অ্যাকুয়াকালচার ৪.০ এবং বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট
১৬ জানুয়ারি ২০২১ ১৯:৪৩
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে বাংলার জেলে জীবন এবং নদীর ও মাছের প্রকৃতি পরিবর্তনের কারণে জেলে জীবনের দুর্বিষহ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণ’। বাংলা সবসময়ই মাছে ভাতে বাঙালি। তা হোক সেকালে বা একালে। তবে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জেলেদের দুর্দশা কেটেছে, প্রযুক্তি নির্ভর বাংলাদেশে স্মার্ট জেলে তৈরির তটভূমিতে দাঁড়িয়ে আরও নানা রঙের স্বপ্নে বিভোর হতে কোনো বাধা নেই আমাদের। কেননা, এদেশে আজ হয়তো একজনকেও পাওয়া মুশকিল, যে স্মার্ট বা আধুনিক মুঠোফোন ব্যবহার করে না বা তার নাগালের মধ্যে নেই। গত দুই দশকে যোগ্য নেতৃত্বের হাত ধরে দেশে প্রযুক্তির আমূল পরিবর্তন এসেছে তা অনস্বীকার্য। ২০১৮-১৯ সালের সরকারি তথ্যানুযায়ী—১৬৭ মিলিয়নের দেশে মোবাইল সাবস্ক্রাইবার ১৬১ মিলিয়ন এর বেশি যার মাঝে প্রায় ৯২ মিলিয়ন ইন্টারনেট সুবিধা পাচ্ছে। বাকিদের শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় নিয়ে আসা এবং ইন্টারনেট সংযোগ সকলের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার কাজ চলছে, তা সবার জানা।
ডিজিটাল বাংলাদেশ ইন্টারনেট চালিত আধুনিক যন্ত্রের সংযোজন এবং গবেষণার কাজ অনেক সহজ করে দিয়েছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ ইন্টারনেট চালিত আধুনিক যন্ত্রের সংযোজনা এবং গবেষণার কাজ অনেক সহজ করে দিয়েছে। দেশব্যাপী অপটিক্যাল ব্যাকবোন এবং কানেক্টিভটি কভারেজ দেশকে প্রযুক্তিতে স্বনির্ভর করছে। এছাড়াও আমাদের আছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১, যা অত্যন্ত প্রতিকুল, দুর্গম এবং দূরস্থানেও ইন্টারনেট সংযোগ নিয়ে যাচ্ছে। সিআরআই ২০১৯ এর তথ্য মতে—মোবাইল ইন্টারনেট, ওয়ারলেস ব্রডব্যান্ড, ফিক্সড ব্রডব্যান্ড এই তিন ধরনের ইন্টারনেট অধিগম্যতায় মোবাইল ইন্টারনেট পরিব্যাপ্ত প্রায় ৯২ মিলিয়ন মানুষের মাঝে, যার ৯৪% ব্যবহারকারী মোবাইল নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভরশীল। আর চতুর্থ জেনারেশনের পর বাংলাদেশ ২০১৮ সাল থেকেই পঞ্চম জেনারেশনের পরীক্ষামূলক ট্রান্সমিশন শুরু করে দিয়েছে যার সুফল সকলের হাতে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগবে না। এই গোড়াপত্তনের ফলে বাংলাদেশের যে কোনো ব্যক্তি দেশের যে কোনো প্রান্তে বসে উন্নত দেশের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার সাহস করতে পারে।
স্মার্ট কৃষির ধারণা হয়তো ইতিমধ্যে অনেকের কাছেই স্পষ্ট। বাংলাদেশের প্রথম স্মার্ট-কৃষির আবির্ভাব হয় সেন্টার ফর রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট (সিআরআই) এর প্রকল্প দেশীয় বৈজ্ঞানিকদের প্রযুক্তি ই-ভিলেজ এর মাধ্যমে, যেখানে কৃষকেরা তাৎক্ষণিকভাবে মাঠের অবস্থা জেনে যাবে মুহূর্তে এবং সিদ্ধান্তহীনতায় না ভুগে করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা পাবে মুঠোফোনের মাধ্যমে ঘরে বসেই। মৎস্যক্ষেত্রের অতীত অবস্থার কথা বলতে গেলে এমন এক সময় ছিল যখন মানুষকে পুকুরে মাছ চাষের বা অ্যাকুয়াকালচারের কথা বললে অবাক হতো। বলছি আশির দশকের গোঁড়ার দিককার সময়ের পরিস্থিতি। আর সেই বাংলাদেশই আজ সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্বে মিঠা পানির মাছ আহরণে তৃতীয় এবং অ্যাকুয়াকালচারে পঞ্চম (এফএও, ২০২০)। ইঙ্গিতপূর্ণ এ তথ্যই বলে দেয় তথ্য প্রযুক্তির আগমনটা ভবিষ্যতের জন্য আশীর্বাদ হতে যাচ্ছে।
২০০৭-০৮ সালে সকল খাতে মোট মৎস্য উৎপাদন ছিল ২৫.৬৩ লাখ মেট্রিক টন যা গত এক দশকে ৫.২৬% হারে এবং গত ৪ বছরে ৬.২২% হারে বেড়ে ২০২০-২১ সালে হয়েছে ৪১.৩৪ লাখ মেট্রিক টন যা বাংলাদেশকে মৎস্যখাতে ইতোমধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে।
