আসুন অপরাধীদের পক্ষে কাজ করি!
৪ জানুয়ারি ২০২১ ২০:২৩
আসুন নতুন বছরে নতুনভাবে চিন্তা করি। কোনো কাজ হচ্ছেনা জেনেও শুধু আচ্ছন্নতার কারণে পুরানকে আঁকড়ে ধরে থাকার অভ্যাস আমাদেরকে পিছিয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। নতুন কোনো কথা সত্য এবং বাস্তব হলেও; শাস্ত্র, তন্ত্র, ও মন্ত্রে তার সমর্থন না থাকলে আমরা তা ফেলে দেই। এক সময় আমাদের ধারণা ছিল আমাদের আয়ু নির্ধারিত, সুতরাং যা পাই তা খেয়ে যাই; এতেই মঙ্গল। কিন্তু পরে দেখা গেল যে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে যারা বেশিদিন বাঁচতে চেয়েছেন স্রষ্টা তাদের আয়ু বাড়িয়ে দিয়েছেন। যেমন, ১৯৭০ সালে আমাদের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৪৮ বছর, আর এখন ৭২.৬ বছর। অর্থাৎ শাস্ত্র, কিংবা তন্ত্র, মন্ত্র বিষয় নয়, স্রষ্টা আসলে চান আমরা শৃঙ্খলা মেনে চলি। তাই কোনো শৃঙ্খলা যদি নতুনের কথা বলে তবে ওই নতুনকেই সাদরে গ্রহণ করতে হবে।
দেখুন। এ পৃথিবীর জন্ম হয়েছে সাড়ে চার বিলিয়ন বছর আগে। বিবর্তন কিংবা যেভাবেই হোক আমাদের মতো চেহারা ও চিন্তার মানুষ এসেছে একশো ত্রিশ হাজার বছর আগে। অথচ মানুষ মানুষের মতো করে বাঁচার চিন্তাটা মাথায় এনেছে আজ থেকে মাত্র দশ হাজার বছর আগে। আর যদি বলেন আধুনিক বিশ্বের কথা; সত্যিকার অর্থে তা এসেছে মাত্র সেইদিন, ১৯২৬ সালে চার্লস ব্যাবেজের কম্পিউটার আবিষ্কারের পর থেকে। অর্থাৎ বুঝলেন তো; কম্পিউটার আবিষ্কারের পর থেকেই মানুষের মাথায় একটার পর একটা নতুন চিন্তা আসতে থাকে। আর এই আসতে থাকা নতুন নতুন চিন্তার যোগে মাত্র অর্ধ শতাব্দী সময় নিয়ে পৃথিবীর অবকাঠামোগত উন্নয়ন এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, যা পূর্বের হাজার হাজার শতাব্দীতেও সম্ভব হয়নি। তবে অবকাঠামোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পৃথিবীর উপরিকাঠামোগত উন্নয়ন কিন্তু সমানভাবে হয়নি। এর কারণ ওই একটাই, পুরনো চিন্তার সঙ্গে নিজেদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে রাখা। কখনো কখনো তা স্পষ্টই মানসিক রোগ হওয়া সত্ত্বেও আমরা তা ছাড়তে পারি না। আসলে, পুরনো বিশ্বাস ও চিন্তাকে আঁকড়ে ধরে রাখাটা হলো এক ধরণের আসক্তি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভয়, শ্রদ্ধা, সমীহ এসব মানসিক ইস্যুর মিশ্রণ থাকে বলে এমন মানসিক রোগগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদেরকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়, কিন্তু আমরা মানতে তো চাই-ই না, বুঝতেও চাই না। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এমন আচ্ছন্নতার চরম অবস্থাকে বলে অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার (ওসিডি)। আমার অস্তিত্ব, শক্তি, সামর্থ্য ও মর্যাদাই শ্রেষ্ঠ; আমার কিংবা আমাদের চিন্তা, মত, পথ ও বিশ্বাসই শ্রেষ্ঠ; আর তা রক্ষার্থে ও আরও উচ্চকিত করতে যা করা দরকার তা করতেই হবে; এমনকি প্রাণের বিনিময়ে হলেও। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এমন কালো ও অধরা অন্ধকারে ঢেকে আছে প্রায় পুরো পৃথিবীর উপরিকাঠামো। কোথাও আলো জ্বলে তো আরেক অন্ধকার এসে তা আবার ঢেকে দেয়। কারণ নতুনকে মেনে নিতে আমাদের ভয় ও শঙ্কা।
