্রী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের আওয়ামীপন্থী শিক্ষক এবং মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মিজানুর রহমানের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন এবং তারই তত্ত্বাবধানে এমফিল ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি আওয়ামীপন্থী শিক্ষক প্রফেসর ড. মোঃ রহমতুল্লাহ এর সরাসরি ছাত্রী ছিলেন। তারা দুজনই তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক পরিচয় সম্পর্কে অবগত আছেন।
সামাজিক মাধ্যমে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে ব্যারিস্টার কবিতার এক ভাইয়ের ছবি প্রচার হচ্ছে। এখন আমাদের দেখার বিষয় ব্যারিস্টার কবিতার ওই ভাইয়ের পরিচয় কী। তিনি কি করতেন, কেন তিনি খালেদা জিয়ার সঙ্গে একই ছবির ফ্রেমে।
ব্যারিস্টার কবিতার ভাই চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির ২০০০ সালে সহকারী পুলিশ সুপার ছিলেন। ওই বছরের ৩০ এপ্রিল থেকে ২০০৩ সালের ১০ আগস্ট পর্যন্ত স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। তখন তিনি তার ভাইয়ের উৎসবে বিশেষ করে ঈদের দিন এসএসএফের পারিবারিক সদস্য হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে অতিথি হয়ে গিয়েছেন এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে ছবিও তুলেছেন। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব আর দলীয় কর্মকাণ্ড এক নয়। মঞ্জুরুল কবির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। কবিতা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়েছেন ভাইয়ের কর্মস্থলে বিশেষ অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে।
যেসব ছবি সামাজিক মাধ্যমে প্রচার হচ্ছে সেগুলো কোনোভাবেই প্রমাণ করে না ব্যারিস্টার কবিতা বিএনপি করতেন বা বিএনপি মতাদর্শী। তিনি বিএনপি করেন বা বিএনপি মতাদর্শী বলে প্রমাণ করতে হলে তার দীর্ঘ রাজনৈতিক ও কর্মস্থলে ক্যারিয়ার দেখতে হবে। চৌধুরী মৌসুমী ফাতেমা কবিতা কবে কোথায় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এটা কি কেউ বলতে পারবে? সম্প্রতি যে ছবিগুলো ভাইরাল হয়েছে এর কোনটাই কোনো রাজনৈতিক প্রোগ্রাম বা নিছক সাক্ষাত নয়। ছোটবেলা থেকেই ব্যারিস্টার কবিতা খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও খেলাধুলায় পাওয়া পুরস্কার গ্রহণের সময়কার ছবিই এগুলো। সেই সুবাদে প্রায় সব সরকারপ্রধানের সঙ্গে চৌধুরী মৌসুমী ফাতেমা কবিতার ছবি আছে। এর আগে এরশাদের সঙ্গেও ছবি আছে। রওশন এরশাদের সঙ্গেও আছে। তাতে প্রমাণ হয় না তিনি জাতীয় পার্টি করতেন।
এখন আসি চৌধুরী মৌসুমী ফাতেমা কবিতার পরিবারের সদস্যদের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ডের ব্যাপারে। মৌসুমী ফাতেমার পারিবারিক পরিচয়ে দেখা যায়, তার বাবা একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। মা গৃহিণী, তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্ধভক্ত। ছোট ভাই মাবুবুল কবির হিমেল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক। তিনি বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের স্বয়ংক্রিয় সদস্য। এক ভাই চৌধুরী মনিরুল কবির সুপ্রিম কোর্টের আওয়ামীপন্থী আইনজীবী। আরেক ভাই মাহফুজুল কবির জুয়েল শেরে বাংলা নগর থানার ২৭ নং ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক। চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির বর্তমানে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআিইজি এবং র্যাব পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি সাতক্ষীরায় দায়িত্বপালনকালে জামাত-শিবির-বিএনপি অধ্যুষিত সাতক্ষীরায় শান্তি ফিরিয়ে এনেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পুলিশের পদক নিচ্ছেন চৌধুরী মৌসুমী ফাতেমার ভাই
এমন পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড ও দুর্দান্ত মেধাবী একজন নেত্রীকে বিএনপি মতাদর্শের বলে অপপ্রচার চালানো আমি মনে করি দলীয়শৃঙ্খলা অমান্য করার শামিল। কেননা কোনো আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীর জীবনে সবচেয়ে বড় অপবাদের একটি হলো তিনি বিএনপি মতাদর্শের। হীন স্বার্থ চরিতার্থে কোনো আওয়ামী লীগ নেতা বা কর্মীর গায়ে এই কালিমা লেপন অত্যন্ত গর্হিত কাজ।
এ কথা সত্য যে, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনে গত কয়েক বছর ধরে বহিরাগতদের অশুভ আগমন ঘটছে। এ নিয়ে অনেকেই ক্ষুব্ধ। এই ক্ষোভের যৌক্তিক কারণ আছে। আমি নিজে প্রায়ই বহিরাগতদের ব্যাপারে সোচ্চার থাকি। তবে এবার যখন যুবলীগ বহিরাগত মুক্ত একটি দুর্দান্ত কমিটি উপহার দিয়েছে তখন রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যে এই ভালো কাজে কালিমা লেপনের চেষ্টা খুবই খারাপ চর্চা। কেউ যদি ভালো কাজ করেও সেই ভালো কাজের দাম না পায়, তার ভালো কাজকে মন্দ কাজের সাথে তুলনা করা হয়— তবে সে আর উৎসাহ পায় না। ব্যক্তির মতোই সংগঠন। সংগঠন হিসেবে যুবলীগ এবার যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে তাতে সাধুবাদ জানানো উচিত। হীন উদ্দেশ্যে কোনো ব্যক্তির গায়ে কালিমা লেপন করে পুরো সংগঠনের গায়ে কালির ছিটা দেওয়া অন্যায়।