বর্তমানের মাঠপর্যায়ের মৎস্যচাষীরা সাধারণত পুকুরে অক্সিজেনের ঘাটতি, অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার সরবরাহ করা, মাছ চুরি যাওয়া, শত্রুতার রেশ ধরে বিষ ঢেলে মাছ মেরে ফেলা ইত্যাদি বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে যা কম্পিউটার বিজ্ঞানের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি)-এর তাৎক্ষণিক তথ্য প্রদানের মাধ্যমে ঘরে বসে সমাধান করা সম্ভব। তখন মাছের পুকুরের যে কোনো সমস্যায় অপেক্ষা করার বা পানির নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করিয়ে সমাধান জানার জন্য কালবিলম্বের প্রয়োজন হবে না।
বাজারজাতকরণ পর্যায়ে ফেইসবুকের মতো বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা ওয়েবসাইটের ব্যবহার শুরু হয়েছে ইতিমধ্যে। মোবাইল অ্যাপের ব্যবহারও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের বেশ কিছু মোবাইল অ্যাপ যেমন: চিংড়ি, বিডি ফিসপিডিয়া, রূপালী, ফিস বাংলা, বাংলা ফিসিং বেইটস ইত্যাদি সাহায্য করছে মৎস্যচাষীদের। এছাড়া বিদেশি কিছু প্রতিষ্ঠান যেমন—কানাডাভিত্তিক এক্সপার্ট সি বাগদা চিংড়ি ঘেরে পরীক্ষামূলক প্রযুক্তি অভীক্ষণ শুরু করতে যাচ্ছে শীঘ্রই। সবচেয়ে আশাজাগানিয়া ব্যাপার হচ্ছে বিদেশি নয়, খাঁটি দেশীয় গবেষকরা ইন্টারনেট অভ থিংস, আরটিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেশিন লার্নিং ইত্যাদি ব্যবহারের মাধ্যমে মাছচাষের নানাবিধ সমস্যার সমাধান বের করার কাজ করছে। এর ফলে সহজেই বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছ উৎপাদন বাড়ানো, উৎপাদন খরচ কমানো, রফতানি বৃদ্ধিকরণ, মাছের গুণগত মান বজায় রাখা, বন্য আহরণের ক্ষেত্রে ওভারফিশিং নিয়ন্ত্রণ করা থেকে শুরু করে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি সংরক্ষণ করাও সম্ভব।
অক্সফামের প্রতীক প্রকল্পের মাধ্যমে শ্যামনগর, সাতক্ষীরার চিংড়ি চাষিরা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে রোগ নির্ণয় এবং করণীয় সম্পর্কে জানছে সহজেই।
প্রযুক্তির প্রবেশ একদিকে চাকরি বাজারে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি গবেষণার এক নতুন দোয়ার উন্মোচিত করবে। সময়োপযোগী পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত, যেমন-মৎস্য উৎপাদন নীতি, মা ইলিশ সংরক্ষণ, সচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদি এবং বাংলার পরিশ্রমী ও মেধাবী বিজ্ঞানীদের নানা গবেষণা সৃষ্টিকর্ম বাংলাদেশের মৎস্যখাতকে প্রতি বছর গড়ে ৫.২৬% করে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে (মৎস্য পরিসংখ্যান ২০১৭-১৮) যা বিশ্বে মৎস্য উৎপাদন হারে ২য়। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ মৎস্যবিভাগ ২০২০-২১ সালে লক্ষ্যমাত্রা ৪.২ থেকে ৪.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টনে উন্নীত হওয়ার আশা করছে।
মৎস্যখাতে বাংলাদেশ সামনের দিনগুলোয় নেতৃত্ব দিতেও প্রস্তুত।
স্ট্যাটিস্টা ২০২০ তথ্যমতে বিশ্বব্যাপী আধুনিক কৃষি যন্ত্র ২০২৪ সালে প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে যাচ্ছে (বিজনেসওয়্যার, ২০১৭)। মহামারির এ সময়ই আমাদের উপলব্ধি করিয়েছে যে, ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার ছাড়া সামনের দিনগুলোতে এগিয়ে যাওয়া কতটা মুশকিল। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের মৎস্যখাতকে আরও এগিয়ে নিতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা চতুর্থ কৃষি বিপ্লব বা চতুর্থ মৎস্য বিপ্লব-এর সঠিক বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞের যেমন—তথ্য প্রযুক্তিবিদ, মৎস্যবিদ, বাস্তুসংস্থানবিদ, নীতিপ্রণেতা ও সর্বোপরি প্রান্তিক ব্যবহারকারীদের দলগত কাজ এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টাই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যপূরণে সহায়ক হবে এবং আগামী বাংলাদেশ একটি উন্নত বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।
লেখক: রিসার্চ ফেলো, ইউনিভার্সিটি পুত্রা মালয়েশিয়া (ইউপিএম)