Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, পক্ষান্তরে টু’জি ও সার্ভার বিড়ম্বনা


৫ জানুয়ারি ২০২১ ১৪:১৩

মানুষ একসময় প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল ছিল। কৃষি ও হস্তশিল্পকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতো মানুষের অর্থনীতির চাকা। উৎপাদন প্রক্রিয়া ও পরিমাণ ছিল সীমিত। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে বাষ্পীয় ইঞ্জিন তৈরির ফলে প্রথম শিল্প বিপ্লব ঘটে। এর ফলে উৎপাদন ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়। কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা কমে আসে। তারপর ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ আবিষ্কারের ফলে উৎপাদন শিল্পের পাশাপাশি মানুষের সার্বিক জীবনযাপনে আমূল পরিবর্তন লক্ষিত হয়। এটি দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব নামে অভিহিত ছিল। অতঃপর ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেট উদ্ভাবনের ফলে বৈশ্বিক উন্নয়নের পালে নতুন হাওয়া বইতে থাকে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে অভাবনীয় পরিবর্তন সাধিত হয়। পৃথিবী ছোট হয়ে আসে। মানুষের সাথে মানুষের মিথস্ক্রিয়া বাড়তে থাকে। কম্পিউটার ও ইন্টারনেট প্রযুক্তির উৎকর্ষতা পুরো বিশ্বকে মানুষের হাতের মুঠোয় নিয়ে আসে। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে খুব সহজেই যোগাযোগ করা যায়। সময়ের পরিক্রমায় এ থেকেই উদ্ভব হয় বিশ্ব গ্রাম নামক প্রবঞ্চকটির। অর্থাৎ, পুরো বিশ্ব একটি গ্রামে রূপান্তরিত হয়। বিখ্যাত দার্শনিক হার্বাট মার্শাল ম্যাকলুহান প্রথম বিশ্ব গ্রামের ধারণা দেন। তবে এখানেই থেমে না থেকে পৃথিবী এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পথে হাঁটছে। অবশ্য অনেকটা পথ অতিক্রমও করেছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জনক ধরা হয় ক্লাউস সোয়াবকে। তিনি তার ‘দ্যা ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভ্যুলেশন’ গ্রন্থে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আলোচিত প্রযুক্তি হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ম্যাশিন লার্নিং, উন্নতমানের রোবটিকস ও অটোমেশন, ইন্টারনেট অফ থিংস, থ্রিডি প্রিন্টিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, শক্তিশালী জিন প্রযুক্তি ইত্যাদি বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেন।

তবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পূর্বাপর শর্ত হলো ইন্টারনেটের পর্যাপ্ততা ও সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা। আমার মনে হয় বাংলাদেশ এদিক থেকে এখনো নাজুক পরিস্থিতিতে রয়েছে। বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে ইন্টারনেট সার্ভিস এখনও সহজলভ্য নয়, বরং বহুল সমস্যা কবলিত। আমি গ্রামের সন্তান। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি—আমি যে ঘরটিতে থাকি সেখানে অধিকাংশ সময় সাধারণ মোবাইল নেটওয়ার্ক থাকে না। মাঝে মাঝে টু-জি’র সিগনাল আসে।এতে করে কল দেওয়া বা রিসিভ করা গেলেও কথা ঘরের বাইরে গিয়ে বলতে হয়। কখনই থ্রি-জি ও ফোর-জি দেখা মেলে না। আর যখন নেট চালাতে হয় তখন বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের পথ হেঁটে নদীর ধারে ফাঁকা ও উঁচু একটি জায়গা আছে ওখানে গিয়ে নেট চালাই। এটা হলো বাংলালিংক, গ্রামীণফোন এবং রবি নেটওয়ার্কের আত্মজীবনী। এয়ারটেল এবং আমাদের দেশীয় সিম টেলিটকের নেটওয়ার্ক সার্ভিসের আত্মজীবনী বলতে গেলে পুরোদস্তুর একটি শোকগীতিতে পরিণত হবে। এই যদি হয় আমাদের ইন্টারনেট প্রাপ্তির মান তাহলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের স্বপ্ন আমরা কিভাবে দেখতে পারি? ভিডিও কলে কথা বলার সময় প্রায়ই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শহরগুলোতে ইন্টারনেট সুবিধা ভালো থাকলেও গ্রামগুলোতে এর বিপরীত চিত্র দেখা যায়। গাছে উঠে, উঁচু বা ফাঁকা জায়গা ছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায় না এমন অসংখ্য গ্রাম রয়েছে। এতে এসব এলাকায় বসবাসরত জনসাধারণের বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়।ফলে গ্রামীণ মানুষের নাগরিক সুযোগ সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বৈষম্য ও অসমতা সৃষ্টি হচ্ছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দিকে ধাবমান তখন আমরা তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জনে সমতা আনয়ন করতে পারিনি। শহর ও গ্রামে এখনো ব্যাপক ব্যবধান বিদ্যমান। অন্যদিকে, ভিনদেশি সিম ( গ্রামীণফোন, বাংলালিংক) কোম্পানিগুলো বাজার দখল করে আছে। যার ফলে যাচ্ছেতাই কলরেট ও ইন্টারনেটের দাম নির্ধারণ করে কোটি কোটি টাকা লুফে নিচ্ছে। অথচ উচিত ছিল এই বাজার টেলিটকের হাতে থাকা। বিগত বছরগুলোতে আমরা দেখলাম একটি সিম কোম্পানি ঠিকমতো কর পরিশোধও করে না। মামলা করে বাংলাদেশ সরকারকে সেই করের টাকা তুলতে হচ্ছে।
শহুরে কিছু মানুষ ছাড়া গ্রামের কেউ টেলিটক (দেশীয় কোম্পানির) সিম ব্যবহার করে না। কিন্তু কেন? আমাদের নিজ দেশীয় সিম কোম্পানি থাকতেও সিংহভাগ মানুষ কেন বিদেশি কোম্পানির সিম ব্যবহার করে? এজন্য প্রচার-প্রচারণার অভাব, দুর্বল নেটওয়ার্ক সুবিধা, পর্যাপ্ত নেটওয়ার্ক স্টেশন না থাকা ইত্যাদি দায়ী।

এছাড়া আমরা সার্ভার জ্যাম এই শব্দটির সঙ্গে বেশ পরিচিত। গত ঈদের সময় তিন জনে মিলে পাঁচ দিনের চেষ্টায় ট্রেনের তিনটি টিকিট কাটতে সক্ষম হয়েছিলাম। তবে বাড়িতে বসে কাটা সম্ভব হয়নি। বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে উঁচু ও ফাঁকা জায়গা বেছে নিতে হয়েছিল। তারপর পাবলিক পরীক্ষার রেজাল্টগুলোর সময় একটি রেজাল্ট দেখতে দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমে যায়। প্রায়শই চাকরির আবেদনের শেষ তারিখে সার্ভার জ্যামের কারণে আবেদন করা যায় না। এসব আমাদেরকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদতা ও দৈন্যতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

নতুন দশকে পা রাখছে বিশ্ব। অনেকে এই দশককে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দশক বলছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির এই বিপ্লবকে মোকাবিলায় এবং সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলাতে চাইলে আমাদেরকে অবশ্যই ইন্টারনেট প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সমতা আনতে হবে। সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। গ্রামাঞ্চলে পর্যাপ্ত নেটওয়ার্ক স্টেশন স্থাপন করতে হবে। মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সংযুক্তিতে বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করতে হবে। কলরেট ও ইন্টারনেটের দাম কমাতে হবে। নইলে এই পশ্চাৎপদ অবস্থা থেকে উত্তরণ কঠিন হয়ে পড়বে।

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর