সাফল্যের আরও এক বছর
৩১ ডিসেম্বর ২০২০ ০০:২৯
মুক্তিকামী বাঙালির দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম, ত্যাগ, তিতিক্ষার সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা-ধ্যান-জ্ঞান এবং একনিষ্ঠ দৃঢ়তার ফসল আমাদের স্বাধীনতা। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র, সমস্ত বাধা-বিপত্তি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে আবার নতুন করে গঠনে কাজ শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের খাদ্য সংকট, অর্থনৈতিক সমস্যা, অবকাঠামোগত ভঙ্গুরতা ইত্যাদি নানা পরিস্থিতি ও প্রতিবন্ধকতা অত্যন্ত দৃঢ়তা এবং ধৈর্য সহকারে মোকাবিলা করে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার শুরু করেন।
বাঙালির অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতে দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। বাংলাদেশের মানুষের অগ্রগতির স্বপ্ন থেমে যায় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। সেদিন ঘাতকরা ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বুক, সঙ্গে বাঙালির সকল স্বপ্ন, আশা ও আকাঙ্ক্ষা। তারপরেই এদেশের অন্ধকার ও উল্টোপথে যাত্রার শুরু। সেদিন ভাগ্যক্রমে আল্লাহর অশেষ রহমতে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা । বড় মেয়ে শেখ হাসিনা স্বামীর সঙ্গে ছিলেন জার্মানিতে ও তার সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানাও। তারপর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের দীর্ঘ ২১ বছরের কঠোর সংগ্রাম, ত্যাগ তিতিক্ষার শেষে ১৯৯৬ সালে জনগণের রায় নিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে নতুন করে কাজ শুরু করেন তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ আবার অর্থনৈতিক, শিক্ষা, খাদ্য, স্বাস্থ্য, কৃষি, সামাজিক নিরাপত্তা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নয়নের নতুন দিগন্তের সূচনা করে, যা এদেশের অসাম্প্রদায়িক, শান্তিপ্রিয় মানুষকে নতুন করে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে। এর আগে বিদেশিরা বাংলাদেশকে ‘বটমলেস বাস্কেট’-এর সঙ্গে তুলনা করত কিন্তু শেখ হাসিনা তার দক্ষ নেতৃত্বে এই দুর্নামটি দূর করেছেন। বাংলাদেশকে সমালোচকদের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু সেই অগ্রযাত্রা আবার থমকে যায় ২০০১ সালে।
বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে আবার ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি তৃতীয় এবং ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি চতুর্থ মেয়াদ জনগণের রায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হিসেবে শপথ নেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ১২ বছর অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। শিক্ষা, কৃষি, সামাজিক নিরাপত্তা, ডিজিটাল বাংলাদেশ, অর্থনীতি, বাণিজ্য, জনশক্তি রফতানি, শিল্প, বিদ্যুৎ ও গ্যাস, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য সেবা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, যুব ক্রীড়া, নারী উন্নয়ন, মাথাপিছু আয়, মানব সম্পদ সূচক ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নতি ঘটছে। খাদ্য-ঘাটতির দেশ থেকে আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশে রূপান্তর হয়েছে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার সাহস ও দৃঢ় মনোবলের কারণে আজ আমরা নিজ অর্থায়নে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো পদ্মাসেতু তৈরি করতে পেরেছি। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস সহ বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বর্তমান সরকার যা নগরবাসীকে মুক্তি দিবে যানজটের ধকল থেকে। দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদ দমন, মাদক নিয়ন্ত্রণ শেখ হাসিনা সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি দেশে ও বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হচ্ছে। সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ২০০৯ সালে ২৭টি থেকে গত ১২ বছরে ১১৩টিতে— সর্বমোট ১৪০টিতে উন্নীত করেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বাড়িয়ে ২৩,৭৭৭ মেগাওয়াট এ উন্নীত করা হয়েছে। এটি শেখ হাসিনা সরকারের একটি বিস্ময়কর সাফল্য। বিদ্যুতের ঘাটতিকে জয় করেছে বলেই আজ দেশে শিল্প ও কৃষির উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ।
ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর কোনো স্বপ্ন নয় বাস্তবতা। গত ১২ বছরে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে জেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা, ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং, মোবাইল মানি ট্রান্সফার, অনলাইনে বিমান, ট্রেন, বাস টিকিট, ই-টেন্ডারিং, ই-পাসপোর্ট, ই-শিক্ষা, ই-স্বাস্থ্য, ই-কৃষি, ই-বাণিজ্য, অনলাইনে আয়কর রিটার্ন , অনলাইনে ড্রাইভিং লাইসেন্স, অনলাইনে বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার তথ্য ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে যা অগ্রযাত্রাকে আরও গতিশীল করছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য সারা বিশ্বে স্বীকৃত। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ছে, সাথে শিক্ষার্থী ঝরে পড়াও অনেক কমছে। ১৯৯০ সালে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর শতকরা হার ছিলো মাত্র ৬১, বর্তমান সরকার তা উন্নীত করেছে শতকরা ৯৭.৭ ভাগে। ২০০৯ থেকে গত ১২ বছরে দেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির জন্য দেশে অনেকগুলো সরকারি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপন করা হয়েছে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৮ লাখে উন্নীত হয়েছে। বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ ও শিক্ষাবৃত্তি সরকারের ভালো কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। টিকাদান কর্মসূচি ও দরিদ্র মানুষদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য শেখ হাসিনার কমিউনিটি ক্লিনিক সারা বিশ্বে অন্যতম রোল মডেল হিসেবে তার স্থান করে নিয়েছে। মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার, জন্মহার হ্রাস ও গড় আয়ু বৃদ্ধিতে আওয়ামী লীগ সরকারের সাফল্য অনেক।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশের হতদরিদ্র মানুষের জন্য গত ১২ বছর নানা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলছেন। অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, বয়স্ক, বিধবা ও দুঃস্থ মহিলা ভাতা, মাতৃকালীন ভাতাসহ ভাতার হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পর মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটানোর উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান সরকার। কর্মসংস্থান, মাথাপিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধি, কৃষিতে এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, প্রবাসী শ্রমিকদের উন্নয়নে, শিল্প ও বাণিজ্য খাতে উন্নয়ন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, মঙ্গা দূরীকরণ ও অতিমারি করোনা পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্ব ও তার সরকারের সাফল্য সর্বজন স্বীকৃত। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের ধারাটিকে বাধাগ্রস্ত করেছে কিন্তু রোহিঙ্গাদের প্রতি আমাদের উদার মানবিক মনোভাব ও রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে আশ্রয় প্রদান বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে সম্মানজনক স্থান করে দিয়েছে।
২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সারা পৃথিবী যখন বিপর্যস্ত ও দিশাহারা তখন এই মহামারি থেকে বাংলাদেশের মানুষের জীবন বাঁচাতে, জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে—বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, ছাত্রলীগ সহ বিভিন্ন সংগঠন প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে অসহায় ও দরিদ্র মানুষের পাশে দাড়ায়। দরিদ্র ও অসহায় মানুষকে ত্রাণ সহযোগিতার পাশাপাশি জীবিকা ও অর্থনীতি বাঁচাতে নিয়েছেন নানান পদক্ষেপ ও আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ যার জন্য দেশের ভেতরে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এবং ফোর্বস ম্যাগাজিনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রশংসিত হচ্ছেন শেখ হাসিনা। করোনা মহামারির সময় ২ হাজার চিকিৎসক ও ৫ হাজার ৫৪ জন নার্স নিয়োগ ছিলো শেখ হাসিনার সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। এই চরম দুঃসময়েও দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সে জন্য নিয়েছেন সঠিক ও নানা যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
নানা ষড়যন্ত্র, বাধা-বিপত্তি ও প্রতিকূলতার মধ্যে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। যদি বর্তমান উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকে, দুর্নীতিবিরোধী জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত থাকে, গণতান্ত্রিক রাজনীতির স্থিতি বজায় থাকে, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যে একটি মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত দেশ হবেই তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ কাজটি একমাত্র বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার পক্ষেই করা সম্ভব। বর্তমান উন্নয়নের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখার জন্য ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে ঐক্যবদ্ধভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সবাইকে নিরলসভাবে কাজ করতে হবে নতুন বছরে ।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; কার্যকরী সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