Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এবারের বিজয় দিবস উদযাপনের নয়, শপথ গ্রহণের


১৫ ডিসেম্বর ২০২০ ১৯:০৭

নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস…

এ বছর মহান বিজয় দিবস এসেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে, ভিন্ন পরিস্থিতিতে। একদিকে করোনাভাইরাসের কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন বাধাগ্রস্ত। করোনা সংক্রমণের ভয়ে মানুষ পারছে না কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে মিলিত হতে। পারছে না ঘরের বাইরে স্বাচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াতে। এড়িয়ে চলতে হচ্ছে মানুষের সাহচর্য। করোনা সংক্রমণ এড়াতে এবার রাজধানীর জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে সশস্ত্র বাহিনীর সম্মিলিত কুচকাওয়াজ প্রদর্শনী হচ্ছে না। জেলা-উপজেলা সদরের অনুষ্ঠানগুলোও জনসমাগম এড়িয়ে স্বল্প পরিসরে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ ছাড়া বিজয় দিবসে উন্মুক্ত স্থানে সব ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবছর যে উৎসাহ-উদ্দীপনায় উদযাপিত হয় মহান বিজয় দিবস, এবার করোনার কারণে সে সুযোগ থাকছে না। অন্যদিকে এই পরিস্থিতির মধ্যেই দেশে আবারও উগ্রপন্থীদের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের অংশ হিসেবে ধোলাইপার মোড়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্য স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এই বিজয় দিবসেই ভাস্কর্যটি উদ্বোধনের কথা ছিলো। এ অবস্থায় কয়েকদিন আগে হেফাজতে ইসলামের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী হুমকি দিয়ে বলেন, দেশে কোনো ভাস্কর্য তৈরি হলে তা টেনেহিঁচড়ে ফেলে দেওয়া হবে। খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মামুনুল হকও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করে উসকানিমূলক বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, তাদের সামর্থ্য হলে তারা এই জনপদ থেকে সব ভাস্কর্য অপসারণ করার উদ্যোগ নেবেন। ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়জুল করীম বলেন, ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপনের চক্রান্ত তৌহিদি জনতা রুখে দেবে। তাদের এসব বক্তব্যে ‘উদ্বুদ্ধ’ হয়ে কতিপয় দুষ্কৃতকারী রাতের অন্ধকারে কুষ্টিয়ায় জাতির জনকের নির্মীয়মাণ ভাস্কর্য ভাঙচুর করেছে। মুজিববর্ষ চলাকালে এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনলগ্নে এসে বাংলাদেশের মহান স্থপতি ও জাতির জনকের ভাস্কর্য ভাঙচুর হবে এ ছিলো অনেকের কল্পনারও বাইরে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে অকল্পনীয় সেই ঘটনাই ঘটেছে এদেশে।

