Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সিরাজুল আলম খান; ইতিহাস বিকৃতি ও কিছু জবাব


১৮ জানুয়ারি ২০২১ ১৮:৩৬

সম্প্রতি অনলাইনে সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে কিছু চরম মাত্রায় ইতিহাস বিকৃতি দেখা যাচ্ছে। এসব বিতর্কের অবসান হওয়া জরুরি। আমরা প্রায়ই বিভিন্ন সংবাদপত্র কিংবা মিডিয়ায় দেখে থাকি দেখা যায় বিতর্কিত ব্যক্তিরা বঙ্গবন্ধুকে খাটো করার চেষ্টা করছেন। বিভিন্ন সময় অমুক তমুকের সঙ্গে তুলনা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ছোট করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে তাদের। এসব অপচেষ্টায় হয়ত সাময়িকভাবে  সত্যকে লুকিয়ে রাখা যায়, কিন্তু সত্যের জয় অনিবার্য। মিথ্যা কোনো দিন দাবিয়ে রাখতে পারে না সত্যকে। তবে এদের প্রচেষ্টায় একটা বিষয় লক্ষণীয় এখানে, তাদের তুলনার বিষয় বঙ্গবন্ধু সব সময় ধ্রুব থাকেন , বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যাদের তুলনা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হেয় করতে চান তারা সবসময় পরিবর্তনশীল। একেক সময় একেক জনের সঙ্গে তুলনা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যত মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়ায় ততই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে নির্মোহ সত্য সাক্ষ্য দেয় ইতিহাস। ইতিহাস সদর্পে সাক্ষ্য দেয়—ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুকে দাবিয়ে রাখা যাবে না।

বিজ্ঞাপন

সিরাজুল আলম খানকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপকার বলে নোংরা ইতিহাস বিকৃতিতে লিপ্ত এক শ্রেণীর মানুষ। মিথ্যাচারগুলো কী কী? আসুন ইতিহাসের আয়না দিয়ে সত্য মিথ্যা বিবেচনা করি।

অনেকে যুক্তি দিচ্ছেন—সিরাজুল আলম খান স্বাধীন বাংলার জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণ, জয় বাংলা স্লোগান, বঙ্গবন্ধু উপাধির জনক।

চলুন দেখা যাক ইতিহাস কী বলে?
জয় বাংলা স্লোগান একান্তই বঙ্গবন্ধুর। সেই ১৯৫০ সালের পর থেকে অসংখ্য ভাষণে বঙ্গবন্ধু জয় বাংলা স্লোগান দিতেন। জয় বাংলা স্লোগান মূলত বঙ্গবন্ধু নেতাজি সুভাষ বসুর জয় হিন্দ স্লোগানের অনুকরণে ছিল। নেতাজি যেমন অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতেন, বঙ্গবন্ধু সেরকম বাংলার স্বাধীনতার স্বপ্ন সেই ৬০ এর দশক থেকেই দেখতেন।

বঙ্গবন্ধু উপাধির জনক ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল হক চৌধুরী মোশতাক। তিনি শেখ কামালের বন্ধু ছিলেন। ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাময়িকীতে উনি প্রকাশ করেন সর্বপ্রথম। উনি শেখ কামালের বন্ধু ছিলেন।

স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা মূলত ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্ত ছিল। ১৯৭০ সালের ৭ জুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত ছাত্রদের এক সামরিক কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অংশ গ্রহণের কথা ছিল। ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্তে জয় বাংলা বাহিনীর একটি পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। এই লক্ষ্যে ১৯৭০ সালের ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (তৎকালীন ইকবাল হল) ১১৬ (বর্তমান ১১৭-১১৮) নম্বর কক্ষে ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমেদ, মার্শাল মনিরুল ইসলাম পতাকার পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকে বসেন। এ বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা স্বপন কুমার চৌধুরী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম, কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা শিবনারায়ন দাশ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সাধারণ সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু ও ছাত্রনেতা ইউসুফ সালাউদ্দিন আহমেদ।

বিজ্ঞাপন

পতাকার প্রস্তাবনা মূলত কাজী আরেফ দিয়েছিলেন এবং শিবনারায়ণ দাস পতাকার মাঝে মানচিত্র এঁকে দিয়েছিলেন। এক বিহারী দর্জি পতাকা সেলাই করে দিয়েছিলেন। জয় বাংলা বাহিনীর পতাকা পরবর্তীতে বাংলাদেশের পতাকা হিসেবে বঙ্গবন্ধু পছন্দ করেন।

জাতীয় সংগীত পছন্দ বা নির্বাচিত করেছিলেন বঙ্গমাতা। ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা’ ছিল ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াসের পছন্দ কিন্তু বঙ্গমাতার পছন্দ ছিল ‘আমার সোনার বাংলা’ তাই বঙ্গবন্ধু ‘আমার সোনার বাংলা’ জাতীয় সংগীত হিসেবে বাছাই করেন।

২রা মার্চ আ স ম আব্দুর রব কর্তৃক স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন, ৩রা মার্চ শাজাহান সিরাজ কর্তৃক স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, ৭ই মার্চ শেখ মুজিব কর্তৃক  “এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম”- এই ঘোষণা ছাড়াও অসংখ্য ঐতিহাসিক ঘটনায় অনেকে সিরাজুল আলম খানকে মূল প্রভাবক হিসেবে সাফাই গাইতে গিয়ে আরেক বিতর্কের সূচনা করেন।

