মানব কঙ্কাল পাচার রোধে দরকার সুস্পষ্ট নীতিমালা
১৯ ডিসেম্বর ২০২০ ২০:০২
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে মানব কঙ্কালসহ এক ব্যক্তি ধরা পরার পড় সাধারণ মানুষের মধ্যে আবার নতুন করে ভয় ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। অবশ্য আমাদের দেশে অবৈধভাবে মানব কঙ্কালের ব্যবসা হয় বলে অনেক আগে থেকেই অভিযোগ করা হচ্ছিল। বলা হচ্ছিল— অবৈধ মানব কঙ্কাল ব্যবসায়ীরা বিভিন্নভাবে মানুষের কঙ্কাল অর্থাৎ হাড়-গোড় যোগাড় করে তা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে বিক্রি করে। এমনও অভিযোগ আছে— মানব কঙ্কাল ব্যবসায়ীরা মানুষের কঙ্কাল যোগাড় করে তা দেশের বাইরেও পাচার করে।
আমরা জানি আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মানুষের কঙ্কালসহ কঙ্কাল ব্যবসায়ীদেরকে গ্রেফতার করে কোর্টের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠিয়ে থাকে। তারপর ধৃত মানব কঙ্কাল ব্যবসায়ীরা জেল থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে পুনরায় কঙ্কাল ব্যবসায় লেগে যায়। বিভিন্ন সূত্র ও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের বক্তব্য থেকে জানা যায়, মূলত কঙ্কাল ব্যবসায় বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা জড়িত হয়ে পড়ে। এক সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে কেউ কেউ ধরা পড়লেও, মূল অপরাধীরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে কিংবা পর্দার অন্তরালে। আবার এমন অভিযোগও করা হয়ে থাকে যে, এই কঙ্কাল ব্যবসায় অনেক সময় ডাক্তারি পড়তে আসা শক্ষার্থীরাও জড়িয়ে পড়ে। এক পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য অনুযায়ী, অবৈধ কঙ্কাল ব্যবসায়ীরা গোপনে কবরস্থান থেকে মানব কঙ্কাল চুরি করে আনে। আবার এমন কথাও বলা হয় যে, হাসপাতালে বেওয়ারিশ হিসেবে পড়ে থাকা লাশগুলোকে কোনো না কোনো অবৈধ পন্থায় মানব কঙ্কাল ব্যবসায়ীরা সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের অসাধু ব্যক্তিদের মাধ্যমে সংগ্রহ করে থাকে। অবৈধ মানব কঙ্কাল ব্যবসায়ীরা রাসায়নিক দ্রব্যের মাধ্যমে হাড় থেকে মাংস ছাড়িয়ে হাড় আলাদা করে নেয়। তারপর সেই মানব কঙ্কাল অবৈধ ভাবে মোটা অংকের বিনিময়ে ডাক্তারি পড়তে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে বিক্রি করে থাকে।
যেহেতু মানব কঙ্কাল সংগ্রহের, অর্থাৎ— কেনাবেচার কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই, তাই ডাক্তারি পড়তে আসা ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বাধ্য হয়ে অবৈধ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তাদের পড়াশুনার স্বার্থে মানব কঙ্কাল সংগ্রহ করতে হয়। আবার অনেক সময় এমনও হয়— উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নতুন পড়তে আসা মেডিকেলের ছাত্র-ছাত্রীরা মানব কঙ্কাল সংগ্রহ করে থাকে।
