Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রেল দুর্ঘটনা এড়াতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি


৬ জানুয়ারি ২০২১ ১৮:১২

ট্রেন ভ্রমণ খুবই উপভোগ্য এবং আরামপ্রদ। তুলনামূলক সস্তা ও নিরাপদ বাহন হওয়ায় অনেক মানুষ ট্রেনে ভ্রমণ করেন। ট্রেন ভ্রমণে সড়কপথের মতাে যানজটের ভোগান্তি না থাকায় যাত্রীদের ভিড় দেখা যায়। যদিও ট্রেনকে বাংলাদেশে একটি নিরাপদ বাহন হিসেবে মনে করা হয়, কিন্তু এর ঝুঁকির দিকগুলোও কম নয়। বাংলাদেশের প্রতিদিন অনেক মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন ট্রেনে যাতায়াত করে। অন্য বাহনের তুলনায় দুর্ঘটনা কম হওয়ায় ট্রেনে যাত্রীদের ভিড় লেগে থাকে। ট্রেনের বগিগুলো ভরপুর করে ছাদ কিংবা ট্রেনের সামনের অংশেও মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা যায়। তবুও বড় কোনো ট্রেন দুর্ঘটনার কথা এতোটা শোনা যায় না।

বিজ্ঞাপন

রেলওয়ে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে ২ হাজার ৯০০ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে বাংলাদেশের রেল পরিবহন ব্যবস্থার সিংহভাগ পরিচালনা করে। তবে এর পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোরও অংশগ্রহণ রয়েছে। এসব ট্রেনের দুর্ঘটনা সচরাচর ঘটে থাকে। এর পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। উইকিপিডিয়া সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ধারণা করা হয় যে বাংলাদেশে ঘটা রেল দুর্ঘটনার ৭২ শতাংশ মানব-ত্রুটিজনিত, ২৩ শতাংশ যান্ত্রিক ত্রুটিজনিত এবং বাকি ৫ ভাগ অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং এবং যানবাহন চালক ও পথচারীদের অসতর্কতায় রেলক্রসিং পারাপারের কারণে ঘটে। মানব-ত্রুটিসমূহের মধ্যে রয়েছে লোকোমাস্টার, স্টেশনমাস্টার ও পরিচালকের ত্রুটি বা অবহেলা এবং বেপরোয়াভাবে ট্রেন চালানো। যান্ত্রিক ত্রুটি ঘটে লোকোমোটিভের ত্রুটি, ত্রুটিমুক্ত ট্র্যাক ও সিগন্যাল পদ্ধতির কারণে। ২০০৮–২০১৯ সালে লেভেল ক্রসিংগুলোয় ৩১০টি দুর্ঘটনায় ২৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৯টি দুর্ঘটনায় ১৩ জন মারা গেছেন।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি জয়পুরহাটের পুরানাপৈলে ১৯ ডিসেম্বর ট্রেন-বাস সংঘর্ষে ১২ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুসহ কয়েকজনের আহত হওয়ার ঘটনাটি উদ্বেগজনক। ঠিক একই স্থানে মঙ্গলবার (২২ ডিসেম্বর) বিকেলে চিলাহাটি থেকে খুলনাগামী আন্তঃনগর ট্রেন রূপসা এক্সপ্রেসের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এই সংঘর্ষের প্রধান কারণ রেলপথের লেভেল ক্রসিংটি খোলা, অর্থাৎ অরক্ষিত ছিল। এর আগে, ৭ নভেম্বর গাজীপুরের কালিয়াকৈর এবং ১২ অক্টোবর ফেনীতে ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যান পাঁচ জন। ১৬ অক্টোবর যশোরের অভয়নগরে ট্রেনের সঙ্গে প্রাইভেটকারের ধাক্কায় মৃত্যুবরণ করেন পাঁচ জন। সর্বত্রই এসব দুর্ঘটনার একটাই কারণ—অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং। আবার কেউ কেউ ট্রেন দুর্ঘটনার প্রধান কারণ চালকের ক্লান্তিকে দায়ী করছেন। শুধুমাত্র একটি কারণেই নয় বরং সকলের অসচেতনতার ফল এই ট্রেন দুর্ঘটনা।

বাংলাদেশ রেলওয়ের বৈধ-অবৈধ মিলে শতকরা ৮০ শতাংশ লেভেল ক্রসিং একেবারে অরক্ষিত। অনেক স্থানে লোকবলও নেই বললেই চলে। স্থানীয় জনগণই ভরসা। এমনকি রাজধানীর চারপাশের রেলপথের দুই পাশে হাটবাজার বসা লেভেল ক্রসিংগুলােও প্রায় অরক্ষিত ও অনিরাপদ। যে কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনাগুলোর প্রধান কারণ অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং, জরাজীর্ণ রেললাইন, পর্যাপ্ত সিগন্যালের অভাব, ঘন কুয়াশা ইত্যাদি। এর পাশাপাশি প্রধানত দায়ী বাংলাদেশ রেলওয়ের নিয়মিত-অনিয়মিত কর্মীদের গাফিলতি, দায়িত্বহীনতা, উদাসীনতা, সর্বোপরি ঘুষ-দুর্নীতি অনিয়ম-অব্যবস্থা ইত্যাদি। যেসব কারণে প্রায়ই ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটছে, তার মধ্যে অন্যতম হলাে—সর্বত্র ডাবল লাইন নির্মিত না হওয়া, ঝুঁকিপূর্ণ ও অরক্ষিত লেবেল ক্রসিং, দক্ষ ও যোগ্য লোকবলের অভাব, চুক্তিভিত্তিক চালক-কর্মী নিয়োগ, ঘন কুয়াশা, সর্বোপরি সংশ্লিষ্ট রেল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা। অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং, অপরিকল্পিত ও অননুমোদিত সংযোগ সড়ক এবং সচেতনতার অভাবে অকাতরে প্রাণ যাচ্ছে।

প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করেও রেল মন্ত্রণালয় রেলকে আধুনিক ও যুগোপোযোগী করতে পারছে না। প্রধানমন্ত্রী এক প্রতিক্রিয়ায় যথার্থই বলেছেন, ট্রেন দুর্ঘটনা রোধে চালকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দরকার। সম্প্রতি দুদক রেলের কেনাকাটা ও বিক্রির প্রতিটি স্তর এবং রেলের জমি ও জলাশয় ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে। রেলের কারখানাগুলোসহ সংকেত ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, নড়বড়ে রেলপথ ও ভাঙ্গা ব্রিজ সংরক্ষণ, লেভেল ক্রসিং, এমনকি ডাবল লাইন-মিশ্র লাইন নির্মাণেও ব্যাপক দুর্নীতি হয়ে থাকে। অথচ জনসংখ্যা বিবেচনায় রেলপথই হতে পারে বাংলাদেশের যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের সাশ্রয়ী, দ্রুতগামী, নিরাপদ ও আরামপ্রদ মাধ্যম। তবুও অবহেলিত রেলপথ। যার দরুন ঘটছে রেল দুর্ঘটনা।

রেল দুর্ঘটনা এড়াতে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। অরক্ষিত রেলক্রসিংগুলোতে একাধিক দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে। প্রয়োজনে আনসার বা পুলিশ মোতায়েন করা যেতে পারে। ভারী যানবাহন চলাচলকারী রেলক্রসিংগুলোতে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক মেশিন স্থাপন করা অতীব জরুরি। জনবহুল এলাকাগুলোতে ট্রেন আসার কমপক্ষে ২-৩ মিনিট আগে রেলক্রসিং বন্ধ করে দিতে হবে। প্রয়োজনে মাইকিং করে রেললাইন ক্রস করা যানবাহনগুলোকে থামাতে হবে। যেসব ক্রসিংগুলোতে ক্রসিং বার নেই সেগুলোতে জনসাধারণের নিজ দায়িত্ব পারাপার করতে হয়। সেসব ক্রসিংবারগুলোতে যেন মানুষ বা যানবাহন চলাচলের সময় সচেতন হন সেজন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নিতে হবে। দায়িত্বে অবহেলাকারীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার মাধ্যমেই যেন সব কিছু ভুলে না যাওয়া হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। দোষীদের অব্যাহতি দিলেই হবে না বরং তাদের উপযুক্ত শাস্তির মাধ্যমে শিক্ষা দিতে হবে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের নিয়মিত রেললাইন পর্যবেক্ষণ করতে হবে। চালকদের সচেতন করতে হবে এবং প্রয়োজনে নির্দিষ্ট সময় পর পর প্রশিক্ষণ দিতে হবে। রেলক্রসিংগুলোতে যেহেতু দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেশি—সেক্ষেত্রে গেটম্যানদের সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। রেললাইনের আশেপাশের গ্রামগুলোতে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে মানুষকে সচেতন করার পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে যুবসমাজও এগিয়ে আসতে পারে। প্রশাসনের পাশাপাশি তারা মানুষকে সচেতন করতে নানা ধরনের উদ্যোগ নিতে পারে। বিশেষ করে স্কুল-কলেজে রেলক্রসিং পারাপারের নিয়মাবলী শেখাতে হবে এবং এ ধরনের প্রচারণা চালানো যেতে পারে। এতে করে মানুষের মধ্যে অনেকটা সচেতনতা সৃষ্টি করা যাবে। রেললাইনের পাশে পথচলতি মানুষের জন্য সাইনবোর্ড লাগানো যেতো পারে। সেসব সাইনবোর্ডে লেখা থাকবে সতর্কতামূলক এবং আইনি কিছু পরামর্শ। সবাই সচেতন হলে ভবিষ্যতে রেল দুর্ঘটনা অনেকাংশেই কমে যাবে।

লেখক: শিক্ষার্থী

রেল দুর্ঘটনা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর