শুভ বার্তা নিয়ে আসুক ২০২১
১ জানুয়ারি ২০২১ ১৮:২১
কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেলো ২০২০। নানা সংকট, সংঘাত, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনায় কেটে গেলো আরেকটি বছর। তবে এ বছরটি শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ববাসীর কাছে কোনোভাবেই সুখকর ছিল না। বছরের শুরুতেই হানা দিয়েছিল বৈশ্বিক মহামারি নভেল করোনাভাইরাস। বাংলাদেশ সহ পুরো বিশ্বকে দাঁড় করেছে কঠিন এক বাস্তবতার মুখোমুখি। বদলে গিয়েছে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। গত বছরের শুরুতে যা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। মার্চ মাস থেকে করোনার কঠিন থাবার মুখোমুখি হতে হয়েছে। সুস্থ থাকার জন্য মানিয়ে নিতে হয়েছে নতুন নতুন অনেক অভ্যাসের সঙ্গে।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে উদ্ভূত রহস্যময় এই করোনাভাইরাসের। এরপর ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। বাংলাদেশে ৮ মার্চ প্রথম তিন জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে বলে জানায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। প্রথম রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর ১৮ মার্চ দেশে প্রথম মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। শুরুর দিকে করোনার সংক্রমণের গতি কম থাকলেও মে মাসের মাঝামাঝি থেকে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ অবনতির দিকে যেতে শুরু করে। ওই মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই রোগী শনাক্তের হার চলে যায় ২০ শতাংশের ওপরে। চলতে থাকে আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। তবে তার পর থেকে শনাক্তের হার কমতে থাকে। প্রায় এক মাসের বেশি সময় থেকেই শনাক্তের হার ১০ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে ছিল। তবে গত ২ নভেম্বর থেকে ফের বাড়তে শুরু করে করোনার সংক্রমণ। এখন পর্যন্ত সংক্রমণের এ ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে।
করোনার সংক্রমণ রুখতে প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ার ১৮ দিন পর, অর্থাৎ ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি (অঘোষিতভাবে লকডাউন) ঘোষণা করে সরকার। বন্ধ থাকে সরকারি অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যান চলাচল, হোটেল-রেস্তোরাঁ, হাট-বাজার, আমদানি-রফতানি, পর্যটন স্পটসহ সবকিছু। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অফিস বন্ধ রেখে বাসা থেকে কর্মীদের কাজ করার সুযোগ করে দেয়। শুরু হয় মানুষের এক দুর্বিষহ জীবন।
করোনার ভয়ে প্রথম দিকে আতঙ্কে কেউ জরুরি কাজ ছাড়া বাসা থেকে বের হয়নি। এমনভাবে করোনার আতঙ্ক ছড়িয়েছিল যে, কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে শুনলে মানুষ ওই বাড়ির পাশ দিয়েও যেত না। করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল ছাড়া অন্য হাসপাতালে জ্বর-সর্দি, কাশির রোগী গেলে কর্মরতরা ভয়ে দৌড় দিত। করোনার আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে ভয়ে লাশ দেখতেও আসত না কেউ। অনেক গ্রামে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশ দাফন করতে দেওয়া হয়নি।
করোনাকালের শুরুতে ছিলাম পেশাগত কারণে রাজধানীতে ছিলাম। তখনকার সেই সময়ে কথা মনে পড়লে এখনো গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। করোনা দেখা দেওয়ার পর সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলে মানুষ রাজধানী ছাড়তে শুরু করে। ভুতুড়ে অবস্থা দেখা দেয় নগরজুড়ে। মানুষ ভয়ে ঘর থেকে বের হতো না। আমাদেরও অফিস থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়—বাসা থেকে কাজ করতে। সারাদিন বাসায় থাকাও কষ্টকর হয়ে উঠে। বিকেলে বাসা থেকে একটু হাটতে বের হলে রাস্তায় অপ্রয়োজনে মানুষে দেখা পাওয়া যেত না। কেউ কারো পাশে আসতো না। এমনকি বন্ধুরা ফোন করলেও দেখত আসতো না। এ পর্যায়ে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে আমিও চলে যাই মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় গ্রামের বাড়িতে। ফিরি জীবনযাত্রা কিছুটা স্বাভাবিক হলে।
বাংলাদেশে যখন করোনা দেখা দেয় তখন থেকেই করোনার রিপোর্ট কাভার করতাম। এখনো করছি। প্রতিদিনই লিখেছি নানা খবর। সাক্ষী হয়েছি নানা ঘটনার। দেখেছি কতো জীবনের হাহাকার। কত স্বপ্নকেও দেখেছি মুকুলেই ঝরে যেতে।
করোনার ব্যাপক প্রভাবে থমকে যায় অর্থনীতির চাকা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকায় চাকরি হারায় লাখ লাখ শ্রমিক। অনেক প্রতিষ্ঠান চাকরি থেকে বাদ না দিলেও বেতন দেওয়া বন্ধ কিংবা অর্ধেক করে দিয়েছিল। দীর্ঘদিন বেকার থাকার কারণে জমানো শেষ সঞ্চয়টুকুও খরচ করে পথে বসেছিল বহু মানুষ। অনেকে বাসা ভাড়া দেওয়ার সক্ষমতা হারিয়ে ট্রাকে করে আসবাবপত্র নিয়ে চলে যায় গ্রামের বাড়িতে। আমার অনেক সহকর্মীদের দেখেছি করোনাকালে গণমাধ্যম থেকে চাকরি হারিয়েছেন। বেঁচে থাকার জন্য কেউ কেউ বাড়িতে চলে গেছেন। আবার কেউ অনলাইনে বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসা করছেন। বাসায় বাসায় গিয়ে পণ্য ডেলিভারি দিচ্ছেন।
করোনার ব্যাপক প্রভাব পড়ে প্রবাসী শ্রমবাজারেও। করোনাকালে দেশে দেশে আরোপিত লকডাউন ও শাটডাউনের ফলে চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরেছেন দেড় লক্ষাধিক শ্রমিক। এ ছাড়া এই সময়ে নতুন করে কোনো শ্রমিক বিদেশে যেতে পারেননি। দেশে ছুটিতে এসে আটকে পড়াদের অনেকেই এখনো কর্মস্থলে ফিরে যেতে পারেননি। অনেকের ভিসা-টিকিট প্রস্তুত থাকলেও ফ্লাইট বন্ধ থাকায় বিদেশ যেতে পারেননি। এখনো সবকিছু স্বাভাবিক না হওয়ায় যেতে পারছেন না অনেকে।
করোনার কারণে শিক্ষার্থীরা হারিয়েছে তাদের জীবন থেকে একটি বছর। করোনার কারণে মার্চ মাস থেকে এখনো বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এইচএসসি, জেএসসি ও পিএসসি সমমানের পরীক্ষাগুলো নেওয়া সম্ভব না হওয়ায় সবাইকে দেওয়া হয় অটোপাস। এ ছাড়া উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত সব শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের অটোপাস দিয়ে পরবর্তী ক্লাসে তোলা হয়। জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বছরব্যাপী নানা কর্মসূচী হাতে নিয়েছিল সরকার। তাও করোনার কারণে হুঁচট খেয়েছে।
বর্ষ-পরিক্রমায় যুক্ত হলো আরেকটি বছর। শুরু হলো নতুন বছর। বছরটি কেমন যাবে আদৌ আমরা জানিনা। কবে এ মহামারি থেকে মুক্তি পাব তাও নিশ্চিত করতে পারছেন না বিশ্বের কোনো স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তবে আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উৎপাদিত ভ্যাকসিন। ইতিমধ্যে অনেক দেশে ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব টিকা আমাদের মতো দেশগুলোতে কবে নাগাদ এসে পৌঁছতে পারে? স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলছেন, আগামী জুনের মধ্যে সেরাম ইনস্টিটিউট ও গ্যাভি কোভেক্স থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন পাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমান অনুসারে, গণহারে টিকাদান কার্যক্রম শুরু করতে ২০২১-এর মাঝ পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। সবার কাছে টিকা পৌঁছানোই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় নয়, পর্যাপ্তসংখ্যক টিকা উৎপাদনের প্রশ্নও জড়িত আছে।
বাংলাদেশ সহ গোঠা বিশ্বের এই সংকটময় সময়ে পূর্ণ হতে চলছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর। আগামী মার্চে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের আশায় দীর্ঘদিন থেকে প্রহর গুনছে জাতি। কিন্তু বহুল আকাঙ্ক্ষিত সেই সুযোগ আসবে কী? যাইহোক, সবকিছুর একটা শেষ আছে। করোনাকালও নিশ্চয়ই একদিন শেষ হবে। আর সেইদিন থেকে আমাদের নামতে হবে করোনার ক্ষতি পুষিয়ে উঠার যুদ্ধে।
প্রতিবারই মানুষ নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাগত জানায় নতুন বছরকে। প্রার্থনা করে সব বাধা-বিঘ্ন কাটিয়ে পৃথিবীতে যেন উদিত হয় নতুন সূর্য। সেই সূর্যের আলোয় যাতে আলোকিত হয় মানুষের জীবন। ২০২১ সালকে নিয়েও মানুষের প্রত্যাশা অনেক। আশা করি অতীতের গ্লানি ভুলে নতুন উদ্যমে মানুষ শুরু করবে নতুন বছর।
লেখক: সাংবাদিক, নিজস্ব প্রতিবেদক, দৈনিক মানবকণ্ঠ