বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ ডিজিটাল বাংলাদেশ
১৩ ডিসেম্বর ২০২০ ১৯:৪০
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে পৌঁছাতে এক ধাপ এগিয়ে রাখছে বাংলাদেশ সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের অঙ্গিকার। আর বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপই হলো ডিজিটাল বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে একটি উন্নত, বিজ্ঞানমনস্ক সমৃদ্ধি বাংলাদেশকে বোঝায়। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ হচ্ছে সেই সুখী, সমৃদ্ধ, শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বৈষম্য, দুর্নীতি, দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ, যা প্রকৃতপক্ষেই সম্পূর্ণভাবে জনগণের রাষ্ট্র এবং যার মুখ্য চালিকাশক্তি হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি।’
ডিজিটাল বাংলাদেশ একটি প্রত্যয়। একটি স্বপ্ন, যা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। বিরাট এক পরিবর্তন ও ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এখন এগিয়ে চলছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস ১২ ডিসেম্বর। দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের ঘোষণা দেওয়া হয় ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর— আইসিটি দিবস নামে— তবে পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর আইসিটি দিবসের পরিবর্তে এ দিনকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এটি বাংলাদেশের জনগণের উন্নত জীবনের প্রত্যাশা, স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা। এটি বাংলাদেশের সব মানুষের ন্যূনতম মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর পন্থা। এটি বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত বা দরিদ্র দেশ থেকে সমৃদ্ধ ও ধনী দেশে রূপান্তরের জন্য মাথাপিছু আয় বা জাতীয় আয় বাড়ানোর অধিকার। এটি হচ্ছে একুশ শতকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। প্রতিবছর ১২ ডিসেম্বর জাতীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদফতর দিবসটি পালন করে। যদিও এ বছর মহামারি করোনার কারণে দিবসটি পালন ততোটা আনন্দ মুখর হয়নি।
ডিজিটাল বাংলাদেশের বীজ রোপণ করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি দেশটিকে আইটিইউর সদস্যপদ গ্রহণ করান ১৯৭৩ সালে। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন তিনি বেতবুনিয়ায় উপগ্রহ ভূকেন্দ্র উদ্বোধন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রোপিত বীজ থেকে জন্ম নেওয়া চারাগাছটির বিকাশ দেখি ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা যখন প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন। তিনি স্পষ্টতই বলেছেন যে, ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণাটি পেয়েছেন তিনি তার পুত্র এবং তার তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের কাছ থেকে। বস্তুত ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে এবং ২০০৯ থেকে ১৯ সাল অবধি দেশটির ডিজিটাল রূপান্তরের স্থপতি হিসেবে সজীব ওয়াজেদ জয় অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্থপতি, নেতা এর সবটাই সজীব ওয়াজেদ জয়।
ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রথম জাতীয় অঙ্গীকার হচ্ছে ডিজিটাল টুলস ব্যবহার করে দেশ থেকে দারিদ্র্য ও বৈষম্য দূর করা এবং জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণ করা। এ জন্য জাতীয় পর্যায়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নের অগ্রাধিকার থাকতে হবে। সারা দেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা। প্রতিটি ঘরকে তার বা বেতার-পদ্ধতিতে ডিজিটাল নেটওয়ার্ক-ব্যবস্থায় যুক্ত করতে হবে। দেশের সব অঞ্চলের জনগণকে ডিজিটাল যন্ত্রে সজ্জিত করাসহ ডিজিটাল ডিভাইস প্রণয়ন করা— জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে গণ্য হবে। এ ছাড়া আরও যেসব বিষয় অগ্রাধিকার হিসেবে গণ্য হবে তা হলো— জনগণের নিজস্ব সংযুক্তি, জনগণের সঙ্গে সরকারের সংযুক্তি, সরকারের ডিজিটাল রূপান্তর, শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তর, উপযুক্ত মানবসম্পদ তৈরি, কৃষি, শিল্প ও ব্যবসার রূপান্তর।
বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরে অনেকেই তাদের ভূমিকা পালন করেছেন। এই দেশে মরহুম মো. হানিফউদ্দিন মিয়ার হাত ধরে পরমাণু শক্তি কমিশনে উপমহাদেশের প্রথম কম্পিউটার আসে ১৯৬৪ সালে। তার সহযোগী ছিলেন মোহাম্মদ মুসা মিয়া। এরপর আদমজী জুট মিল, হাবিব ব্যাংক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে গণনার কাজে কম্পিউটার ব্যবহার করা ছাড়া সাধারণ মানুষের সঙ্গে এই প্রযুক্তির কোনো সম্পর্ক ছিল না। সেসব কম্পিউটার প্রধানত প্রোগ্রামাররাই ব্যবহার করতেন। বাস্তবতা হলো ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত কোনো সরকার বিশ্বের নবীনতম এই প্রযুক্তির প্রতি সামান্যতম নজরও দেয়নি। বরং দুঃখজনক বিষয় হলো, ১৯৯১-৯৪ সময়কালে বাংলাদেশকে বিনামূল্যে সিমিউই নামক বিশ্বের বৃহত্তম সাবমেরিন ক্যাবল লাইনে সংযুক্ত করার একটি সুযোগ এসেছিল, তৎকালীন সরকার তা হাতছাড়া করে। পরে সেটি ২০০০ সালে চালু হয়।
১৯৭৫ সালের ১৪ জুন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১১টি দেশের সঙ্গে টেলিফোন, ফ্যাক্স, ডাটা কমিউনিকেশন, টেলেক্স ইত্যাদি আদান-প্রদান আধুনিক তথ্য সম্প্রসারণে দিগন্ত ভূ-উপগ্রহ উন্মোচন করেন। তখন থেকেই বাঙালি জাতি স্বপ্ন দেখা শুরু করে। এরপর থেকেই বেসরকারি খাতে তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। ১৯৭৬ সালে অ্যাপল পিসি ও ১৯৮১ সালে আইবিএম পিসি এবং ১৯৮৪ সালে মেকিন্টোস পিসি সারা দুনিয়ার সাধারণ মানুষের জন্য কম্পিউটারের ব্যবহারকে জটিলতা থেকে সহজবোধ্যতায় নামিয়ে আনে। বস্তুত মেকিন্টোস কম্পিউটারের হাত ধরে ডেকসটপ প্রকাশনা বিপ্লব নামে একটি অসাধারণ ঘটনা ঘটে বিশ্বজুড়ে। বিশ্বব্যাপী কম্পিউটারের ব্যবহার বাড়তে থাকে। তবে সেই ঢেউ তখন বাংলাদেশে লাগেনি। মেকিন্টোস কম্পিউটার বাংলাদেশে আসে ১৯৮৬ সালে। তবে বস্তুত ১৯৮৭ সালে প্রথম কম্পিউটার দিয়ে বাংলা পত্রিকা আনন্দপত্র-এর প্রকাশ এবং মুদ্রণ ও প্রকাশনায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে কম্পিউটার বিপ্লবের বড় মাইলফলকটির সূচনা হয়। ১৬ মে ১৯৮৭ সালে কম্পিউটার দিয়ে সাপ্তাহিক আনন্দপত্র প্রকাশের পথ ধরে বাংলাদেশে ডেকসটপ প্রকাশনা বিপ্লব ঘটে। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত বিজয় কিবোর্ড ডিটিপি বিপ্লবের নায়ক। বস্তুত ডিটিপি ও কম্পিউটারে বাংলা ভাষার ব্যবহার ডিজিটাল প্রযুক্তিকে তৃণমূলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তোলে।
সার্বিক বিবেচনায় প্রকৃত ডিজিটাল বিপ্লব দৃশ্যমান হয় শেখ হাসিনা যখন ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো দেশ শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন। তিনি তার নিজ দলের দাফতরিক কাজে কম্পিউটারের ব্যবহার শুরু করেন ১৯৯১ সালে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তিনি ডিজিটাল বার্তা সংস্থা (আনন্দপত্র বাংলা সংবাদ বা আবাস) ব্যবহার করেন। ১৯৯৮/৯৯ সালের বাজেটে শেখ হাসিনা কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করেন। ১৯৯৭ সালে মোবাইলের মনোপলি ভাঙেন, অনলাইন ইন্টারনেটকে সচল করেন ও দেশে বছরে দশ হাজার প্রোগ্রামার তৈরির নির্দেশনা প্রদান করেন। সেই সময়ে তিনি বাংলাদেশ থেকে সফটওয়্যার রফতানির উপায় উদ্ভাবনের