মুক্তিযুদ্ধের মূল দর্শন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ
১৮ ডিসেম্বর ২০২০ ১৯:৪৫
স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস এক সংগ্রামের ইতিহাস। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের অর্জিত বিজয় গৌরবের। ডিসেম্বর আসলেই বিজয়কেতন বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মনে নবরূপে উড়তে থাকে। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার সামনে দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণে শত্রুদের মোকাবিলা করার জন্য যার কাছে যা আছে, তা-ই নিয়ে সবাইকে প্রস্তুত থাকতে বলেন। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
একাত্তর সালে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পথ বেয়ে এসেছে বাঙালির বিজয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে তার ভাষণ গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে, স্বাধিকারের পক্ষে, অসাম্প্রদায়িকতা ও স্বাধীনতার পক্ষে এক ঐতিহাসিক দলিল। ওই ভাষণ একটি জাতিকে জাগ্রত করেছে, একবিন্দুতে মিলিত করেছে। একটি ভাষণ একটি স্বাধীনতা— এমন ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। ৭মার্চের ভাষণেই রচিত হয়েছে বাঙালির মুক্তির নির্দেশনা। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির ঝাঁপিয়ে পড়া, জীবন উৎসর্গ করা সবটাই যেন সেই নির্দেশনারই বাস্তবায়ন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এক ধরনের মন্ত্রমুগ্ধতা ছিল। তিনি যেন সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট, আশা-আকাঙ্ক্ষা পড়তে পারতেন। সে কারণে তার গণমানুষপন্থী সব বক্তব্যেই সাধারণ মানুষ জেগে উঠতেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণ করেছিল পাকহানাদার বাহিনী। চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে অভ্যুদয় ঘটে বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ, নিপীড়ন আর দুঃশাসনের জাল ভেদ করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের প্রভাতী সূর্য্যের আলোয় ঝিকমিক করে উঠেছিল বাংলাদেশের শিশির ভেজা মাটি। অবসান হয়েছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সাড়ে তেইশ বছরের নির্বিচার শোষণ, বঞ্চনা আর নির্যাতনের কালো অধ্যায়। বিজয়ের অনুভূতি সবসময়ই আনন্দের। তবে একই সঙ্গে দিনটি বেদনারও, বিশেষ করে যারা স্বজন হারিয়েছেন তাদের জন্য। অগণিত মানুষের আত্মত্যাগের ফসল আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ।
কষ্টার্জিত বিজয় আমাদের অস্তিত্ব, এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনানির্ভর ক্ষুধা, দারিদ্রমুক্ত ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বাস্তবায়ন সময়ের দাবি।মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও চেতনা বাস্তবায়নে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আমাদের কাজ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেখা স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবে রূপদানে তারই সুযোগ্যকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। চলমান সময়ে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের এমন অনেক অর্জন রয়েছে যা বিশ্বকে অবাক করে দেয়। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঈর্ষণীয়। পদ্মাসেতু এবং মেট্রোরেলের মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে। কৃষিক্ষেত্রে আমাদের অগ্রযাত্রা এবং সমৃদ্ধি কৃষকদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হতে সহায়ক হচ্ছে। ২০১৯ সালের বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যমতে, কৃষিতে নিয়োজিত বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তি ৪০.৬ %। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুসারে— বাংলাদেশের ৪৬.৬১ শতাংশ খানা (পরিবার) কৃষির উপর নির্ভরশীল। পোশাক শিল্পের পাশাপাশি অন্যান্য বৃহৎ শিল্প, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে সরকারি প্রণোদনা ও সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের আধিপত্য শিল্পে এগিয়ে যাওয়ার বার্তা দেয়। অর্থনীতিতে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বে ৩৯তম দেশ এবং দ্রুত বর্ধনশীল দেশ হিসেবে পঞ্চম। বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে (পিপিপি) ২৯তম যা দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয়। বাংলাদেশ গত এক দশক ধরে গড়ে ৬.৩ শতাংশ হার ধরে রেখে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে এবং বর্তমানে বিশ্বের সপ্তম দ্রুত উন্নয়নশীল অর্থনীতি। ক্রয়ক্ষমতার সমতা অনুসারে (পিপিপি) বর্তমানে বাংলাদেশে মাথাপিছু জিডিপি ৪,৬০০ মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে বিশ্ব মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আয় ছিলো ২৫০০ কোটি মার্কিন ডলার যা ২০১৯ সালে ছিলো ১৯০০ কোটি মার্কিন ডলার । বিশ্বে রফতানি আয় অর্জনের ক্ষেত্রে বৃহৎ রফতানিকারক দেশগুলোর মধ্যে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ছিলো ৪২ তম। সাম্প্রতিক সময়ে উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ নিশ্চয়ই এক বড় প্রাপ্তি। তবে এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বশীল আচরণ প্রয়োজন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, একদলীয় শাসন কিংবা সামরিক শাসন আমাদের অগ্রযাত্রাকে বারবার ব্যাহত করেছে। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রতিষ্ঠিত সংসদীয় ব্যবস্থাকেও আমরা সংহত করতে পরিনি। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ আর্থসামাজিক সূচকে আমরা অনেক এগিয়ে গেলেও— রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছি।
আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের মূল দর্শন ছিলো অসাম্প্রদায়িক চেতনা। এই চেতনায় জাগ্রত হয়ে ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে একত্রে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ। ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা বা কোনো বিশেষ শ্রেণীর সংগ্রাম নয় মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ শোষণহীন অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সহ অন্যান্য ধর্মের অনুসারী ছাড়াও দেশের আদিবাসীদেরও অবদান রয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামে। স্বাধীন দেশপ্রাপ্তি মূলত অসাম্প্রদায়িক চেতনার যায়গা থেকে।
সাম্প্রতিক সময়ে যখন আমাদের দেখতে হয় সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছে, সম্প্রীতির বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে চাচ্ছে, তখন স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের লজ্জিত হতে হয়। বিজয়ের প্রায় অর্ধশত বছর পরও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আমাদের জন্য মোটেও সুখকর নয়।সাম্প্রতিক সময়ে চলমান ভাস্কর্য বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যে আঘাত নিশ্চয় জাতি হিসেবে আমাদের জন্য কলঙ্কের অধ্যায় রচিত হলো। সাম্প্রদায়িকতার মোড়কে একটি গোষ্ঠী নিজেদের অবস্থান প্রমাণ করতে এমন পন্থা বেছে নেওয়ায় আমাদের লজ্জিত হতে হয়। এটি মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। যদিও দেশে বিগত সময়ে সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে অস্থিতিশীল সৃষ্টির নজির রয়েছে অনেক। ২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধদের বাড়িঘর ও বৌদ্ধবিহারে হামলার ঘটনা পুরো দেশকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিল। ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ভয়াবহ জঙ্গি হামলা ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ঘটনা ঘটে। ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে রামুর কায়দাতেই হামলাটি হয়, তবে এখানে আক্রান্ত হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। প্রায় তিনশো বাড়ি ভাঙচুর করা হয়। নাসিরনগরে হামলার এক বছর পর ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর রংপুরের গঙ্গাচড়াতে ফেসবুক থেকে ছড়ানো গুজবের জের ধরে এক জনের মৃত্যু হয়। অভিযোগ হিন্দু তরুণের ফেসবুকে থেকে নবীকে অবমাননা। ২০১৯ সালের জুনে সিলেটের ওসমানীনগরে ঈদের নামাজের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলার ঘটনা ঘটে। এমন ঘটনা উদাহরণ হিসেবে অসংখ্য উল্লেখ করা যাবে।
শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক উস্কানি নয়, রয়েছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনও। ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা। এবছর মে মাসে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় বাউলশিল্পী রণেশ ঠাকুরের বাড়িতে রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুনে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের অন্যতম এই শীষ্যের প্রায় চল্লিশ বছরের সাধনার সব যন্ত্রপাতি ও গানের বইপত্র পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এবছর জুলাই মাসে হামলার ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সংগীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংগীত ভবনে। এসকল ঘটনা প্রমাণ করে— একটি বিশেষ গোষ্ঠীর দেশীয় সংস্কৃতিতে আঘাত হানা ও দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করার চক্রান্ত এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা।
আমরা বিশ্বাস করি ধর্মান্ধতার মলাটে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এ দেশের মানুষের কাছে স্থান পাবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কাছে বারংবার পরাজিত হবে সাম্প্রদায়িক শক্তি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে কোনো আপস নয়। সকল অপশক্তিকে এদেশে করা হবে পদানত। এক্ষেত্রে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে তরুণ প্রজন্মকে। বর্তমান প্রজন্মের মাঝে তুলে ধরতে হবে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের সঠিক ইতিহাস। আমরা প্রত্যাশা করি বর্তমান প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে পড়বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হবে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা। দেশ ও জাতিকে সমৃদ্ধ আগামীর পথে এগিয়ে নিতে তরুণ প্রজন্মের কাজ করার সুযোগ রয়েছে। আশার কথা হলো— মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে অনেক গবেষণাধর্মী কাজ হচ্ছে। কিন্তু এ প্রচেষ্টা ও উদ্যোগকে আরও জোরদার ও কার্যকরী করতে হবে যেন পরবর্তী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধকে অন্তরে ধারণ করতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির এক চেতনার নাম। আর বিজয়ের মাস সেই চেতনাকে ছড়িয়ে দেয় কোটি বাঙালির প্রাণে। একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম আমাদের শিখিয়েছে কিভাবে অন্যায়, অবিচার, শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে হয়। বিজয় দিবস আমাদের মনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার প্রেরণা যোগায়। তরুণ প্রজন্মের উচিত— লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়ের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে দেশ বিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র