আর ভূমিকা নয়; চলুন লেখার মূল অংশে যাওয়া যাক। ৫ তারিখে বুয়েটের ছাত্র আবরার হত্যাকাণ্ডের বিচার আদালতে উঠবে। সেই সূত্র ধরেই আজকের লেখা। লেখার শিরোনাম দেখে অনেকে হয়তো ভাববেন, এ আবার কেমন কথা(?) অপরাধীদের পক্ষে কাজ করা যায় নাকি! কারণ, আমাদের পুরনো একটা লোকতত্ত্বানুযায়ী—যে অপরাধীদের হয়ে কাজ করে, সেও অপরাধী। তবে, আমাদের কিন্তু আরেকটি লোকতত্ত্বও আছে যা বলছে— অপরাধকে ঘৃণা করো, অপরাধীকে নয়। আমরা কাজ করবো দ্বিতীয় লোকতত্ত্বটি নিয়ে। প্রথম তত্ত্বটা যেমন সত্য; দ্বিতীয় তত্ত্বটা তার চেয়েও বেশি সত্য, মহৎতম ও অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। হতে পারে সমাজ বদলের অনেক প্রতিষ্ঠিত উপায় ও ধারণার চেয়েও অনেক বেশি প্রভাবশালী। এবার জানা যাক কিভাবে কাজ করা যায় অপরাধীদের পক্ষে। তা হতে পারে দুই ভাবে। এক, বর্তমানে যারা অপরাধী তাদেরকে অপরাধ জগত থেকে বের হয়ে আসার পথ দেখিয়ে; দুই, বিভিন্ন অপরাধের সব উৎস ও কারণের মূলোৎপাটন করে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য অপরাধীদেরকে সুপথে ধাবিত হওয়ার সকল ব্যবস্থার বন্দোবস্ত করে দিয়ে। কিন্তু পরেরটা কি সম্ভব? আমরা কিভাবে জানব আগামীর অপরাধী কারা হবেন এবং কোন অঞ্চলে বা সমাজে তারা জন্ম নেবেন? তা কি বলা সম্ভব? আমাদের উত্তর হলো—হ্যাঁ, সম্ভব। আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি জনসংখ্যা-বিজ্ঞানী স্যার টমাস ম্যালথাসের কথা। তিনি বলেছিলেন, যেহেতু জনসংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে আর খাদ্যোৎপাদন বাড়ে গাণিতিক হারে, সেহেতু ২০০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা দ্বিগুণ হবে এবং বিশাল খাদ্য সংকট দেখা দেবে। বিশেষ করে তিনি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো নিয়ে বেশি শঙ্কায় ছিলেন। এখনতো ২০২০ সাল। তৃতীয় বিশ্ব থেকে যদি বাংলাদেশের কথা ধরি; জনসংখ্যা সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলেও খাদ্য সংকট তো নেই-ই । তবে কি ম্যালথাস ভুল বলেছিলেন? না, ম্যালথাস ভুল বলেননি। আসলে ম্যালথাসের ভবিষ্যদ্বাণী বিশ্লেষণ করে কাজ করা হয়েছে বলেই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে; পৃথিবীতে কৃষিবিপ্লব ঘটেছে; দূর হয়েছে খাদ্যসংকট। জনসংখ্যাতত্ত্ববিদদের মতো সমাজবিজ্ঞানী/অপরাধবিজ্ঞানীরাও বলে দিতে পারেন যে আগামী পঞ্চাশ/একশো বছর পরে পৃথিবীর সামাজিক অবস্থা কোন দিকে যাবে। কোন ধরণের অপরাধ বিরাজ করবে এবং কারা হবেন অপরাধী।এ
এবার চলুন আমাদের এক নম্বর উপায়ের কথায় যাই। এর একটা সহজবোধ্য ব্যাখ্যা দেওয়া যায় এই সময়ের আলোচিত আবরার হত্যাকাণ্ড দিয়ে। আমরা জানি, গতবছর ৭ অক্টোবর বুয়েটের আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল বুয়েটেরই ২৫ জন ছাত্র। আবরার যেমন তাদের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার; এ হত্যাকারীরাও তেমনি মানব মস্তিষ্কের তড়িৎ, অদ্ভুত ও নেতিবাচক আচরণ বা কুমতির শিকার। এদের কেউই পেশাদার খুনি নন, দাগী আসামী বা মাস্তান নন, বর্বরও নন। কিন্তু এক রাতের তড়িৎ অমানুষিক কাণ্ড তাদেরকে সারাদেশে মাস্তান, বর্বর, খুনি ও অমানুষ হিসেবে পরিচিতি দান করে। অথচ আবরারের বাবা-মায়ের মতো এই অপরাধীদের প্রত্যেকের বাবা-মাও অপেক্ষা করছেন ছেলে কবে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বাড়ি ফিরবে, সংসারের হাল ধরবে, সব স্বপ্ন পূরণ করবে এমনসব চিন্তা মাথায় নিয়ে।