বিজ্ঞাপন

দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে…

বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ যখন উন্নয়নের দিকে ধাবমান, কোটি মানুষের স্বপ্নের পদ্মাসেতু যখন দৃশ্যমান, দেশে বাস্তবায়িত হচ্ছে অনেকগুলো মেগা প্রকল্প যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বদলে যাবে দেশের চেহারা, বদলে যাবে দেশের অর্থনীতির চিত্র, বদলে যাবে মানুষের জীবনমান, ঠিক সেই সময়ে কারা দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে চাচ্ছে তাদের পরিচয় কারও অজানা নয়। এরা একাত্তরের পরাজিত শত্রু। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায়, উন্নয়নে এরা উৎফুল্ল না হয়ে হয়ে ওঠে ঈর্ষান্বিত, হয়ে ওঠে প্রতিশোধপরায়ণ। তাই দেশের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন অগ্রযাত্রা এরা সহ্য করতে পারে না। দেশ যখন স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে চলে তখনই এদের মধ্যে উগ্রতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এই অপশক্তি এ দেশে আগেও ছিলো, বর্তমানেও আছে। একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে স্বাভাবিকভাবেই কাম্য ছিলো এসব অপশক্তিকে চিরতরে নির্মূল করা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতাসহ বিভিন্ন কারণেই সেটা সম্ভব হয়নি। সম্ভব হয়নি বলে বলা যায়, মনে করা হয়েছিল যে এসব অপশক্তির বোধোদয় হবে। কিন্তু সেই বোধোদয় যে হবে না, হবার নয়— সেটা তারা সুযোগ পেলেই জানান দিচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎই এদের আত্মপ্রকাশে অনেকেই মনে করছেন এই স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি শাখাপ্রশাখা মেলে হয়তো মহীরুহে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না যে তারা সত্যিই মহীরুহে পরিণত হয়েছে। দেশের বেশিরভাগ মানুষই বাঙালি সংস্কৃতির ধারক, বাহক। এটা ব্রিটিশ আমলে যেমন ছিলো, পাকিস্তান আমলেও তেমন ছিলো এবং বর্তমানকালে তেমনই আছে। স্বভাবগতভাবেই বাঙালি দেওয়ালে পিঠ না ঠেকা পর্যন্ত হয়তো রুখে দাঁড়ায় না। এই সুযোগে মাঝে মাঝেই যখন বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তখন অনেকে মনে করেন যে এদের সংখ্যা হয়তো খুব বেশি বেড়ে গেছে। আসলে এসব অপশক্তি যখন মাঠে নামে— তখন তারা চেষ্টা করে তাদের শক্তির সর্বোচ্চটা প্রদর্শন করতে। এ ছাড়া কিছু ধর্মভীরু মানুষ কিছু না বুঝেই তাদের সঙ্গে যোগ দেয়, কারণ বেশিরভাগ সময়ই তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষকে ভুল পথে পরিচালনার চেষ্টা করে। একই চেষ্টা করছে তারা ভাস্কর্যের ব্যাপারে মানুষকে ভুল বোঝানোর ক্ষেত্রেও। কিন্তু খুব কম সংখ্যক মানুষই এখন এসব বক্তব্যে ভুল পথে নামে। অত্যন্ত ধর্মভীরু একজন মুসলমানও মূর্তি ও ভাস্কর্যের পার্থক্য বোঝে। এমনকি নিজের ঘরে যারা কোনো ধরনের ভাস্কর্য বা কোনো প্রাণীর ছবি পর্যন্ত ঠাঁই দেন না তারাও জানেন যে, রাস্তার মোড়ে বা কোনো দর্শনীয় স্থানে স্থান পাওয়া সুদৃশ্য কোনো ভাস্কর্য তাদের ঈমানের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আর বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই যে বাঙালি সংস্কৃতিকেই মনেপ্রাণে ধারণ করে তার প্রমাণ যে কোনো ধরনের বাঙালি উৎসব। তার প্রমাণ প্রতিবছর একুশের প্রভাতফেরিতে অগণিত মানুষের ঢল। তার প্রমাণ প্রতিবছর বিজয় র‍্যালিতে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। তার প্রমাণ প্রতিবছর বাংলা বর্ষবরণে ছোট-বড়, নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার উৎসবে শামিল হওয়া। জাতীয় পর্যায়ে রাজধানীর কথা বাদ দিলেও প্রায় প্রতিটি উপজেলাসহ অনেক ইউনিয়নেও যে পরিমাণ মানুষ এসব প্রভাতফেরি, বিজয় র‍্যালি কিংবা বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে অংশ নেয় তা অবশ্যই আশাজাগানিয়া। যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে এরা যখন রাস্তায় নেমে আসে তখনই বাঙালির সম্মিলিত শক্তির ধারণা পাওয়া যায়।

বিজ্ঞাপন

ভেঙে দিতে হবে বিষদাঁত…

বাঙালির যুদ্ধটা সম্ভবত একাত্তরেই শেষ হয়ে যায়নি। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বহিঃশত্রুর হাত থেকে স্বাধীনতা মিললেও পাকিস্তানিদের প্রেতাত্মারা এখনও এদেশে বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুনির্দিষ্টভাবে বড় ধরনের অপরাধী ছাড়া স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী বাকিদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। তার ধারণা ছিল, এরা হয়তো নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে নিজেদেরকে শুধরে নেবে। কিন্তু কথায় আছে, স্বভাব যায় না ম’লে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী কুচক্রী ও ষড়যন্ত্রকারীদের স্বভাব মরার আগে পাল্টাবে না, এটাই সত্য। এরা সুযোগ পেলেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। সুযোগ পেলেই ছোবল মারবে। তাই এদের বিষদাঁত ভেঙে দিতে হবে, এদেরকে উপড়ে ফেলতে হবে এদেশের মাটি থেকে। বাঙালিকে তার ভাষার জন্য, সংস্কৃতির জন্য, অর্থনৈতিক-সামাজিক মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য বারবার সংগ্রাম করতে হয়েছে। আরও একবার হয়তো নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষার জন্য সংগ্রাম করতে হবে। দুঃখজনক হচ্ছে, এই সংগ্রামটা বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে নিজেদের বিরুদ্ধে নিজেদের সংগ্রাম। বস্তুত তা নয়। চেহারা, বর্ণ, ভাষা এক হলেও আদতে এই গোষ্ঠীটি বাঙালি নয়, এরা একাত্তরে পরাজিত ভিন্ন কোনো সংস্কৃতির ধারক-বাহক। তাই এবারের বিজয় দিবসে আমাদের শপথ হোক, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় বাধাদানকারী ভিনদেশের সংস্কৃতির ধারক এই গোষ্ঠীটিকে আমরা নির্মূল করবই।

লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক

১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস মুক্তিযুদ্ধ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর