সম্ভাবনার নতুন সমুদ্র জাগবেই
৩১ ডিসেম্বর ২০২০ ১৬:১৯
বছরটি মানবজাতির জন্য বিষময়। বছরজুড়ে কেটেছে আতঙ্ক আর উদ্বেগের মধ্যে। কেমন যেন এক অনিশ্চতায় ভরা জীবন। সারাবছরজুড়েই ছিল করোনাভাইরাসের মরনভীতি। অথচ ২০২০ সালকে ঘিরে মানুষের মধ্যে একধরণের আগ্রহ এবং আকর্ষণবোধ ছিল। বর্ষবরণের সময় ঘুণাক্ষরেও টের পাওয়া যায়নি, এই বছরটি জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত এবং বিদঘুটে বছর হতে চলেছে। কিন্তু বছরের শুরুর দুই মাসের মাথায় একটি মারণাস্ত্র ভাইরাস জীবনকে উল্টে-পাল্টে দিয়ে গেল। তার অভিঘাত দ্রুত শেষ হয়ে যায়নি। অসংখ্য মানুষকে মুখে করে নিয়ে গেল মানুষখেকো করোনা। হারিয়েছি অনেক কিছু। ব্যক্তিগত জীবনে আমাদের স্বজন-আমাদের প্রিয়জনদের হারিয়েছি। একই দেশ-রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে হারাতে হয়েছে। ব্যক্তিগত জায়গা থেকে দেশ-রাষ্ট্রে এ এক ভয়াবহ অপূরণীয় শূন্যতা। যারা যে অবস্থায় হারিয়েছি, তাদের শোকার্ত উপলব্ধিটা হয়তো সহজে অনুমান করা যাবো না। যার হচ্ছে, বা যার যাচ্ছে, সেই টের পাচ্ছে। আবার সর্বোচ্চ চেষ্টার পরও আবার অনেকে হাসপাতালে অক্সিজেন আর ভেন্টিলেটরের মধ্যেই মারা যাচ্ছেন। সব প্রচেষ্টা নিমিষে ধুলোয় মিশে যাচ্ছে। এতো তীব্র আর শক্তিশালী এই করোনা!
এমন ভয়াবহ সময় আমার বা আমাদের জীবনে আর আসে নি। পুরো ছবিটা বোধহয় পাল্টে গেছে। এবং দ্রুত পাল্টে যেতে থাকে মার্চ থেকে। গোটা পৃথিবীটাকে যেনো মৃত্যুর চাদরে মুড়ে ফেলে করোনা। ঘরবন্দি মানুষ কান্নাভেজা গলায় গান গেয়ে চলেছে। যখন এ লেখাটি লিখছি, তখন করোনা উপসর্গ নিয়ে আমি-আমার পরিবারও লড়াই করছি। একদিকে শারীরিক কষ্ট, অন্যদিকে নানান মানসিক পীড়া (কখনও কখনও নির্যাতনও মনে হয়) আরও অসুস্থ করে তোলে।
আরও কত মানুষের জীবন কেড়ে নিয়ে করোনা তার তান্ডব বন্ধ করবে তা এখনও বলা যাচ্ছে না। কারণ এখন দেশে দেশে চলছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, মৃত্যুবরণ করছে। করোনা মহামারির বিপদের মধ্যেই আসছে আরেকটি নতুন বছর ২০২১ সাল। মানুষ এখন ২০২০ এর বিদায়ক্ষণ গুণছে।
পৃথিবীজুড়ে মানুষের মধ্যে এ নিয়ে যে ভয় ও অসহায় অবস্থা তৈরি হয়েছে তা তুলনাহীন। একসাথে সমগ্র বিশ্বকে থমকে দেওয়ার ভয়াবহ ক্ষমতা জানান দিলো, পুঁজিবাদী উন্নয়নের চাকচিক্য কতটা ফাঁপা! মহাপরাক্রমশীল সাম্রাজ্যবাদী উন্নত দেশগুলো অসহায় আত্মসমর্পন করেছে সংক্রামক করোনাভাইরাসের কাছে। প্রস্তুতি কারুরই ছিল না এ আঘাত মোকাবিলার। তারপরও সমাজতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল দেশ বা সরকারগুলো যেভাবে করোনা ভাইরাসকে সামলাতে পেরেছে পুঁজিবাদী দেশগুলো সেভাবে পারেনি।