আবরার হত্যার বিচার হোক এটা দেশবাসীর দাবী। এক বছর হয়ে গেল এখনো কেন হচ্ছে না, এই তাদের অভিযোগ। কিন্তু প্রচলিত আইনে বিচার হলে আমরা যে ২৫জন ইঞ্জিনিয়ার হারাবো এটা কি ভেবেছি? আমরা কি ভেবেছি আবরারের মা-বাবার মতো আরও ২৫ জোড়া মা-বাবার আর্তনাদে বাংলার বাতাস ভারী হয়ে উঠবে? আমরা কি ভেবেছি খুনের বদলে খুন আসলে উত্তম সিদ্ধান্ত নয়? আচ্ছা, তাহলে এই যে বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন দেশে খুনের বদলে খুন (ফাঁসি বা মৃত্যুদণ্ড) দিয়ে বিচার হচ্ছে তা কি মানবোচিত এবং সুচিন্তিত নয়? আমাদের উত্তর—না। তাহলে কী হতে পারে এমন গুরু পাপের শাস্তি?
আসুন সে কথায় যাই। আমাদের গ্রামে একজন দার্শনিকের জন্ম হয়েছিল। তিনি ক্ষণজন্মা। তার সহযোগিতা নিয়ে আমি তার সাথে একবছর এসএম হলে ছিলাম। চাঁদনী রাতে এসএম হলের ছাদে তার সাথে আমরা অনেকে আড্ডা দিতাম। তার নতুন নতুন কথা শুনে আমরা চমকে যেতাম। তিনি একদিন বললেন—মানুষ নামক প্রাণিটি পৃথিবীতে তাদের আত্মপরিচয় দেয় আজ থেকে একশো ত্রিশ হাজার বছর আগে। এর মধ্যে কত বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ আসলো আর গেল, কিন্তু আইনস্টাইন পেলাম মাত্র একজন। তাহলে পৃথিবীর বদল হবে কিভাবে বলো? আরেকদিন তিনি বললেন—ফাঁসী হলো সেই সময়ের সমাজবিজ্ঞানীদের একটা স্থূল ও তড়িঘড়ি চিন্তার ফসল। তার এমনসব কথা শুনে আমরা থ হয়ে চুপ থাকলেও পরে ভেবে দেখতাম যে তার কথাগুলো নতুন, সুন্দর এবং বেশ যৌক্তিক। তিনি অনেক বড় বড়, ভারী ভারী বই পড়তেন। তার দেখাদেখি আমিও একদিন একটা বড় ও ভারী বই কিনলাম। বইটার নাম—অল দ্যা কিংস ম্যান, লেখক-রবার্ট পেন ওয়ারেন যিনি ১৯৪৭ সালে এ বইয়ের জন্য পুলিৎজার পুরস্কার পান। ১৯৪৯ সালের উপর করা হলিউডের ছবি পায় বেস্ট চলচ্চিত্রের অস্কার; ২০০৬ সালে যা আবার চলচ্চিত্রের রূপ পেয়েছিল। বইটা একটা রাজনৈতিক উপন্যাস। কিন্তু আজ থেকে প্রায় বাইশ-তেইশ বছর আগে পুরো বইটা শেষ করে আমি যা বুঝেছিলাম—তা কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়; বরং অনেকটা সামাজিক ও মানবিক। এই বইয়ের যে সারাংশ আমি পেয়েছিলাম তা এমন—পৃথিবীতে সব প্রাণির মতো মানুষও আসে বাঁচতে। আর বাঁচতে গিয়ে সে ক্রোধ, হিংসা, লোভ, কাম ও দম্ভের মতো অন্ধকারের তাড়নায় তাড়িত হয়। তাই সে প্রায়শই অমানুষের মতো আচরণ করে। এসব অন্ধকারের গহীনে তার ভিতরে থাকে ত্যাগ, ধৈর্য, সততা ও উদারতার মতো কিছু আলোচ্ছটা। কিন্তু এই আলোচ্ছটাগুলোকে চর্চা করে করে বড় আলোয় রূপান্তরিত করতে হয়, নতুবা এরা ওই গহীনেই চাপা পড়ে থাকে। এই যে চর্চা করে করে বড় করার উপায় তা-ই হলো শিক্ষা। এটা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার মতো কোনো টেকনিক্যাল শিক্ষা নয় বরং সামাজিক ও মানবিক শিক্ষা।
