Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির হালচাল


২৯ নভেম্বর ২০২০ ২২:০১

প্রাচীন ভারতের প্রসিদ্ধ দার্শনিক কৌটিল্য তার কালোত্তীর্ণ গ্রন্থ অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে যেসব আলোচনা করেছেন তন্মধ্যে পার্শ্ববর্তী রাজ্য সম্পর্কে অপর রাজ্যের নীতি কেমন থাকবে তাও আলোকপাত করে গেছেন। তিনি প্রতিবেশী দেশকে দেখেছেন “আরি” (শত্রু) হিসেবে আর আরির শত্রুদের আখ্যায়িত করেছেন “মিত্র” বলে। তার এই তত্ত্ব আধুনিক জাতিরাষ্ট্র কেন্দ্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র সমূহের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে এক অদৃশ্য প্রভাব বজায় রেখেছে। যা জন্মলগ্ন থেকেই ভারত-চীন ও ভারত-পাকিস্তান বৈরী সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে, পাকিস্তান-চীনের মধ্যকার সম্পর্ককে আসল ভিত্তি রূপে টিকিয়ে রেখেছে বলা যায়।

বিজ্ঞাপন

রাজনীতিতে চূড়ান্ত বাস্তবতা বলে কিছু না থাকা সত্ত্বেও, অন্যান্য অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, বিশ্বের ২১ শতাংশ মানুষের আবাসস্থল দক্ষিণ এশিয়াকে ভারত ছাড়া কল্পনা করা যায় না। মোটাদাগে ভারতকে কেন্দ্র করেই এখানকার আঞ্চলিক রাজনীতি আবর্তিত। সে অর্থে, এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক নীতি আসলে ভারতের পদক্ষেপ বিশ্লেষণে প্রণীত হয়। তাই আঞ্চলিক সমৃদ্ধি, স্থিতিশীলতা, সহযোগিতা আর নিরাপত্তার ক্ষেত্র উন্নয়নে ভারতের ব্যাপকতা অনস্বীকার্য।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে মনে হচ্ছে, আধুনিক ভারত তার পররাষ্ট্রনীতিতে কৌটিল্যের মতবাদকেই একক এবং চূড়ান্ত নীতি ধরে চলতে চাচ্ছে। সামনের দিনে বিশ্ব নেতৃত্বে থাকার সম্ভাবনাময়ী এবং অভিলাষী ভারতের (জাতিসংঘের ৭৫ তম অধিবেশনে নরেন্দ্র মোদি নিরাপত্তা পরিষদে সংস্কার আনার দাবি তুলে তা পুনর্ব্যক্ত করেছেন) দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে ভাবনাচিন্তা কেমন আসলে? তারা ভূরাজনৈতিক দিক থেকে ক্রমেই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠা এই অঞ্চলের রাষ্ট্রসমূহকে কোন চোখে দেখছে— বন্ধুভাবাপন্ন সার্বভৌম প্রতিবেশী নাকি অন্য কিছু?

সাম্প্রতিক সময়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর ঘটে যাওয়া ভারত-চীন নজিরবিহীন সীমান্ত সংঘাত আসলে শুধু সৈন্য পর্যায়ের উত্তেজনা নয়, নয় শুধু রাষ্ট্রনেতাদের করোনা পরিস্থিতি থেকে দৃষ্টি সরানোর উদ্যোগ, বরং এর পেছনে রয়েছে আঞ্চলিক কর্তৃত্ব নির্ধারণের এক ভূরাজনৈতিক সমীকরণ। একদিকে ভারত চায় না দক্ষিণ এশিয়ায় বহিরাগত হস্তক্ষেপ, অপরদিকে আঞ্চলিক আধিপত্য অর্জনের শর্ত পূরণের মাধ্যমে চীনের বৈশ্বিক পরাশক্তি হয়ে উঠার বাসনা। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভূরাজনীতির বর্তমান-ভবিষ্যৎ কী হবে তা ঠিক এই বৈরিতার উপর নির্ভর করছে।

শুরুর দিকে বহির্বিশ্ব থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন চীন ধীরেধীরে তার অর্থনৈতিক অগ্রগতির পাশাপাশি বৈদেশিক সম্পর্কের পুরনো নীতি পাল্টেছে, সেই ধারাবাহিকতায় তারা দৃষ্টি বাড়িয়েছে প্রতিবেশী অঞ্চল দক্ষিণ এশিয়ায়। এখানকার সামগ্রিক উন্নয়নে বড় বড় প্রকল্পগুলোতে তাদের বিনিয়োগের রয়েছে ব্যাপক ভূমিকা। যদিও এর পেছনে আসলে কাজ করছে চীনের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক স্বার্থ। আমেরিকান বিশ্বব্যবস্থার বিপরীতে চীনের হেজিমন হয়ে উঠার প্রথম ধাপ আঞ্চলিক প্রভাব, মূলত সে কারণে তারা আগামী দিনের রাজনীতির কেন্দ্র ভারত মহাসাগর অঞ্চলে প্রাধান্য বিস্তার করতে চায়। পাশাপাশি ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলোর সাথে সমুদ্রপথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে তারা মালাক্কা প্রণালীর বিকল্প তৈরি করতে চায়, তাদের বেল্ট এন্ড রোড প্রকল্প আসলে সেটা মাথায় রেখেই করা। এই লক্ষ্যে ইতিমধ্যে তারা পাকিস্তানের গদর বন্দর, শ্রীলংকার হাম্বানটোটা আর মায়ানমারের রাখাইনে বিকল্প রুটের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে করে তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার ধরে রাখা, সম্প্রসারণসহ জ্বালানি পরিবহনে সময় ও খরচ দুটোই কমে আসবে, সাথে এর কৌশলগত সামরিক তাৎপর্য তো আছেই।

দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের আজকের অবস্থানের পেছনে রয়েছে ভারতের পরোক্ষ ভূমিকা। প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে তারা গুজরাল ডক্ট্রিনের দোহাই দিলেও তাদের ঝোঁক বরং অন্যদিকে। সবদিক থেকে এগিয়ে থাকা ভারতের মনোভাবে প্রতিবেশীদের মধ্যে যে সন্দেহের উদ্বেগ তৈরি হয়, ভারত তার সমাধানের পথে খুব কমই হেঁটেছে, ঠিক একই কারণে সার্কের মত সংগঠন এখন মৃতপ্রায়। ফলে দীর্ঘদিনে তৈরি হওয়া ক্ষমতা কাঠামোর অসমতা পূরণে ভারতের প্রতিবেশীরা ঋণের ফাঁদে পড়ার সম্ভাবনা আছে জেনেও চীনের ইকোনমিক ডিপ্লোম্যাসিকে স্বাগত জানিয়েছে। ভারতের সাথে ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক বন্ধনে আবদ্ধ থাকার পরও এখানকার ছোট রাষ্ট্রগুলো ধীরে ধীরে চীনের দিকে ঝুঁকছে ভারতের পদক্ষেপের কারণে। কালাপানি-লিপুলেখ নিয়ে নেপালের এখন যে অবস্থান, তা আসলে হঠাৎ তৈরি হয়নি, ২০১৫ সালে ভূমিকম্প আঘাত হানার কয়েক মাস পরে নেপালের সংবিধান রচনা নিয়ে বিবাদের ফলে ভারতের অঘোষিত অবরোধ সেখানে ভারত বিরোধিতার সূচনা করে। অন্যদিকে চীন শুধু নেপাল নয়, অন্য সব প্রতিবেশীদের অসন্তোষকেও দেখছে তাদের আঞ্চলিক আধিপত্যের হাতিয়ার হিসেবে।

দক্ষিণ এশিয়ায় এই সম্ভাব্য ভূরাজনৈতিক সংঘাত আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বৃহৎ শক্তিদের এই টানাহেঁচড়া কতদূর পর্যন্ত গড়াবে আর তাতে অপেক্ষাকৃত ছোট প্রতিবেশীদের অবস্থান কেমন থাকবে? নাকি তাদেরও গ্রিসের পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধের মেলোসের মতো নিরপেক্ষ থাকার অধিকার হরণ করা হবে? এই প্রশ্ন আসছে কারণ একটি সম্ভাব্য সর্বাত্মক সংঘাতের ভার বহন করা দক্ষিণ এশিয়ার তুলনামূলক ছোট দেশগুলোর পক্ষে সম্ভবপর নয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর