মুশি, আমরা সত্যি কষ্ট পেয়েছি
১৭ ডিসেম্বর ২০২০ ১৯:৪৭
বাংলাদেশের ক্রিকেট এখন বাংলার মানুষের কাছে বড় একটা বিষয়। এদেশের কোটি কোটি মানুষ ক্রিকেট ভালোবাসে, ভালোবাসে ক্রিকেটারদের। বিশেষ করে মাশরাফি, মুশফিক, তামিম, সাকিব এবং রিয়াদ এদের প্রতি অন্যরকম ভালোবাসা সবার। এরমধ্যে আশরাফুলও আছেন। যাকে এখনও বাংলার ক্রিকেট ভক্তরা মাঠে দেখতে চান। এসব সত্যিকারের আবেগ। আর এই আবেগটা ক্রিকেটের প্রতিই বেশি। ২২ গজের মাঠে যা-ই হয়, সেটা বাংলাদেশের মানুষের নজরে থাকে। কারণ ২২ গজকে এ জাতি মনে-প্রাণে ভালোবাসে। খেলার মাঠে বাংলাদেশ জিতলে পুরো বাংলাদেশের মানুষ জিতে যায়, আর হারলে! পুরো বাংলাদেশ-ই হেরে যায়। কেউ টিভি ভেঙ্গে ফেলে, কেউ চোখের জল ফেলে, কেউ আবার খেলোয়াড়দের গালি দেয়। তবে কি জানেন? সবকিছুই আবেগ। এ জাতি কতটা আবেগী তা খোদ ক্রিকেটাররাও জানেন।
আর সেই জাতির অংশ হিসেবে নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারেননি স্বয়ং মুশফিকুর রহিম। সতীর্থ ক্রিকেটার নাসুম আহমেদকে দুই-দুইবার মারতে উদ্যত হয়েছেন বেক্সিমকো ঢাকার অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম। এই অখেলোয়াড়সুলভ আচরণের দায় মুশফিক নিজেও এড়াতে পারেন না। ইনিংসের ১৭তম ওভারের শেষ বল। ম্যাচ জিততে ১৯ বলে ৪৫ রান প্রয়োজন ফরচুন বরিশালের। বোলার শফিকুল ইসলামের সেই ওভারের পাঁচ বলে খরচ করেছিলেন ১০ রান। শেষ বলে স্কুপ করতে গিয়ে বল হাওয়ায় ভাসিয়ে দেন বরিশালের আশা ভরসার প্রতীক আফিফ হোসেন ধ্রুব, ধরা পড়েন উইকেটরক্ষক মুশফিকুর রহীমের হাতে। আফিফ হোসেন আউট হওয়ার পর উদযাপন না করে উল্টো গ্লাভসবন্দী বল হাতে মুশফিক রীতিমত তেড়ে যান ফাইন লেগে দাঁড়ানো নাসুম আহমেদের দিকে। রাগী চোখে নাসুমের মুখে ঘুষি মারার ভঙ্গিমা করেন তিনি। বল যখন হাওয়ায় ভাসছিল, তখন পেছনের দিকে যাচ্ছিলেন মুশফিক আর নাসুমও ধীর পায়ে সামনে এগুচ্ছিলেন। তবে মুশফিক বলের কাছাকাছি চলে যাওয়ায় থেমে যান নাসুম। ক্যাচটি লুফে নেয়ার পর নাসুমের সঙ্গে মৃদু ধাক্কার মতো লাগে মুশফিকের।
তাতেই রেগে আগুন হয়ে যান ঢাকা অধিনায়ক। হাতে থাকা বলটি নাসুমের দিকে ছুড়ে মারার ভঙ্গি করেন তিনি, মনে হচ্ছিল বলসহই মুখে ঘুষি মেরে দেবেন। সঙ্গে সঙ্গে অধিনায়কের কাছে ক্ষমা চান নাসুম, পর মুহূর্তেই আবার তার পিঠ চাপড়ে দেন মুশফিক। একই ম্যাচে ইনিংসের ১৩তম ওভারের তৃতীয় বলেও ঘটে একই ঘটনা। আগের বলেই আফিফের কাছে ছক্কা হজম করেন নাসুম। পরের বলটি অনসাইডে ঠেলেই এক রান নেন আফিফ, চেষ্টা করেন দ্বিতীয় রানের জন্য, যদিও তা নিতে পারেননি। ওদিকে বলের দিকে দুই পাশ থেকে দৌড় দেন নাসুম ও মুশফিক, তবে বল আগে পেয়ে যান মুশফিক। তিনি থ্রো করতে উদ্যত হলে দেখেন নাসুম ঠিক তার সামনেই দাঁড়িয়ে। তখন থ্রো না করে আবারও রক্তিম চোখে নাসুমের দিকে বল ছুড়ে মারার ভঙ্গি করেন ঢাকার অধিনায়ক। সেবারও অধিনায়কের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন নাসুম।
কিন্তু কেন মুশফিক এমনটা করলেন? মুশফিকের কাছে এমনটা কেউ প্রত্যাশা করে? আমার মনে হয় বাংলাদেশের কেউ-ই করেন না। ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা। বাংলাদেশের ক্রিকেটে সেটা প্রমাণ করেছে মুশফিক নিজেই। কিন্তু গত ১৪ ডিসেম্বরের খেলায় বাংলার মানুষ কোন মুশফিককে দেখেছে সেটা আমি এখনও উপলব্ধি করতে পারছি না।
শুধু যে মুশফিক এমনটা করেছে তা কিন্তু নয়। এর আগে সতীর্থ খেলোয়াড়ের দিকে এমন মারতে উদ্যত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে এই টুর্নামেন্টে। লীগ পর্বে মিনিস্টার গ্রুপ রাজশাহী ও গাজী গ্রুপ চট্টগ্রামের মধ্যকার ম্যাচেও দেখা গেছে এমন দৃশ্য। চট্টগ্রামের ইনিংসের শেষ ওভারে ডিপ স্কয়ার লেগে ফিল্ডিং করা সতীর্থ আনিসুল ইসলাম ইমনের ওপর রেগে যান সাইফউদ্দিন। টিভি রিপ্লেতে স্পষ্টই দেখা গেছে যে, থাপ্পড় মারার ভঙ্গি করেছেন রাজশাহীর এ অলরাউন্ডার।
কিন্তু সাইফুদ্দিন আর মুশফিক কি এক? সে বয়সে তরুণ, এবং এখনও তার অবস্থান দলে পাকাপোক্ত নয়। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে সাইফুদ্দিনরা এসব করার সাহস কীভাবে পাচ্ছে? নিশ্চয় বড়দের দেখে শিখছে। যেখানে সিনিয়র খেলোয়াড়রা এমন করছে সেখানে জুনিয়ররা তো সেই সুযোগ কাজে লাগাবেই। মাঝখানে সাব্বির রহমান নাকি মেহেদি মিরাজকে মেরেছে! এমন ঘটনাও শোনা গিয়েছিলো সংবাদ পাড়ায়।
এতোকিছু ছাপিয়ে এটিই প্রমাণ হল এখন ক্রিকেটারদের ভেতর সৌজন্যবোধ হারিয়ে গেছে। ভদ্রলোকের খেলায় এখন অভদ্রতা আর অখোলোয়াড়সুলভ আচরণ বেশি হচ্ছে। এজন্য যে ধরনের গাইডলাইন দরকার তার কিছুই হয়তো পাচ্ছে না খেলোয়াড়রা। যার কারণে এভাবে আচরণগত সমস্যা হচ্ছে খেলোয়াড়দের।
আমি সবার কথা আবারও বাদ দিলাম। আন্তর্জাতিক, ঘরোয়া এতো পরিসংখ্যানও টানবো না। মুশিকে ছোট করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। কারণ মুশিকে আমিও অনেক বেশি ভালোবাসি। কিন্তু আমি যতটুকু জানি মুশি বাংলাদেশ ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত খেলোয়াড়। যে-কিনা পিএইচডি করার জন্য বর্তমানে পড়াশোনা করছেন। যার এতো জ্ঞান, এতো মেধা তার আচরণ কীভাবে এমন হয়? এটা কি অবাক করার মতো নয়!
একজন মুশফিককে বাংলার মানুষ কতটা ভালোবাসে সেটা মুশফিক বোঝেন কি-না জানি না। তবে যারা এসব নিয়ে গবেষণা করে তারা জানে। আমি নিজেও এ বিষয়ে সামান্য নাড়াচাড়া করে আবিষ্কার করলাম বাংলাদেশে মুশফিকের অবস্থান কেমন। নড়বড়ে? নড়বড়ে তো হওয়ার কথা নয় তবে শক্তও নয়। কিন্তু খুব শক্ত অবস্থানে আছেন এই ক্রিকেটার। তার প্রতি ভালোবাসা এদেশের মানুষের কখনও কমবে না।
২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কার গলে মুশফিকুর রহিমের ব্যাট দিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে লেখা হয়েছিল নতুন ইতিহাস। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যান করেছিলেন প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি। ইতিহাসরাঙানো সেই অমূল্য ব্যাটই নিলামে তুলে বিক্রি করেছেন মুশফিক। উদ্দেশ্য ছিলো করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলার জন্য সহায়তা তহবিলে অনুদান দেওয়া। এবং সেটা করেছেন। মুশফিকের সেই মূল্যবান ব্যাট কিনেছে শহীদ আফ্রিদি ফাউন্ডেশন। পাকিস্তানি অলরাউন্ডারের ফাউন্ডেশন মুশফিকের ব্যাট কিনেছে প্রায় ১৭ লাখ টাকায়। যে টাকা অসহায় মানুষদের জন্য ব্যয় করা হয়েছে।
এরপর ঘূর্ণিঝড় আমফানের সময়ও সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে মুশফিক ছিলেন প্রথম কাতারে। এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিধ্বস্ত হয়েছে অনেকের বাড়ি-ঘর, সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়েছেন অনেকে। এমন অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন মুশি। উপকূলীয় অঞ্চলে যাদের বাড়ি-ঘর বিধ্বস্ত হয়ে গেছে, তাদের ঘরবাড়ি পুনরায় নির্মাণ করে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। এর সঙ্গে ব্যবস্থা করেছেন সুপেয় খাবার পানিরও।
শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও মুশফিকের পরিচিতি একজন মানবিক মানুষ হিসেবে। মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য। এই কথাটি যেন মুশফিকের কাজ দেখলেই বোঝা যায়। সিরিয়ার মুসলমানদের উপর অমানবিক নির্যাতন নাড়া দিয়েছে বিশ্ব বিবেককে। এতে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ হয়েছে বাংলাদেশ দলের উইকেটরক্ষক মুশফিকুর রহিমেরও। পবিত্র রমযান মাসে সারাদিন রোজা রেখে ইফতারের অর্থ উপার্জন করা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে সিরিয়াবাসীর জন্য। যা দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেননি বাংলাদেশ জাতীয় দলের উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহিম। ধর্মপ্রাণ মুশফিকুর রহীম সব সময়ই মানবতার পাশে দাঁড়িয়েছেন। সিরিয়ার অসহায় মুসলামনদের জন্য পবিত্র রমজান মাসে ইফতারের অর্থ দান করে তাদের পাশে কয়েকবার দাঁড়িয়েছেন এই সাবেক অধিনায়ক।
ব্যক্তি মুশফিকুর রহিম কেবল একজন ভালো খেলোয়ড়াই নন, ভালো শিক্ষার্থী এবং ভাল মনের মানুষও। সেটা তিনি বেশ কয়েকবার প্রমাণও দিয়েছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় সহপাঠী, সিনিয়র, জুনিয়র ছাড়াও ডাইনিং হল, হলের বাইরের দোকানিরাও তার কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকে অসহায় হয়ে পড়েছেন ক্যাম্পাসের এসব অসচ্ছল দোকানিরা। আর সে খবর জানতে পেরেই তাদের জন্য ত্রাণ সহায়তা পাঠিয়েছিলেন মুশফিক। ক্যাম্পাসের আশেপাশের প্রায় ১৬০টি পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছেন ১৫ দিনের খাবার। এভাবে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানবিক মূল্যবোধের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এই ক্রিকেটার। যাকে লাখ লাখ তরুণ আইডল মানে।
মুশফিকের এসব মানবিকতার উদাহরণ দেখাতে গেলে শেষ হবে না আমার লেখা। কিন্তু তার সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য খুঁজে পাওয়া প্রায় দুষ্কর। কিন্তু গত ১৪ ডিসেম্বরের ঘটনা পুরো বাঙালি জাতির হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে। সকলেই ভাবছে এটা কোন মুশফিক! ইনি এমনও করতে পারেন! আসলে সত্যি বলতে যাকে যত বেশি ভালোবাসে তার কাজে ততবেশি ফোকাস থাকে মানুষের। প্রিয় মানুষের সামান্য ভুলটাও অনেক সময় বড় হয়ে দাঁড়ায়। কারণ তাকে যে বেশি ভালোবাসি! তার খারাপ কিছু কীভাবে সহ্য করবো। আর এই অবস্থান থেকেই বাংলাদেশের মানুষ মুশফিকের প্রতি রাগ করে আছে। যদিও মুশফিক তার শাস্তি হিসেবে ম্যাচ ফির ২৫ শতাংশ জরিমানা দিয়েছেন। সেইসাথে একটি ডিমোরিট পয়েন্টও পেয়েছেন। শুধু এতেই নয়, সতীর্থ নাসুমের কাছেও ক্ষমা চেয়েছেন। সেই নাসুমও ক্ষমা করেছেন। তাই তো মুশফিকের পাশে দাঁড়িয়ে নিজের ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়েছেন।
তাহলে এটা বোঝা যায় সব ঠিক আছে। সাধারণ মানুষ কিংবা ক্রিকেট ভক্তরাই এটিকে অতিরিক্তি পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি বিষয়টিকে ভিন্ন চোখে দেখছি। আমি মুশফিক বলেই এটা লিখছি। এর আগে এ ধরনের কাজ সাইফুদ্দিনও করেছে। কিন্তু তার বয়সের ওজনের সাথে সেটা মানানসই। তার ভুলের শাস্তিও সে পেতে পারে। কিন্তু মুশিকে শাস্তি দিতেও যে কষ্ট লাগবে সেটা তো মুশির বোঝা উচিৎ। আজ যদি মুশিকে ৩ মাস খেলার বাইরে রাখা হয়, সর্বপ্রথম এই পাগল ক্রিকেট ভক্তরাইতো তাঁর জন্য চারদিকে সরগরম করে তুলবে। অনলাইন-অফলাইনে ঝড় তুলবে। তাহলে মুশফিক কেন বুঝলো না এই মানুষরা তাকে কত ভালোবাসে।
মুশফিকদের কাছ থেকে এমনটা কখনও আর আশা করবো না। মুশিকে সেই আগের মতোই শান্ত এবং ভদ্র মানবিক হিসেবে দেখবো সেই আশা করছি। সেইসাথে মুশিকে এটাও বলতে চাই, ‘মুশি আমরা সত্যি কষ্ট পেয়েছি। কষ্টটা তুমি বলেই পেয়েছি। কারণ, আমরা তোমাকে ভালোবাসি।’
লেখক- আজহার মাহমুদ। শিক্ষার্থী- বিবিএ-অনার্স, হিসাব বিজ্ঞান বিভাগ (৩য় বর্ষ), জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ওমরগনি এমইএস বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, চট্টগ্রাম