বিশ্বে বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৮০০ কোটির কাছাকাছি। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর এখন একটাই আশা, করোনা-ঝড় মোকাবিলা করতে সক্ষম হোক মানুষ। বছর বিদায়ের আগেই অবশ্য আশার আলো দেখিয়েছে চিকিৎসাবিজ্ঞান। বিরুদ্ধ-পরিবেশের কাছে মানুষের পরাভব না মানার যে স্পৃহা তা আবার জয়ী হয়েছে। স্বল্পতম সময়েই আবিষ্কার হয়েছে করোনা ভ্যাকসিন। কয়েকটি দেশে ভ্যাকসিনের ব্যবহারও শুরু হয়েছে। ভ্যাকসিন এলেও বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের বিরূপ পরিস্থিতি রাতারাতি বদলে যাবে বলে মনে করার কারণ নেই। কেননা, এরই মাঝে করোনার নতুন ধরণের বিস্তার হচ্ছে ইউরোপে, যার সংক্রমণের হার সত্তর ভাগ বেশি। করোনা আছে দাপটে, রাজত্ব বিস্তার করে আছে। কিন্তু মানুষের ভয়টা কেটে যাচ্ছে। রাস্তা-ঘাটে বের হলে দেখা যায়, মানুষের ভয় কমে গেছে। সম্ভবত লাগাতার ভয় পেয়ে যাওয়াটাও একঘেয়েমি। ভয়টা মনের সঙ্গে কেটে গেল খেলতে খেলতে।
পৃথিবীকে বাসঅযোগ্য করার জন্য যেমন কিছু মানুষের দুষ্টবুদ্ধি দায়ী, তেমনি পৃথিবীকে নতুন করে গড়ে তুলতেও শুভবুদ্ধির মানুষেরাই এগিয়ে আসে। প্রকৃতির সঙ্গে বৈরিতা, নিষ্ঠুরতার পাশাপাশি প্রকৃতি রক্ষায়ও উদ্যোগী হচ্ছে সেই মানুষই। তাই মানুষের ওপর বিশ্বাস না হারিয়ে আশায় দিন গুণতে হবে আমাদের। ঝড় যেমন ওঠে, তেমনি ঝড় থেমেও যায়। করোনাকাল নিশ্চয়ই চিরস্থায়ী হবে না। করোনাভীতি কাটিয়ে উঠে হয়তো নতুন কোনো ভয়ের মুখোমুখি হওয়ার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে ভয়ই শেষ কথা নয়। জয়ের হাতছানিও থাকে।
করোনার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থেকে কি শিক্ষা আমরা নেবো সেই প্রশ্নের সঙ্গে এ প্রশ্নও আছে যে, করোনা-পরবর্তী পৃথিবীটা কি করোনা-পূর্ববর্তী পৃথিবীর মতই থাকবে? ২০২১ সাল কি ২০২০ সালের কার্বন কপি হবে? না। নদীতে এক পানি দুইবার প্রবাহিত হয় না। পবিরবর্তন হল জীবজগতের বড় বৈশিষ্ট্য। বেশির ভাগ মানুষই পরিবর্তন চায় এবং সে পরিবর্তন অবশ্যই ভালোর দিকে। করোনা সব দেশের সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতিতে কিছু না কিছু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে, করবে। করোনাকালে সব কিছু একেবারে থেমে না থাকলেও, অস্বাভাবিক অবস্থা তো তৈরি হয়েছে।
সারাবিশ্বে মহামারি বিস্তার শুরুর সময়ে তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়লে যেমন বিস্ময় সৃষ্টি হয়েছিল, তেমনি এ আশাবাদও জেগেছিল যে এ থেকে শিক্ষা নিয়ে পরিবর্তন ঘটবে। অস্বীকারের উপায় নেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যথাযথ ভূমিকা পালনে সফল হয়নি, জাতিসংঘ এ সংকটে কার্যত অনুপস্থিত। কোভিড-১৯ এর সময়ে আমরা দেখতে পেলাম, স্বাস্থ্যখাতে বৈশ্বিক উদ্যোগ কতটা দরকার। বৈশ্বিকভাবে যে প্রশ্নের উত্তর মেলেনি, তা হচ্ছে, এ সহযোগিতার ক্ষেত্র কী, মাত্রা কতটুকু?
করোনা বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের প্রকৃত চেহারা খুলে দিয়েছে। দেখিয়ে দিয়েছে এই খাতটি কতটা দুর্বল এবং নিয়ন্ত্রণহীন। স্বাস্থ্যখাতকে ঢালাও বাণিজ্যিকীকরণের ফলে উপরিভাসা চাকচিক্যময় তথাকথিত উন্নয়নের যে ফাঁপা অবকাঠামো গড়ে উঠেছে মানুষকে এই মহাবিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি। করোনাভাইরাসের বিস্তারের পূর্বে প্রস্তুতি নেওয়ার মত পর্যাপ্ত সময় পাওয়ার পরও ভাইরাসটি মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত কার্যক্রমে সুশাসনের প্রতিটি নির্দেশকে ব্যাপক ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমে পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের ঘাটতি এবং বিভ্রান্তিকর ও পরস্পরবিরোধী নানা কর্মকাণ্ডের কারণে দেশে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করেছে। এছাড়া এই সংকটকালে দীর্ঘসময়ের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা, সুশাসনের ঘাটতি ও অপ্রতুল বাজেট বরাদ্দের কারণে স্বাস্থ্যখাতের দুর্বলতা আরও গভীরভাবে ফুটে উঠেছে। কিন্তু সবার কাছ থেকেই একটি কথা ‘কমন’ শোনা যায়, আর তা হলো দুর্নীতি। কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন খাতে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে। জড়িতরা দুর্নীতিকে মহোৎসবে পরিণত করেছে। সরকার দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে তথ্য নিয়ন্ত্রণে বেশি তৎপর ছিল। বদলি ছাড়া দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি।
করোনাভাইরাসের সৃষ্টি ও বিস্তার প্রকৃতি থেকে এ তথ্য আলোচনার সূত্রপাত করেছিল যে পৃথিবী প্রকৃতি-বিধ্বংসী উন্নয়নের ধারণা পুনর্বিবেচনা করবে, জনস্বাস্থ্যের বিবেচনা প্রাধান্য পাবে। নতুন মানবিক পৃথিবী গড়া সম্ভব। প্রযুক্তি ব্যবহারের ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই যে আছে এবং তার ব্যবহারও আমাদের বিপদ থেকে মুক্ত রাখতে বলা হয়েছিল, আবার তা নাগরিকের অধিকার সীমিত করতেও পারে, সেই আশঙ্কা পুরো বছর ধরে উচ্চারিত হয়েছে।
বছরজুড়ে সারাবিশ্বে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা পরিস্থিতিও নাজুক ছিলো। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলোতে মুক্ত সংবাদমাধ্যমের ওপর হুমকি বেড়ে যাওয়া বাকস্বাধীনতার অবনতির বিষয়টি উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, পেশাগত দায়িত্ব পালন করার কারণে প্রতিহিংসার শিকার হয়ে ২০১৯ সালে যতজন সাংবাদিক খুন হয়েছেন, ২০২০ সালে তার দ্বিগুণসংখ্যক সাংবাদিক খুন হয়েছে।
অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়েছে। মানুষের চলাচল ব্যাহত হয়েছে। অনেক মানুষ কর্মহীন হয়েছে। কাজের সুযোগ ও পরিধি সংকুচিত হয়েছে। অনেক মানুষকে বেকারত্বের জ্বালা সহ্য করতে হচ্ছে, হবে। খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে কোথাও কোথাও। করোনার বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনের ব্যবহার ও নতুন সংক্রমণের পটভূমিতে বিশেষজ্ঞরা বিশ্বব্যাপী আর্থিক সঙ্কটের আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন। পুরো একটি বছরের বৈশ্বিক মহামারি মানুষের জান ও মালের ব্যাপক ক্ষতির পাশাপাশি অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করেছে। বাড়িয়েছে মন্দা ও বেকারত্ব। অর্গানাইজেশন ফর ইকনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) তার সর্বশেষ ‘গ্লোবাল ইকোনোমিক আউটলুক’ রিপোর্টে জানিয়েছে, ‘ভ্যাকসিন এলেও অর্থনীতির গতি মন্থর থাকবে’। করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে যে ধ্বস নেমেছে, তা খুব সহজে ও অতিদ্রুত কাটবে না বলেও মন্তব্য করেছে বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে কমর্রত এ সংস্থা।
দুনিয়াব্যাপীই শিক্ষার্থীদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে হয়তো অনেকে ঝরে পড়বে। সমাজে দেখা দেবে সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া। করোনা মহামারি শিক্ষার্থীদের বিরাট ক্ষতি করেছে। দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থায় উন্নত জাতি গঠন সম্ভব না। বাংলাদেশে শিশুশ্রেণি থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত সাধারণ, কারিগরি, মাদ্রাসা, কিন্ডারগার্টেন প্রভৃতি শিক্ষার্থী দুই কোটির বেশি। তাদের খুব ক্ষতি হলো। মার্চ মাস থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। শুধুই বন্ধ নয়, প্রথম কয়েক মাস সামাজিক দুরত্ব রক্ষার জন্য তারা ছিল ঘরবন্দী। পড়াশোনার ক্ষতি শুধু নয়, মানসিক দিক থেকে তাদের, বিশেষ করে শিশুদের যে ক্ষতি হল তা অপূরণীয়। বছরের শেষার্দ্ধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। হুট করে এই পদ্ধতি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে নতুন। গ্রামের দিকে দরিদ্র পরিবারের অনেক শিক্ষার্থীর কম্পিউটারও নেই, ইন্টারনেট সংযোগও নেই। তাছাড়া দুর্বল নেটওয়ার্কের কারণে ওই ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা তেমন উপকৃত হয়নি। সবচেয়ে বৈষম্যের শিকার হয়েছে গ্রামের গরীব মেধাবীরা। তাছাড়া ইন্টারনেটের সমস্যার কারণে অনেকেরই লার্নিং গ্যাপ থেকে যাচ্ছে। আবার তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার ঠিকমতো হচ্ছে না, তা দেখতে হবে। বিদায়ী বছরে মহামারির কারণে শিক্ষাব্যবস্থায় যে ক্ষতিগুলো হয়েছে, সেগুলো নতুন বছরে কীভাবে পুষিয়ে নেওয়া যায় তা নিয়ে নীতিনির্ধারক, শিক্ষাবিদদের এখন থেকেই ভাবতে হবে।
বাংলাদেশও করোনার ধকল মুক্ত থাকেতে পারেনি। অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। অকল্পনীয় ধাক্কায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে অর্থনীতি। এর মধ্যে প্রবাসী আয় ও রিজার্ভেই ছিলো কেবল সুখবর। অনেকে কর্মহীন হয়েছে। করোনাকালে শ্রমিক ব্যবস্থাপনায় মালিকপক্ষের অদক্ষতা বারবার ফুটে ওঠে। সরকারের সহযোগিতার পরও নিজেদের লোকসান কমাতেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন তারা। এপ্রিলের তিন সপ্তাহ কারখানা বন্ধের অজুহাতে শ্রমিকদের ৬৫ শতাংশ মজুরি দিয়েছেন। শ্রম প্রতিমন্ত্রী বার বার ছাঁটাই না করার অনুরোধ করলেও খুব একটা কানে তোলেনি মালিকপক্ষ। ঈদ বোনাসও কম দেন তারা।
করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০ সালে নতুন কোনো ঋণখেলাপি হবে না বলে জানিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ঋণ শোধ না করেও এই বছরে খেলাপি ঋণ হয় কেউ। আবার নতুন ঋণও পেয়েছেন। অর্থাৎ পুরো বছরেই ছিলো ঋণখেলাপিদের জয়জয়কার। তবে নারীরা এ বছরে সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত, নির্যাতিত ও ধর্ষণের শিকার হয়েছে। কঠোর আইন, প্রচার-প্রচারণা ও উচ্চ আদালতের নানা ধরনের নির্দেশনার পরও নারীর প্রতি সহিংসতা কমেনি। বরং দিন দিন এর মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির সময় নারী ও মেয়েদের প্রতি সহিংসতার উর্ধ্বগতি সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতনের মতো বিষয়গুলো এখনও আমাদের দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে।
সম্ভবত আমাদের দেশের মতো করে করোনা প্রতিরোধে এত দায়সারা ব্যবস্থা বিশ্বের কোনো দেশেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। কম পরীক্ষায় কম আক্রান্ত, বা করোনা আছে ঠিকই ‘তুমি পারলে বাঁচো’, এই হচ্ছে আমাদের সরকারের ব্যবস্থা। কাগুজে হিসেবে সফলতা দেখাও আর বাহ্ববা কুড়াও।
রাজনীতিও অনেকটাই করোনাকবলিত। বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা সীমিত। তবে বামজোটসহ সিপিবি বেশ তৎপর রয়েছে। প্রতিদিনই তারা কোনো না কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছে। অভ্যন্তরীণ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারছে না এক সময়ের প্রবল প্রতাপশালী রাজনৈতিক দল বিএনপি। নতুন বছরে দলটি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না, এখনই তা বলা মুশকিল।
২০২১ সাল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এ বছরটাও কি আগের পরিকল্পনা মতো উদযাপন করা যাবে? করোনার দাপট না কমলে রাজনীতির ময়দানে কেউই দাপট দেখাতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে নতুন বছরের জন্য নতুন পরিকল্পনা বড় রাজনৈতিক দলগুলোর নিশ্চয়ই আছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, বিএনপি চায় ক্ষমতায় যেতে। নতুন বছরে চির প্রতিদ্বন্দ্বী দুই রাজনৈতিক শক্তি একে অপরের জন্য কোনো চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে কিনা, দেখার বিষয় সেটাই। সালতামামি নিশ্চয়ই যে যার মতো করবেন।
এ বছর কোভিড-১৯ মহামারিতে বিশ্বজুড়ে প্রায় ২০ লাখ মানুষের মৃত্যুসহ অন্যান্য ক্ষতচিহ্ন ব্যক্তি, পরিবার, দেশ ও বিশ্বকে অনেক দিন বইতে হবে। একদিকে টিকা আবিস্কার এবং তা প্রয়োগের কারণে আশার আলো দেখা যাচ্ছে, অন্যদিকে ভাইরাসের নতুন ধরণ মানবসভ্যতাকে চোখ রাঙাচ্ছে। করোনার কারণে নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হবেন না, এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সব দেশই করোনার ঝাঁকিতে কেঁপেছে। ২০২০ যে দুর্যোগ চাপিয়ে দিয়ে বিদায় নিচ্ছে, ২০২১ তা কতটুকু সামলে উঠতে পারবে, সেটাই দেখার বিষয়।
২০২১ সাল শুরু হবে ভিন্নভাবে। কিন্তু কতটা ভিন্ন হবে পৃথিবী? কতটা পরিবর্তন ঘটছে ২০২০ সালে? তবে ২০২০ কে বিদায় জানাতে মন হয়তো ভারাক্রান্ত হবে কম, কারণ বিশ্ব যে বিষ ছড়িয়েছে বেশি। নতুন বছর ২০২১-কে স্বাগত জানানো হবে আশায় বুক বেঁধে। কারণ একুশ যে আমাদের চেতনার সঙ্গে মিশে আছে। কিছু সমস্যা যেমন সহজে দূর হবে না, তেমনি তার ভেতরেই নতুন সম্ভাবনাও দেখা দেবে। শিক্ষা, জীবিকা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অসমতা দেখা দিতে পারে। কিন্তু সব সম্ভাবনার জায়গাগুলো খুঁজে বের করে তার সদ্ব্যবহার করতে হবে তরুণদের। তারুণ্য যখনই যে লড়াইয়ের সামনে থেকেছে সে লড়াই কখনও হারেনি। তাই ২০২১ হোক আশা ও প্রেরণার বছর। মানুষের ভেতরে সম্ভাবনার নতুন সমুদ্র জাগবেই। ঠিক যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার মতো ‘চলেছে মন্থর তরী নিরুদ্দেশ স্বপ্নেতে বোঝাই’।
হাবীব ইমন : সহকারী সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, কেন্দ্রীয় কমিটি