আসলে সত্য কী?
স্বাধীনতার ইশতেহারের রচনা করেছিলেন সিরাজুল আলম খান,আবদুর রাজ্জাক তোফায়েল আহমদ, আ.স.ম আব্দুর রব মিলে। কাজেই এটা ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াসের সম্মিলিত ইশতেহার ছিল।

বঙ্গবন্ধু ৭ ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের অনেকের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। কিন্তু তিনি কী ভাষণ দেবেন তা একমাত্র তিনিই জানতেন। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা করেছেন বঙ্গমাতা আর তাজউদ্দীনের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু এ ভাষণ পুরোপুরি বাস্তবতা, তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনা করে দিয়েছিলেন কোনো লিখিত স্ক্রিপ্ট পড়ে নয়। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ এই উক্তির মাধ্যমে বাঙালিকে বঙ্গবন্ধু মুক্তিসংগ্রামের বার্তা দিয়েছিলেন।

অনেকে মিথ্যাচার করে থাকেন সিরাজুল আলম খান শ্রমিক লীগ, ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াস, বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা?

এখানে কিছু তথ্য আংশিক সত্য। যেমন পরাধীন বাংলাদেশে শ্রমিকরা যে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি সেটা সিরাজুল আলম খান বুঝেছিলেন এবং শ্রমিকদের সংগঠিত করেছিলেন তিনি। তার কারণে শ্রমিকদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা আসে এবং তারা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। সিরাজুল আলম খান শ্রমিক লীগের প্রতিষ্ঠাতা এটা সত্যই।

ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াসের মূল কারিগর মূলত কাজী আরেফ। তবে নিউক্লিয়াসের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড ছিলেন সিরাজুল আলম খান। কিন্তু ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াস কাজী আরেফ, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক,আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে একটি গুপ্ত সংগঠন ছিল।

এ বিষয়ে আব্দুর রাজ্জাকের ভাষ্য
এ বিষয়ে আবদুর রাজ্জাক এর ভাষ্য ছিল এ রকম, ‘এটা ঠিক যে আমরা নিউক্লিয়াস তৈরি করেছিলাম। চিন্তাটা হয়েছিল ১৯৬২ সালে। ১৯৬৪ সালে তার একটা কাঠামো দাঁড় করানো হয়। সিরাজ ভাই রূপকার, বিষয়টা এমন নয়। আমাদের মধ্যে কাজ ভাগ করা ছিল। সিরাজ ভাই ছিলেন আমাদের থিওরেটিশিয়ান। আমি রিক্রুটিংয়ের কাজ দেখতাম। আরেফ ছাত্রলীগের মধ্যে আমাদের চিন্তার প্রসার ঘটাত। এরপর চতুর্থ ব্যক্তি হিসেবে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয় আবুল কালাম আজাদ। আমরা আঙুল কেটে রক্ত দিয়ে শপথ নিই, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমরা ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধার পেছনে ছুটব না। বিয়ে করব না। আমাদের না জানিয়ে আবুল কালাম আজাদ স্কুলপড়ুয়া এক নাবালিকাকে বিয়ে করলে আমরা তাকে বহিষ্কার করি। মুজিব ভাইকে সামনে রেখেই আমরা এটা শুরু করি। তিনিই আমাদের নেতা। এ ব্যাপারে তাকে আমরা কিছুটা জানিয়েছিলাম ১৯৬৬ সালে। ১৯৬৯ সালে তাকে ডিটেইল জানানো হয়’। পরে অবশ্য আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ , অসম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ নিউক্লিয়াসে যুক্ত হন।

বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর প্রধান সংগঠক ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি। এর পাশাপাশি অন্যতম প্রধান সংগঠক হিসেবে ছিলেন সিরাজুল আলম খান , আবদুর রাজ্জাক,তোফায়েল আহমেদ,কাজী আরেফ ও ছাত্রলীগ এর সেসময়কার নেতৃত্ব স্থানীয়রা।

এগুলো ইতিহাসের স্বীকৃত সত্য,এসব নিয়ে মিথ্যাচার করে তারাই যারা জিয়াকে বারবার বঙ্গবন্ধুর বিপরীতে দাড় করাতে চায়। এরাই আবার তাজউদ্দীনকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে দাড় করাতে চায় ,অথচ সে চেষ্টায় ও তারা বিফল, কারণ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গতাজ অভিন্ন সত্ত্বা। বঙ্গবন্ধুকে ছোট করার প্রচেষ্টা হিসেবে তারা সর্বশেষ দাড় করিয়ে দিতে চাচ্ছে সিরাজুল আলম খানকে। বিস্ময়কর হলেও সত্যি সিরাজুল আলম খান বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার সর্বাধিনায়ক হিসেবেই মানেন। এ চেষ্টায় তারা বিফল হতে যাচ্ছে আবারও। কারণ সত্যের জয় অনিবার্য।

এটা সত্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূল সংগঠক ছিলেন সিরাজুল আলম খান। এটা অস্বীকার কোনোভাবেই করা যাবে না। কিন্তু যারা সিরাজুল আলম খানকে টেনে নিয়ে এসে বিতর্ক সৃষ্টি করতে চায় তাদের উদ্দেশ্য বোঝা যায়—এরা বাংলাদেশে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায় বারবার।

তথ্যসূত্র:
আওয়ামী লীগ: উত্থান পর্ব (মহিউদ্দিন আহমেদ)
জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি (মহিউদ্দিন আহমেদ)
আমি সিরাজুল আলম খান: একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য (শামসুদ্দিন পেয়ারা)
আওয়ামী লীগ: যুদ্ধ দিনের কথা (মহিউদ্দিন আহমেদ)

লেখক: শিক্ষার্থী, বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সিরাজুল আলম খান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর