পরিবহনগুলোকে সিসিটিভির আওতায় আনা প্রয়োজন
৩০ ডিসেম্বর ২০২০ ১৪:০০
ধর্ষণ থেকে রক্ষা পেতে বাস থেকে লাফ দেওয়া কিংবা চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর ফেলে দেওয়া বা হত্যা করা এমন খবর এখন প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এই খবরগুলো যখন মানুষের নজরে পরে তখন তাদের মাঝে আতঙ্ক আর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সর্বশেষ শনিবার সুনামগঞ্জের সড়কে এমনই আরেক ঘটনার কথা জানা যায়। সেখানে অভিযুক্ত করা হয়েছে বাসচালক ও হেলপারকে। যেখানে কলেজপড়ুয়া এক ছাত্রীকে সম্ভ্রম রক্ষার্থে বাস থেকে লাফ দিতে হয়েছে, ফলে তিনি হয়েছেন। চলন্ত বাসে ধর্ষণ কিংবা ধর্ষণের চেষ্টা নতুন কিছু নয়। শুধু ধর্ষণ নয়, চলন্ত পরিবহনে আরও অপরাধ হয়ে থাকে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—ছিনতাই, চুরি, গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া ইত্যাদি।
বিজ্ঞানের অবদানের মধ্যে অন্যতম হলো আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা। বাস, ট্রাক, মোটরসাইকেল সহ বিভিন্ন রকমের গাড়ি তথা মোটরযান পরিবহন ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত। সাধারণত যাতায়াতের জন্য বাস, মিনিবাসসহ ছোট ছোট পরিবহন ব্যবহার করা হয়। মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত গরিব শ্রেণির লোকজন অর্থাৎ যাদের নিজস্ব পরিবহন নেই তারাই যাতায়াত করে থাকে এসব পরিবহনে। এর তদারকির দায়িত্বে থাকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহনে কর্পোরেশন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য থাকে বাংলাদেশ পুলিশের হাইওয়ে পুলিশ বিভাগ ও স্থানীয় থানাগুলো। এছাড়াও পরিবহনে মালিক ও শ্রমিকদের নিজস্ব সমিতি রয়েছে। কিন্তু এত ব্যবস্থার পরেও কোনো ক্রমেই অপরাধের সংখ্যা কমেনি আর এর দায়ভারও কেউ নিতে চায় না। দিন শেষে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে তার ক্ষতি নিয়েই থাকতে হয়। বাস্তবতা হলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও এ ব্যাপারে উদাসীন।
ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা, হত্যা, গাড়ি চাপা দেওয়া-সহ অন্যান্য অপরাধগুলোও চলন্ত পরিবহনে হয়ে থাকে। এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব এটি আশা করা একদমই ভুল। কারণ সমাজে খারাপ প্রভৃতির মানুষ থাকবেই। আর তাছাড়া এর কিছুসংখ্যক অপরাধ অসাবধানতাবশত কিংবা ভুলের কারণে হয়ে থাকে, যেমন সড়ক দুর্ঘটনা। কিন্তু নজরদারী এবং আইনের শাসন সুষ্ঠু ও কঠোরভাবে প্রয়োগ করা গেলে এর সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব। বর্তমানে অধিকাংশ যাত্রী পরিবহনে কোনো সিসিটিভির ব্যবস্থা নেই। অর্থাৎ বাসের অভ্যন্তরে বাস চালক, হেলপারগন ও যাত্রীগণের মধ্যে গতিবিধি ও কার্যকলাপে নজরদারী করার কোনো উপায় নাই। তবে এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়, তা হলো— এতগুলো বাস নজরদারী করা আদৌ কি সম্ভব?
সিসিটিভি ফুটেজ সংরক্ষণের উপায় থাকলেই তা সম্ভব। যখন যে বাসের নামে অভিযোগ আসবে, তখন সে বাসের সিসিটিভি ফুটেজে পর্যবেক্ষণ করা হবে। তবে এখানেও প্রশ্ন থাকতে পারে যে, অপরাধীরা যদি সংরক্ষিত সিসিটিভি ফুটেজকে নষ্ট অথবা গরমিল করে তাহলে অপরাধী শনাক্ত কিভাবে হবে? এখানে বলা রাখা ভালো যে, এত অল্পসময়ে সব বিনষ্ট করা যায় না এবং আর যদি করা হয়ও, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যাবে অপরাধ হয়েছে কিনা এবং কারা অপরাধী? কারণ অপরাধ না করলে সিসিটিভি ফুটেজ লোকানোর প্রয়োজন নেই। এছাড়াও জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম ব্যবহার করে অপরাধ সংগঠনের সময়ে ওই স্থানে কারা ছিলো তাও শনাক্ত করা সম্ভব। জিপিএসের মাধ্যমে মোবাইল ট্র্যাকিং করা যায় আর বর্তমান যুগে মোবাইল ব্যবহার করে না এমন মানুষ নেই বললেই চলে।
এছাড়াও প্রচলিত সমাজে প্রচলিত আইন ও তার সংশোধনের প্রয়োজন আছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭-এ আছে যে, রাষ্ট্রের সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। অনুচ্ছেদ ৩৩ (১) অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যক্তি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবে। ন্যায়বিচারের মূলনীতি অনুযায়ী Every person is innocent until prove guilty অর্থাৎ দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত সবাই নির্দোষ। আর এ ধরনের মামলাতে সন্দেহাতীতভাবে অপরাধ প্রমাণ করতে হয়। Proved beyond reasonable doubt—এগুলো সারা বিশ্বের সবধরনের বিচার ব্যবস্থায় প্রয়োগ করা হয়। বাংলাদেশের মামলার সাক্ষ্য সংক্রান্ত বিষয়ের সাক্ষ্য আইন ব্রিটিশ আমলে তৈরি করা। অপরাধী শনাক্তকরণের নতুন পদ্ধতি, সিসিটিভি ফুটেজ ও জিপিএস সহ আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের বিষয়টি উক্ত আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। যার ফলে সিসিটিভি ফুটেজে যতই অপরাধী শনাক্ত হোক না কেন, বিষয়টি আদালতের এখতিয়ার বহির্ভূত থেকে যায়। আর আসামীরা চাইলে এর সুযোগ নিতে পারে। ২০২০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ সংশোধন করে এখানে মৃত্যুদণ্ডের বৃদ্ধি ও সাক্ষ্য হিসেবে ডিএনএ’কে পরীক্ষার ফল অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু সেটা কেবল ধর্ষণ হওয়ার পরের বিষয়। কিন্তু ধর্ষণ চেষ্টা করা হয়েছে এটাও গুরুতর অপরাধ। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের সাক্ষ্য আইনে ‘ইলেকট্রনিকস এভিডেন্স’ নামে এই ধরনের সাক্ষ্য অন্তর্ভুক্ত করা আছে।
সিসিটিভি ব্যবস্থার বাস্তবায়ন হলে বাসের অভ্যন্তরে ও তৎসংলগ্ন অপরাধ কমে যাবে। কেননা তখন সবাই দেখবে যে, তাদের কার্যকলাপের ভিডিও সংরক্ষিত করা হচ্ছে এবং তা আইনের অন্তর্ভুক্ত। খুব সহজে ধরা পড়ার ভয়ের কারণে অপরাধগুলো করতে চাইবে না। সর্বোপরি বলা যেতে পারে যে, সিসিটিভি ফুটেজ সহ আধুনিক ব্যবস্থা পরিবহনগুলোতে বাধ্যতামূলক করা হলে বর্তমান সরকার ও দেশের জন্য সময়োপযোগী ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ; বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়