জন্য টাস্কফোর্স গঠন করে ৪৫টি সুপারিশ নিয়ে তার ২৮টি বাস্তবায়ন করেন। ৯৭ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের কারণে সেই উদ্যোগ পরিত্যক্ত হয় যা ২০০৯ সালের পর আবার সক্রিয় হয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৫৭তম দেশ যাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট রয়েছে। ২০১৮ সালের ১২ মে উপগ্রহটি মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয় এবং ৯ নভেম্বর উপগ্রহটির টাইটেল বাংলাদেশকে হস্তান্তর করা হয়। বাঙালির সেই ক্ষুদ্র স্বপ্ন সেদিন আকাশ ছুঁয়েছিলো। বাঙালির স্বাধীনসত্তা বিকাশের বড় প্রতীক জয় বাংলা খচিত ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’। মহাশূন্যে সদা জাগ্রত,সদা তৎপর। সম্প্রসারণের নতুন দিগন্ত স্বপ্নের ডিজিটাল জানালা খুলে দিয়েছে মহাশূন্যে ডানা মেলা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। উন্নয়নের অভিনব যাত্রায় এগিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা সরকারের নতুন বাংলাদেশ স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের উপগ্রহ সম্প্রচার মাধ্যম এটি এখন ব্যবহার করছে। দেশের সবকটি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ১৯ মে থেকে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ ব্যবহার করছে। এ ছাড়াও এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ডিটিএইচ সেবার সূচনা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে যে রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নে ঘোষণা দেন— তার শিরোনাম ছিল ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’। ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর ডিজিটাল বিপ্লবের ঘোষণা আসে। এদিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ২০২১ সালের মধ্যেই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করে ‘ভিশন টুয়েন্টি টুয়েন্টি ওয়ান’ বা ‘রূপকল্প ২০২১’ ঘোষণা করা হয়। যেখানে অঙ্গিকার করা হয়, ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত হবে। এর পরেই বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি ডিজিটাল দেশে পরিণত হওয়ার পথে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে।
বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সময়। ডিজিটাল সময়। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সেবা পৌঁছে গেছে জনগণের দোরগোড়ায়। মাত্র ১১ বছরের মধ্যে সব কিছুই প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল হয়ে উঠেছে। ছয় কোটির বেশি বাংলাদেশি বর্তমানে ফেসবুকের ব্যবহার করে। ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসা গড়ে উঠেছে, ডিজিটাল মার্কেটিং ঘরে বসে নিজের ইচ্ছামতো খুব সহজে জিনিসপত্র কেনাবেচা করা যায়। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি পড়াশোনা হয়েছে ডিজিটাল। করোনা মহামারিতে শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে এই ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে। চিকিৎসাক্ষেত্রে এনেছে অনন্য ডিজিটাল সেবা। এখন দেশের ইউনিয়ন, পৌরসভা ও উপজেলা ও জেলায় ৫ হাজার ২৭৫টি ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে জনগণকে সেবা দেওয়া হচ্ছে। প্রতারণা ও সহিংসতার শিকার হলে জরুরি প্রয়োজনে ৯৯৯ নম্বরে কল করে পুলিশের সেবা পাচ্ছি আমরা। ঘরে বসে ব্যাংকিং সেবা ভোগ করছি। অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে ব্যাপক গুরুত্ব গ্রহণ করছে ডিজিটাল প্রযুক্তি। টেকসই উন্নয়নের নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে অবদান রাখছে ডিজিটাল প্রযুক্তি।
লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়