যাইহোক আমার দেখা সেই ক্ষণজন্মা দার্শনিকের চর্চা করতে করতে বড় করা শিক্ষার আলোকে যদি বলতে যাই, তবে আবরার হত্যাকাণ্ডের একটি চমৎকার মানবীয় বিচারের কথা বলা যায়। আর তা হলো—ওই পঁচিশজনকে ফাঁসি দিয়ে খুন না করে আবরারের বিকল্প হিসেবে এদের সবাইকে আবরারের মা-বাবার দত্তক পুত্র হিসেবে আইনি নোটিশ দেওয়া। এরা আজীবন রাষ্ট্রের তদারকিতে থাকবে; পড়াশুনায় ফিরে যাবে এবং আন্তরিকভাবে আবরারের মা-বাবাকে তাদের মা-বাবা হিসেবে গ্রহণ করবে, পাশাপাশি আপন মা-বাবাও যে থাকবেন তাতো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এদের উপার্জনের চল্লিশ শতাংশ পাবে নিজেরা, ত্রিশ শতাংশ পাবে আবরারের মা-বাবা এবং বাকি ত্রিশ শতাংশ যাবে সরকারি কোনো উন্নয়ন খাতে। আবরারের মা-বাবা চাইলে তাদের প্রাপ্ত টাকা দিয়ে আবরারের নামে বড় কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বানাতে পারেন বা দেশের কোনো কাজে লাগাতে পারেন।
ফাঁসি দিলে তো সব শেষ হয়ে গেল। এ সিদ্ধান্তটা নিঃসন্দেহে তার চেয়ে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। বলা দরকার যে—প্রথমদিকে বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগ মিলে শুধু আবরার হত্যাকাণ্ডের মতো বিশেষ বিশেষ ঘটনাগুলোর জন্য এমন যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত মানবীয় আলোর প্রেক্ষিতে প্রত্যেক আইনেরই পরিবর্তন দরকার। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলমান এসব আইনকানুনের বেশিরভাগই ব্রিটিশদের হাতে বানানো; যারা সেইসময় চালাকি চালিয়াতি করে সারা পৃথিবী চষে বেড়িয়েছে। কিন্তু এখন ঐসব চালাকি চালিয়াতিকে কেউ প্রশ্রয় দেবে না, কারণ হলো শিক্ষার প্রসার।
এবার আসুন ব্রিটেনের সেই সময়ের একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক ও দার্শনিকের উদাহরণ টানি, যার প্রকাশিত এসেইজ (১৫৬৩) নামক গ্রন্থ তাকে অনেক পরিচিতি দিয়েছিল। তিনি হলেন ফ্রান্সিস বেকন, যিনি তার মা-বাবার কর্মসূত্রে ঐতিহ্যগতভাবে রাজপরিবারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৬১৩ সালে ব্রিটেনের এটর্নি জেনারেল নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি একবার রাণীকে খুশি করার জন্য তার অন্তরঙ্গ এক বন্ধুকে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি দিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হন। অর্থাৎ আইন সেইসময় থেকেই আপনগতিতে চলার কথা থাকলেও তা চলেনি, চলতে পারেনি; এমনকি একজন দার্শনিকেরও নৈতিক স্খলন ঘটেছিল। তাই আইনেরও আগে দরকার ব্যক্তিগত জীবনাচার, সামাজিকতা ও সামাজিক চাহিদার ইতিবাচক পরিবর্তন যা উপরে বর্ণিত ঐ আলোচ্ছটাগুলোর চলমান চর্চার মাধ্যমে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে; শেষে স্থায়ী রূপ পায়। তাই অতীতের শাস্ত্র, তন্ত্র, মন্ত্র বা কারো দর্শনকেই চিরন্তন ধরে নিয়ে আগানো যাবে না। হতে পারে মানবীয় গুনের পর্যায়ক্রমিক চর্চার ফলে এর চেয়ে সুচিন্তিত ও সুন্দর চিন্তা কোথাও-কারো কাছে জমা হয়ে আছে যা আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে। যদি খুঁজে পাওয়া যায় তবে ওই উজ্জ্বলতা অনুযায়ী আইন ও বিচারব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে মানবতাকে এগিয়ে নিতে হবে তবেই অপরাধ তলে পড়ে যাবে। এরূপ পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন ও পরিমার্জনের ফলে এমন একদিন