সমৃদ্ধির সুবর্ণ শিখরে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ
২২ ডিসেম্বর ২০২০ ১৬:২৮
বাংলাদেশের বিজয় দিবসের প্রেক্ষাপটে রয়েছে বিপুল ত্যাগ ও সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস। বিজয়ের মাসে আমাদের সামনে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সত্য হিসেবে উপস্থিত বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জন্মদাতা। বাঙালি জাতির পিতা। তিনি এই জাতির প্রতীক। এই পিতার নেতৃত্বে এদেশের জন্ম হয়েছে। এই পিতার নেতৃত্বে ইতিহাসের এক গৌরবময় মাইলফলক মহান ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাসের মধ্য দিয়ে বাঙালির ভাষাভিত্তিক চেতনার উন্মেষ ঘটে। পরে দীর্ঘ দুই দশক ধরে চলে পাকিস্তানি স্বৈরাচারী জঙ্গিবাহিনীর বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম।
পাক সরকার বিরোধী গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায় বঙ্গবন্ধুকে। ছাত্রাবস্থা থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। ১৯৪২ সালে এন্ট্রান্স পাস করার পর কলকাতায় মৌলানা আজাদ কলেজে (তৎকালীন ইসলামিয়া কলেজ) ভর্তি হন আইন পড়বেন বলে। এখানে তিনি যোগ দেন বেঙ্গল-মুসলিম লীগে। দেশ ভাগের পর— শেখ মুজিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। উর্দুভাষী পাকিস্তানি শাসকদের অপশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শামিল হন। বঙ্গবন্ধু নিজেই ভাষাসৈনিক ছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। অন্যান্যদের সঙ্গে ওই আন্দোলনে গ্রেফতার হন শেখ মুজিব। পরবর্তীতে সোহরাওয়ার্দী এবং মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন ও তাতে যোগ দেন শেখ মুজিব। পরে ওই দলেরই নাম হয় আওয়ামী লীগ। পাক শাসকদের অধীনে থেকে যে বাঙালির সর্বনাশ ছাড়া কিছু হবে না, তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনে বাঙালির স্বার্থে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আন্দোলন চরম আকার নেয়। ১৯৬৯ সালে এই আন্দোলন কার্যত: গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর এক জনসভায় শেখ মুজিব ঘোষণা করেন, ‘একটা সময় ছিল যখন এই মাটি আর মানচিত্র থেকে বাংলা শব্দটি মুছে ফেলার জন্য সব ধরনের প্রচেষ্টা চালানো হয়। বাংলা শব্দটির অস্তিত্ব শুধু বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমি আজ ঘোষণা করছি যে, এখন থেকে এই দেশকে পূর্ব পাকিস্তানের বদলে বাংলাদেশ ডাকা হবে’। ততদিনে শেখ মুজিবের নামের সঙ্গে যোগ হয়ে যায় বঙ্গবন্ধু সম্বোধন। শেখ মুজিব হয়ে উঠেন অবিসংবাদিত নেতা। তার জনপ্রিয়তা এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শাসককুল এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে রাজি ছিলো না। পাক জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখা হয়, যাতে শেখ মুজিব কিছুতেই ক্ষমতায় না আসীন হতে পারেন। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিরা তখন ফুঁসছে। ১৯৭০ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্সের মাঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার সেই ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
এরপর সামরিক আইন জারি করে পাক শাসক ইয়াহিয়া খান। শুরু হয়ে যায় নেতাদের ধরপাকড়। গ্রেফতার হওয়ার আগে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন— ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের যার যা আছে, তাই দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান।’ এরপর গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। কিন্তু তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জুড়ে শুরু হয়ে যায় ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ঘটনা— মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস সংগ্রামের ইতিহাস। পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বীর বাঙালি। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাকে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত বাঙালি পূর্ণ সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। স্বাধীনতার লক্ষ্যে এই লড়াই বাঙালিরা লড়েছিলেন। কিন্তু নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গসন্তান শেখ মুজিবুর রহমান। যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা দেশীয় ধর্মান্ধ রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহায়তায় পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে এদেশের আলোকিত, মেধাবী ও বরেণ্য ব্যক্তিদের। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয় মুক্ত গৌরবময় বিজয়। রক্তক্ষয়ী সেই মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশে নিয়ে আসে নতুন প্রভাত। দুঃখিনী মায়ের কোল ছেড়ে স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনতে ঘর ছাড়া হাজারো তরুণ প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধার রক্তে রঞ্জিত আমাদের লাল-সবুজের পতাকা ও স্বাধীন বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এই দিনে ঢাকায় ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঘটে ইতিহাসের অন্যতম গৌরবময় ঘটনা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মাথা নিচু করে অস্ত্র মাটিতে ফেলে আত্মসমর্পণ করে আমাদের বীর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর কাছে। এদিনে হানাদার বাহিনীর এই আত্মসর্মপণের মাধ্যমে বিশ্বমানচিত্রে জন্ম নেয় নতুন রাষ্ট্র-বাংলাদেশ। তাই বিজয় দিবস আমাদের আত্মমর্যাদার ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। ডিসেম্বর এলেই বিজয় কেতন বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মনে নবরূপে উড়তে থাকে। যে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে, তা বিশ্ব রাজনীতিতে নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। একথা সত্যি, বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না। বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু এক ও অভিন্ন। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি কল্পনাও করা যায় না।
বঙ্গবন্ধু– শুধু একটি শব্দ নয়, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার স্থপতি। সব থেকে সফল বাঙালি রাজনৈতিক নেতা হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধু নন, বরং তিনি বিশ্ব নেতায় পরিণত হয়ে অভিহিত হয়েছেন বিশ্ববন্ধু হিসেবে। একজন নেতা বিশ্ব দরবারে তার দেশের মানুষকে মর্যাদাপূর্ণ আত্মপরিচয়ের আলোকে কী অপরিসীম সাহসিকতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, তার উজ্জ্বল উদাহরণ স্বাধীনতার মহানায়ক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর খ্যাতি কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলো? কিউবার রাষ্ট্রপ্রধান ফিদেল কাস্ত্রোর এক বক্তব্যে তা স্পষ্ট। ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ দেশগুলোর সম্মেলন চলাকালীন কাস্ত্রোর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় বঙ্গবন্ধুর। পরে কাস্ত্রো সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্বের দিক দিয়ে বলুন কিংবা সাহসিকতার দিক দিয়ে। আমার কাছে এই মানুষটিই হিমালয়।’ এহেন হিমালয় সদৃশ শেখ মুজিবুর রহমান গড়েছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পরাজয় পাকিস্তান ও তার মিত্রশক্তিগুলো মেনে নিতে পারেনি। প্রতিবেশী দেশ ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী আরএসএসপন্থী আততায়ীর হাতে নিহত হন ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি। আর বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ বাসভবনে আততায়ীদের হাতে নিহত হন ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট। পঁচাত্তর-পরবর্তী অবৈধ সামরিক সরকারগুলো মুক্তিযুদ্ধের ঘাতক মৌলবাদী রাজনীতির বিষবৃক্ষের বীজ বপন করে এবং লালনপালন করে, ফুলে-ফেঁপে বড় করে তোলে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নস্যাৎ করে পাকিস্তান বানানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঘাতক মৌলবাদীরা বরাবরই হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয় ধর্মকে। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই বাংলাদেশকে ঘিরে মৌলবাদীরা একের পর এক ষড়যন্ত্র সাজায়। এরা বিভিন্ন সময় জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ এবং সাম্প্রদায়িক মৌলবাদের বিষবাষ্পে ভারী করে তুলে বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজ-কাঠামোর সুন্দর পরিবেশ। এদের মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারীরা তার রেখে যাওয়া দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনা করছে জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা কি সেই ঐতিহ্যের উপর ভর রেখেই দেশকে সাফল্যের মুখ দেখাননি? সামাজিক উন্নয়ন আর রাজনৈতিক স্থিতিতে দেশকে অনেক উচ্চতায় পৌঁছে দেননি? জ্বি, হ্যাঁ। তিনি তো বঙ্গবন্ধুরই উত্তরাধিকার। তাই সর্বজনহিতের লক্ষ্যই তার। গরিব দুঃখী মানুষের মুক্তি নিয়েই সারাক্ষণ কাজ তার।
স্বাধীনতা মানে শুধু একটি রাষ্ট্র বা একটি সরকার ব্যবস্থা নয়, বরং দেশকে পৃথিবীর বুকে সমৃদ্ধির সুবর্ণ শিখরে আরোহণ করানো। বাংলাদেশ আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। যে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু, সমৃদ্ধ ও উন্নত জীবন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, সেই প্রেরণাতেই তার সুযোগ্যকন্যা দেশরত্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে বর্তমান বাংলাদেশ।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়