বার কাউনসিল পরীক্ষা নিয়ে জটিলতা ও অজস্র স্বপ্নভঙ্গ
২১ ডিসেম্বর ২০২০ ১৬:৫০
বাংলাদেশ বার কাউনসিলের এডভোকেটশিপ তালিকাভুক্তির লিখিত পরীক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন, মানববন্ধন কর্মসূচি চলমান ছিলো। তাদের আন্দোলনে দাবি ছিলো— করোনার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন যাবত বন্ধ থাকায় বার কাউনসিলের লিখিত পরীক্ষা কবে হবে তা অনিশ্চিত হওয়ায় লিখিত পরীক্ষা ব্যতিরেকে ভাইবার ভিত্তিতে আইনজীবী তালিকাভুক্তি করা। এই আন্দোলন কতটুক যৌক্তিক ছিলো তা নিয়ে তখনই প্রশ্ন উঠেছে, কেননা এই আন্দোলনে দেশের সকল আইনের ছাত্রের একাত্মতা ছিলো না। তবুও এখন অবধি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পরও— বার কাউনসিল দ্রুত সময়ের মধ্যে এডভোকেটশিপ তালিকাভুক্তি লিখিত পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এবং তাদের আন্দোলনকে কিছুটা হলেও মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছেন।
এই আন্দোলন প্রসঙ্গে মূল কথা হচ্ছে— আন্দোলনে যারা ছিলো তাদের বেশিরভাগই সান্ধ্যকালীন দুই বছরের এলএলবি কোর্সের শিক্ষার্থী। যেহেতু আন্দোলনে সবার সম্পৃক্ততা নেই— বার কাউনসিলের সিদ্ধান্ত মেনেই— লিখিত পরীক্ষায় যারা অংশগ্রহণ করেছেন তাদের পরীক্ষা বাধাগ্রস্ত করাটা কতটুকু যুক্তিসম্মত সে প্রশ্ন থেকেই যায়। এবং প্রশ্নপত্র কঠিন বলে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক প্রশ্নপত্র ছিঁড়ে ফেলার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটেছে। এই একটি কাজ একজন আইনের ছাত্রের দ্বারা হতে পারে না— কেননা যারা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে তারা তো আইন বহির্ভূত কাজ করতে পারে না। এমন কর্মকাণ্ড আমরা যারা অনুজ— আমাদেরকে ভাবিয়ে তোলে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞ সিনিয়র আইনজীবীরা এরকম ন্যক্কারজনক ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
এবার আসা যাক সান্ধ্যকালীন দুই বছরের কোর্স ও বার কাউনসিলের কিছু সিদ্ধান্ত যা এখন ভেবে দেখার দময় এসেছে বলে মনে করছি— সেগুলো সম্পর্কে।বেসরকারিভাবে দুই বছরের এলএলবি ডিগ্রি প্রোগ্রাম বন্ধ করার পরও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নৈশ কলেজে দুই বছরের এই ডিগ্রি প্রোগ্রাম বহাল রাখা কতটুক যৌক্তিক? দেশের চলমান শিক্ষা ব্যবস্থা অনুযায়ী একটি ডিগ্রি প্রোগ্রাম ও স্নাতক প্রোগ্রামে যথেষ্ট ব্যবধান বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও— রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ— আইন ও বিচার বিভাগের মতো জায়গায়— এই দুটি প্রোগ্রামকে পেশাগত জীবনে একই মানদণ্ডে নিয়ে আসাটা দেশের চলমান শিক্ষা ব্যবস্থা ও পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে একটি সাংঘর্ষিক সিদ্ধান্ত। এরকম একটি সাংঘর্ষিক সিদ্ধান্তকে একজন আইনের ছাত্র হিসেবে আবার ভেবে দেখার দাবি জানাচ্ছি। কেননা যেখানে দেশের বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ বছরের স্নাতক প্রোগ্রামে বিশদভাবে আইন নিয়ে পড়ানো হয়ে থাকে— সেখানে দুই বছরের এই ডিগ্রি প্রোগ্রাম কখনোই স্নাতক প্রোগ্রামের সমমান হতে পারে না। এতে করে আইন-পেশারই ক্ষতি হচ্ছে, কারণ যখন কেউ অন্য বিষয়ে পড়াশোনা করে কিছুই করতে পারেনা, তখন এই দুই বছরের এলএলবি প্রোগ্রাম করে আইনজীবী হওয়ার চেষ্টা করে। যা আইন-পেশার মানদণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলে। এজন্য অনেকেই মজা করে বলে থাকেন— “যার নাই কোনো গতি সে করে ওকালতি”। এই কথাটি তাদেরকে ভাবিয়ে তুলে যারা আইন-পেশা নিয়ে স্বপ্ন দেখে। বিশ্বের উন্নত দেশে আইন-পেশার বিশেষ মর্যাদা রয়েছে— তাই আমরা আইন-পেশাকে শর্ট কোর্সের আওতাধীন করতে পারি না। এই পেশা হচ্ছে অধ্যয়ন নির্ভর, যে যতো বেশি অধ্যয়ন করবে সে ততো ভালো করবে। আইনের শাখা-প্রশাখার শেষ নেই।
বাংলাদেশ বার কাউনসিলের কাছে একজন আইনের ছাত্র হিসেবে আরেকটি দাবি রাখছি— অতীতে নিয়মিত ছয় মাস পরপর আইনজীবী তালিকাভুক্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলেও এখন বিগত কয়েক বছর যাবত দুই বছর, চার বছর লেগে যাচ্ছে একটি পরীক্ষা সম্পন্ন হতে। যা আইন-পেশায় শিক্ষার্থীদের নিরুৎসাহিত করছে। যদি বেশি আইনজীবী তালিকাভুক্তি আইন-পেশার জন্য ক্ষতির কারণ হয়, তাহলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দুই বছরের সান্ধ্যকালীন ডিগ্রী প্রোগ্রাম বন্ধ করা হোক এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ভর্তি পরীক্ষার ভিত্তিতে এবং প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীদেরকে আইন বিভাগে পড়ার সুযোগ দেওয়া হোক। এবং নিয়মিত বার কাউনসিল পরীক্ষা আয়োজন করা হোক। এতে করে আইন-পেশার মান উন্নত থাকবে এবং প্রচলিত কথা— “যার নাই কোনো গতি সে করে ওকালতি” কথাটি থেকে মুক্তি পাবে আইন-পেশা নিয়ে স্বপ্ন দেখা শিক্ষার্থীরা— যাদের প্রথম পছন্দই থাকে আইন নিয়ে পড়া। এ বিষয়ে এমন সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রের জন্যও মঙ্গল বয়ে আনবে বলে মনে করি।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, লিডিং ইউনিভার্সিটি, সিলেট