হয়তো আসবে, যখন সমাজে আর অপরাধী খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এবার আসি উপরে বর্ণিত দ্বিতীয় উপায় অর্থাৎ ভবিষ্যতের অপরাধীদের রক্ষা করার কথায়। এ পর্বটা অনেক বড় আলোচনার দাবী রাখে; এখানে যা সম্ভব নয়। তাই সংক্ষেপে বলছি–দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্যমান বিভিন্ন অপরাধের সব উৎস ও কারণের মূলোৎপাটন করে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য অপরাধীদেরকে সুপথে ধাবিত করতে হলে দরকার হবে ধারাবাহিক গবেষণার। আরোহী ও অবরোহী অনুধ্যানের সংযোগে এই কার্যক্রম গবেষণার লক্ষ্যদল হবে একযোগে দেশের কিছু নির্বাচিত অঞ্চলের এক বছরের শিশুদের প্রজন্ম, চতুর্থ শ্রেণির প্রজন্ম, সপ্তম শ্রেণির প্রজন্ম, নবম শ্রেণির প্রজন্ম এবং এইসব প্রজন্মের শিশুদের মা-বাবা ও শিক্ষক সম্প্রদায়। এদের সবাইকে ত্যাগ, ধৈর্য, সততা, উদারতার মানবীয় গুণ চর্চা করার শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি ক্রোধ, লোভ, কাম, হিংসা ও দম্ভের মতো স্থিত সমস্যাগুলো মোকাবেলা করার কায়দা জানার প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। বাৎসরিক মূল্যায়নের মাধ্যমে যদি দশ বছরের এমন একটা প্রকল্প নেওয়া যায় তবে এর ফলাফলের ভিত্তিতে প্রকল্পকে আরও বাড়ানো হবে। এভাবে ত্রিশ বছরের টার্গেট নিলে দেখা যাবে ত্রিশ বছর পর —“আগের লাঙ্গল যেভাবে যায়, পিছনের লাঙ্গল সেভাবেই যায়” এই লোকতত্ত্বানুযায়ী পরিমার্জন হয়ে আরও আরও ভালো মানুষের প্রজন্ম আসতে থাকবে। পরবর্তীতে এই প্রকল্পকে বিশ্বব্যাপী একশো বছরের জন্য বাড়িয়ে নেওয়া হবে। এর ফলে ভবিষ্যতের প্রজন্ম বিভিন্ন অপরাধের মুখোমুখি হলে অতি সহজেই তারা তা মোকাবেলা করতে পারবে; আর অপরাধ যদি না হয় তবে শাস্তির তো প্রশ্নই আসে না। অর্থাৎ এই মডেল অনুযায়ী আমরা ভবিষ্যতের সম্ভাব্য অপরাধীদেরকে এভাবে রক্ষা করতে পারবো।
তবে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৃথিবীর সবদেশে একযোগে না চললে এই বিশ্বায়নের যুগে তা কার্যকর করা কঠিন হবে। কারণ অতিশীঘ্রই ইন্টারনেটের বদৌলতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সব সংস্কৃতি একীভূত হয়ে যাবে। এটাকে এই প্রকল্পের জন্য একটি সুযোগ হিসেবে নিয়ে এর আলো পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হবে। ঠিকমতো চলতে থাকলে পৃথিবীব্যাপী যদি আলোকিত মানুষদের প্রজন্ম আসতেই থাকে, তবে এমন এক সময় আসবে যখন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস, দুর্নীতি, খুন, ধর্ষণসহ সব অপরাধ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। সেই পর্যন্ত যেতে হয়তো শত শত বছর লেগে যাবে, কিন্তু হবে নিশ্চিত। তাই কার্যক্রম যত আগে শুরু করা যায় ততই ভালো। এখানে উল্লিখিত দুটি মডেলই সবার মঙ্গলকে বিবেচনায় রাখে। এর প্রথমটিকে আমরা বলছি আরআরএম অব ক্রাইম প্রিভেনশন এবং দ্বিতীয়টাকে বলছি আরআরইউএম অব ক্রাইম প্রিভেনশন। আর দু’টোকে একসাথে বলছি আরআরএইউএম (রাশেদ রাফি অল্টারনেটিভ এন্ড আল্টিমেট মডেল অব ক্রাইম প্রিভেনশন। কার্যক্রম গবেষণায় সফলতা এলে এ মডেল দু’টিকে তত্ত্বে রূপ দেওয়া হবে।
লেখক: প্রধান নির্বাহী, ফুল-পাখি-চাঁদ-নদী রিসার্চ এন্ড এডভোকেসি ফোরাম