Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাংলাদেশ প্যারাডক্স; বিশ্ব অর্থনীতির সম্ভাব্য অবস্থানে দেশ


৩০ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৪১

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের অর্থনীতির ছাত্ররা বাংলাদেশ প্যারাডক্স কথাটির সঙ্গে পরিচিত। বিশ্বের অনেক অর্থনীতিবিদ এর আগে এই ধাঁধাঁর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। কীভাবে তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা ঝেড়ে বাংলাদেশ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাট অগ্রগতি অর্জন করেছে, সেই ধাঁধাঁর উত্তর তারা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন নানা তত্ত্বে। ‘হোয়াই ইজ বাংলাদেশ বুমিং’ নামে একটি লেখায় অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুও বাংলাদেশের সমৃদ্ধির রহস্য উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন। উল্লেখ্য, কৌশিক বসু বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা অর্থনীতিবিদদের একজন। জন্ম কলকাতায়। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং এখন যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক।

বিজ্ঞাপন

তার ভাষায় বাংলাদেশ এখন এশিয়ার সবচেয়ে  চমকপ্রদ এবং অপ্রত্যাশিত সাফল্যের কাহিনীগুলোর একটি। হোয়াই ইজ বাংলাদেশ বুমিং শিরোনামে তার লেখাটি ২০১৮ সালে প্রকাশ করেছে প্রজেক্ট সিন্ডিকেট নামের একটি ওয়েবসাইট। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে একসময়ের দারিদ্র আর দুর্ভিক্ষপীড়িত এই দেশটি এখন শুধু পাকিস্তানকেই নয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতকেও ছাড়িয়ে যেতে চলেছে। কৌশিক বসুর মতে, মাত্র ১২ বছর আগে ২০০৬ সালেও বাংলাদেশের ভবিষ্যত এতটাই হতাশাচ্ছন্ন মনে হচ্ছিল যে, সে বছর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যখন পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেলো, তখন সেটিকে একটি অঘটন বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন অনেকে। কিন্তু সেই বছরটাই ছিলো আসলে বাংলাদেশের টার্নিং পয়েন্ট।

বিজ্ঞাপন

বর্তমান বাংলাদেশ বদলে যাওয়া এক বাংলাদেশ। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে এবং ২০০৯ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে অভাবনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। মাথাপিছু আয় ২০০৫-০৬ সালের ৫৪৩ মার্কিন ডলার হতে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ২ হাজার ৬৫ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। আমরাই বিশ্বে প্রথম শত বছরের ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ বাস্তবায়ন শুরু করেছি।

২০০৬ সাল হতে পরবর্তী প্রতিটি বছর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিলো পাকিস্তানের চেয়ে মোটামুটি আড়াই শতাংশ বেশি। আর এ বছরতো এটি ভারতের প্রবৃদ্ধিকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ এখন যে ধরণের অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ দেশটি হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনোমিক এন্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) তাদের সর্বশেষ এক রিপোর্টে এই পূর্বাভাস দিয়েছে। এতে মূলত সামনের বছর এবং আগামী ১৫ বছরে বিশ্বের কোন দেশের অর্থনীতি কী হারে বাড়বে, তারই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। সিইবিআর প্রতিবছর এই রিপোর্ট প্রকাশ করে। এই রিপোর্ট অনুযায়ী আর মাত্র ৭ বছর পরেই চীন হবে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি। ২০৩০ সালে ভারত হবে তৃতীয়। আর ২০৩৫ সাল নাগাদ ১৯৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বহু ধাপ উপরে উঠে পৌঁছে যাবে ২৫ নম্বরে।

২০২০ সালের সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। সিইবিআর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে অনেক ওলট-পালট ঘটে গেছে। ইউরোপ-আমেরিকার বেশিরভাগ বড় অর্থনীতির দেশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর বিপরীতে চীন খুব কৌশলে করোনাভাইরাস দ্রুত এবং কঠোরভাবে মোকাবেলার কারণে সামনের বছরগুলোতে পৌঁছে যাবে বেশ সুবিধেজনক অবস্থানে। চীন যে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে, সেটাকে সময়ের ব্যাপার বলেই মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু সিইবিআর বলছে, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এই প্রক্রিয়া আরও দ্রুততর হয়েছে। আগে যা ধারণা করা হয়েছিল, তার থেকে ৫ বছর আগেই ২০২৮ সালে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে।

চীনের মতোই একইভাবে বাংলাদেশও যেহেতু করোনাভাইরাসের মধ্যেও কিছুটা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পেরেছে, তাই সামনের বছরগুলোতে বাংলাদেশে ধারাবাহিক এবং জোরালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আশা করছি সিইবিআর। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর আগের বছরগুলোতে বাংলাদেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিলো বেশ ভালো। এবং এটা ঘটেছে দেশটিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও। গত পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বাড়ছে গড়ে ১ শতাংশ হারে। বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় কোভিড-১৯ যেভাবে ছড়িয়েছে, সে তুলনায় বাংলাদেশে সংক্রমণ অনেক সীমিত রাখা গেছে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মারা গেছে ৭ হাজার ৫২ জন। প্রতি এক লাখে ৪ জন। যদিও এই মহামারির কারণে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ছিলো সীমিত, তবে অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করেছে এই মহামারি। কারণ মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে চাহিদা গিয়েছিল কমে আর আন্তর্জাতিক সাপ্লাই চেইনও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল।

তবে অন্য অনেক দেশে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলেও বাংলাদেশ তা এড়াতে পেরেছে। ২০২০ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৮ শতাংশ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। সিইবিআর-এর পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, ২০২১ সাল হতে ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ঘটবে গড়ে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হারে। তবে এর পরের দশ বছরে এই হার কিছুটা কমে গড়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হবে।

২০২০ হতে ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতির সূচকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হবে। এখন বাংলাদেশের অর্থনীতি আছে ৪১ নম্বরে। কিন্তু ২০৩৫ সালে বাংলাদেশ হবে ২৫তম অর্থনৈতিক শক্তি। ২০২০ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১৩৯ ডলার। এই হিসেবটা পিপিপি বা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটিকে হিসেবে নিয়ে করা। বাংলাদেশকে এখন একটি নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ বলে গণ্য করা হয়। (তথ্যসূত্র: ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবিল ২০২১, সিইবিআর)।

২০৩৫ সাল নাগাদ বিশ্বের প্রথম ২৫টি দেশের তালিকায় যুক্ত হবে তিনটি নতুন দেশ: ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন এবং বাংলাদেশ। এর মধ্যে ভিয়েতনামের অবস্থান হবে ১৯, ফিলিপাইনের ২২ এবং বাংলাদেশের ২৫। এর মধ্যে বাংলাদেশের উত্থানকেই সবচেয়ে নাটকীয় এবং রোমাঞ্চকর বলতে হবে। কেননা, বর্তমান র‍্যাংকিং ৪১ থেকে বহু দেশকে টপকে বাংলাদেশ পৌঁছাবে ২৫ নম্বরে। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ৪১। ২০২৫ সালে বাংলাদেশের অবস্থান হবে ৩৪। এর পাঁচ বছর পর ২০৩০ সালে বাংলাদেশ হবে ২৮তম বৃহৎ অর্থনীতি। ২০৩৫ সালে ঢুকবে প্রথম ২৫টি দেশের তালিকায়।

সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষাকে কটাক্ষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ শাসনে আজ দিনবদল হয়েছে। তারই স্বীকৃতি দিয়ে আরেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর আদর্শে এগিয়ে যাচ্ছে।’ ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির মতে, ‘শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে আছে।’ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং নারী-পুরুষের সামাজিক সমতা অর্জনের জন্য বিশ্বের বুকে অনুকরণীয়।’ যার রূপকার শেখ হাসিনা।

উন্নত সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়ার পথে আমাদের সামনে পর্বতসম সমস্যা থাকলেও তা অলঙ্ঘনীয় নয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন সাফল্য প্রমাণ করেছে যে, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, সঠিক পরিকল্পনা কৌশল ও নিবেদিত প্রচেষ্টায় দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অব্যাহত, বলিষ্ঠ ও অবিচল নীতি-নেতৃত্বে রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে পরিকল্পিত উন্নয়নের পথে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে। শেখ হাসিনা তার উন্নয়নকামী জীবন দর্শন ও কর্মনিষ্ঠায় প্রমাণ করেছেন তিনি উন্নয়ন রূপান্তরের যথার্থই নজিরবিহীন রোল মডেল।

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা; বাংলাদেশি ডেলিগেটস, ইয়ুথ ইন্টারন্যাশনাল মডেল ইউনাইটেড ন্যাশনস

বাংলাদেশ প্যারাডক্স

বিজ্ঞাপন

মানুষের হিংস্রতা কেন বাড়ছে?
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:৪১

আরো

সম্পর্কিত খবর