ডাক্তারি পড়তে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা ও গবেষণার জন্য মানব কঙ্কালের অবশ্যই প্রয়োজন পড়ে। এছাড়া কোনো বিকল্প থাকে না। যদিও আজকাল কৃত্রিম কঙ্কালের কথা বলা হয়ে থাকে, কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিজ্ঞজনরা বলে থাকেন— চিকিৎসাশাস্ত্রে যথাযথ জ্ঞান আহরণ করতে হলে মানুষের কঙ্কালই প্রয়োজন পড়ে। কৃত্রিমভাবে তৈরি করা কঙ্কাল দ্বারা শিক্ষার বিষয়টি পরিপূর্ণ হয় না। যারা চিকিৎসা শাস্ত্রে স্নাতক করেন কিংবা ডাক্তারি পেশা শুরু করেন, তাদের কাছে মানুষের কঙ্কালই প্রয়োজন। এ বিষয়ে অ্যানাটমি বিভাগের এক শিক্ষকের ভাষ্য হচ্ছে, আসল কঙ্কালের মতো কৃত্রিম কঙ্কাল বানানো সম্ভব নয়। কৃত্রিম কঙ্কালে অনেক সময় ভুল থাকে। অ্যানাটমি বিভাগের শিক্ষকের মতে, আসল কঙ্কালে হয়তো একটা গর্ত আছে, একটা নার্ভ চলে গেছে, একটা গ্রুপ আছে। কিন্তু কৃত্রিম কঙ্কালে হয়তো এটা আসে না। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অনেক বিজ্ঞজনরা বলে থাকেন, অ্যানাটমি আর্টিফিশিয়াল বা মডেল কঙ্কাল ব্যবহার করা হয়ে থাকে নার্সিং কিংবা হোমিওপ্যাথির মতো বিষয়গুলোতে। বলা হয়ে থাকে আজকাল কৃত্রিম কঙ্কালও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এসব আমরা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকেই জেনে থাকি। সবকিছুতেই যেমন বিতর্ক আছে তেমনি করে কৃত্রিম কঙ্কাল ব্যবহার করা নিয়েও বিতর্ক আছে। ফরেনসিক বিভাগের অনেক জ্ঞানী ও বিজ্ঞজনদের মতে, পৃথিবীর অনেক জায়গায়ই আজকাল কৃত্রিম কঙ্কাল ব্যাবহার করা হয়ে থাকে। এসব কঙ্কাল ফরেনসিক বিভাগের অনেক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ভালো মানেরও হয়ে থাকে।
আমাদের দেশে অনেক কিছুর নির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় অপরাধীরা অপরাধের পথ খোঁজে বেড়ায়। দেখা যায়— অনেক সময় আইনের দুর্বলতার জন্য অপরাধীরা অপরাধ করেও পার পেয়ে যায়। সেখানে যথাযথ কর্তৃপক্ষেরও কিছু করার থাকে না। অনেকেই বলে থাকেন, আমাদের এখানে কঙ্কাল বেচাকেনার কোনো নীতিমালা নেই। অথচ আমরা যদি আমাদের সন্তানদের ডাক্তার বানাতে চাই, তাহলে তার, অর্থাৎ— আমাদের সন্তানদের মানব কঙ্কাল প্রয়োজন পড়বেই। আরও সহজভাবে পরিষ্কার করে বলতে গেলে— বলতে হবে— ডাক্তারি পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীদেরকে বৈধ কিংবা অবৈধভাবে যে কোনো ভাবেই হোক তাদের পড়াশুনার স্বার্থে মানুষের কঙ্কাল সংগ্রহ করতে হবেই। ছাত্রছাত্রীরা বৈধভাবে না অবৈধভাবে মানব কঙ্কাল সংগ্রহ করছে তা তারা, অর্থাৎ— একজন শিক্ষার্থী বুঝে উঠতে পারছে না। দেশের আইন বিশেষজ্ঞদের মতে— কবরস্থান থেকে কঙ্কাল সংগ্রহ করে বিক্রি করা চরম অনৈতিক কাজ হলেও আমাদের দেশের আইনের মাঝে এ অপরাধের সুস্পষ্ট কোনো বিচার বা শাস্তির নির্দেশনা নেই। যার ফলে— অপরাধীরা আইনশৃঙ্খলা বাহীনির হাতে ধরা পড়লেও অপরাধীদের কিছু হয় না। অপরাধীরা আইনের মারপ্যাঁচে মুক্তি পেয়ে পুনরায় মানব কঙ্কালের অবৈধ ব্যবসায় লেগে যায়। দেশের বিজ্ঞজনরা মনে করেন— কঙ্কাল কেনাবেচা, এর সংরক্ষণ, সেই সঙ্গে দেহ দান সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট নীতিমালার প্রয়োজন। যদি সরকার কঙ্কাল কেনাবেচা, এর সংরক্ষণ ও দেহ দানের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করতে পারে, তবেই সম্ভব হতে পারে অবৈধ কঙ্কাল ব্যবসা বন্ধ করা।
বলা হয়ে থাকে অনেক সময় ডাক্তারি পড়তে আসা জুনিয়র ছাত্রছাত্রীরা তাদের সিনিয়রদের কাছ থেকেও মানব কঙ্কাল সংগ্রহ করে থাকে। আগেই বলা হয়েছে— আমাদের দেশে ডাক্তারি পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা ও গবেষণার জন্য মানব কঙ্কালের প্রয়োজন হলেও, এ ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। তাই যারা মেডিকেলের ছাত্রছাত্রীদের পড়াশুনা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে থাকেন, তারা এ বিষয়ে স্বচ্ছতা নিয়ে আসতে দুইটি প্রস্তাব নিয়ে কাজ করছেন। এরমধ্যে একটি প্রস্তাব হলো— মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যলয়গুলোতে কঙ্কালের ব্যবহার এবং সরবরাহের পদ্ধতি নিয়ে নীতিমালা তৈরি বিষয়ক; আর অন্যটি হলো— মেডিকেল কলেজগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের জন্য সিমুলেশন ল্যাব তৈরি করা। তবে বিজ্ঞজনরা বলে থাকেন, এ ধরনের সিমুলেশন ল্যাব সহজ ব্যাপার নয়। তা অনেক সময়ের ব্যাপার। এতো তাড়াতাড়ি তৈরি করা যাবে না। আমাদের স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তার ভাষ্যমতে— এ ধরণের সিমুলেশন ল্যাব প্রতিষ্ঠা করতে পাঁচ বছরের মতো সময় লেগে যেতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের সিমুলেশন ল্যাব ব্যবহার হচ্ছে। আমাদের দেশে এখনোও এটা প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। বাংলাদেশের কুমিল্লার একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ছোট আকারে একটি ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো— মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের গবেষণা ও পড়াশুনার জন্য যেহেতু মানব কঙ্কালের প্রয়োজন, সেক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের উচিত হবে— কিংবা তাদের দায়িত্বও বলা যায়— ডাক্তারি পড়তে আসা ছাত্র-ছাত্রীদেরকে সহজ এবং বৈধভাবে মানব কঙ্কাল সংগ্রহ ও ব্যবহার সুনিশ্চিত করা। অপরাধীরা হয়তো বিভিন্নভাবে মানব কঙ্কাল সংগ্রহ করে তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চলিয়ে যায়। কিন্তু কোমলমতি মেডিকেল শিক্ষার্থীরা অনেক সময় আইনের মারপ্যাঁচে পড়ে ভোগান্তির শিকার হয়। এখানে একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন, যথাযথ কর্তৃপক্ষ যদি ডাক্তারি পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের বৈধভাবে মানব কঙ্কাল সংগ্রহের ব্যবস্থা করে দেন এবং তাদের আইনের ব্যাপারে সচেতন করে তুলেন, তাহলে দেখা যাবে অপরাধীরা, অর্থাৎ— মানব কঙ্কাল পাচারকারী কিংবা ব্যবসায়ীরা তাদের ভুল বুঝিয়ে অবৈধভাবে সংগ্রহ করা মানব কঙ্কাল তাদের হাতে তুলে দিতে পারবে না।
তাই বলছিলাম, ডাক্তারি পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের মানব কঙ্কাল সংগ্রহের ব্যাপারে একটি বৈধ সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা যথাযথ কর্তৃপক্ষের বিশেষ দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। দেশবাসী বিশ্বাস করে— ডাক্তারি পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে যথাযথ কর্তৃপক্ষ অবশ্যই সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন।
লেখক: আইনজীবী, কবি ও গল্পকার