ভ্যাকসিন নিয়ে ডাক্তারদের নীরবতা আর কন্সপিরেসি থিওরি কেন?
২৪ জানুয়ারি ২০২১ ১৫:১১
ভেবেছিলাম ভ্যাকসিন বাংলাদেশে পৌঁছার পর ডাক্তারদের মধ্যে কাড়াকাড়ি শুরু হবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ডাক্তার সমাজের বিরাট অংশে এখন শুনশান নীরবতা আর কন্সপিরেসি থিওরির ফিসফাস।
পৃথিবীর সব দেশে ভ্যাকসিনের যে অগ্রাধিকার তালিকা করা হয়েছে খুব সঙ্গত কারণেই ডাক্তারসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীরা তার শীর্ষে। ডাক্তার-নার্সরা করোনা রোগীর সরাসরি সংস্পর্শে আসেন। তারাই সমাজে সবচেয়ে ঝুঁকিতে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থারও পরামর্শ হচ্ছে এদের আগে টিকা দেওয়ার। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ যারা প্রথম দিকে ভ্যাকসিন সংগ্রহ করেছিল তাদের ডাক্তার-নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা টিকা নেওয়ার অফার পাওয়ার সাথে সাথে নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করে তাড়াহুড়া করে সবাই টিকা নিয়েছেন।
অথচ খুবই হতাশার কথা আমাদের ডাক্তার সমাজের বিরাট অংশ ‘ষড়যন্ত্র সূত্রে’ আগে ভ্যাকসিন নিতে চাচ্ছে না। এ যেন আষাঢ়ে গল্প। বিশ্বাস হতে চায় না। কেউ কেউ আবার বলছে, তাদের উপর কেন প্রথম ট্রায়াল দেওয়া হবে? আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এই আমাদের বিজ্ঞান পড়া ডাক্তারসমাজ! আমরা সবাই জানি ভ্যাকসিনের ট্রায়াল পর্ব আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন এটা ট্রায়াল নয়। পরীক্ষিত নিরাপদ টিকা। টিকা প্রস্তুতে যাওয়ার আগে বিজ্ঞানসম্মত যতো ট্রায়াল, প্রসেস সব সম্পন্ন হওয়ার পরই এই টিকা মানুষের শরীরে গিয়েছে।
আর বাংলাদেশে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন এসেছে। অক্সফোর্ড দুনিয়াজোড়া শিক্ষাদীক্ষা গবেষণা প্রোডাকশনের ব্র্যান্ডেড নাম। যুক্তরাজ্যে আজ পর্যন্ত প্রায় ৬০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। সবাই টুকটাক জ্বরজারি হওয়া ছাড়া নতুন এন্টিবডি নিয়ে সুস্থ আছে।
এন্টি ভ্যাকসিন ক্যাম্পেইন সারা পৃথিবীতেই আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডির এক ছেলেও এই মিথ্যা প্রচারণার আন্তর্জাতিক একটি গ্রুপের হোতা। অকাট্য যুক্তি প্রমাণ না থাকলেও অল্প সংখ্যক কিছু মানুষ ভিন্ন মত প্রকাশ করে। যুক্তরাজ্যে এক ঘরোয়া আড্ডায় সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত একজন বাংলাদেশি ভাই আমাকে গত বছর নভেম্বরের দিকে বলেছিল, করোনা বলে কিছু নেই। এই সব সাজানো নাটক। আমি পাল্টা কোনো আলোচনায় না গিয়ে মুচকি হেসে মনে মনে বলছি , সাইকো! এর মানসিক চিকিৎসা দরকার।
সাধারণ মানুষের খুব ছোট একটি অংশ ভ্যাকসিন নিয়ে কথা তুলবে এটাই সমাজ বিজ্ঞানের নিয়ম। আর তাদেরকে সঠিক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সত্যটা বোঝাবে এই বিষয়ে যারা বিশেষজ্ঞ তারা। এক্ষেত্রে ডাক্তাররা। অথচ আমাদের বেলায় আমাদের ডাক্তার সমাজেরই বড় একটা অংশ উল্টোটা করছে।
কোনো কিছু হলেই এই যে হাজার হাজার আওয়ামী ডাক্তার রাস্তায় থাকেন, রাজনীতিবিদের চেয়ে বড় রাজনীতিবিদ যারা, যদিও একসময় আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগ করার লোক ছিল না, তারা এখন কোথায়? সরকার সাফল্যের সঙ্গে ভ্যাকসিন নিয়ে এসে মানুষকে বিশ্বের অন্যসব দেশের মতো আগে নিরাপদ করতে চাচ্ছে, অথচ তারা এখন নিবেন না। ভাবা যায়!
আবার ভ্যাকসিন প্রায়োরিটিতে যদি অন্য কোনো পেশাজীবীদের আগে ভ্যাকসিন দেওয়া হতো তাহলেও শুরু হয়ে যেত আরেক ক্যাচাল। আমাদের ভ্যাকসিন দেয় না কেন, আমরা সম্মুখসারির যোদ্ধা হয়েও পাচ্ছি না কেন ইত্যাদি।
গত প্রায় ১০০ বছর ভ্যাকসিন পৃথিবী থেকে অসংখ্য ছোঁয়াচে রোগ মহামারি সৃষ্টি করতে এমন একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। যেমন পোলিও মাইলাইটিস। আমাদের প্রজন্ম পর্যন্ত বাংলাদেশে অনেক শিশু ছিল, যাদের পোলিওর কারণে কোমর থেকে দুই পায়ের সব মাসেল শুকনো এবং অবশ ছিল। আমার ছেলেবেলার দুইজন বন্ধু আছে এদের দলে। তারা হুইল চেয়ারে বা ক্র্যাচে ভর করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে জীবন। গত ২৫ বছর আমরা বাংলাদেশে কোনো বাচ্চাকে পোলিও হয়ে পঙ্গু হতে দেখিনি। কারণ পোলিও টিকা।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় দেশে ৩ কোটি ভ্যাকসিন লাগবে না। কারণ ডাক্তাররা অনীহা দেখালে অন্য পেশাজীবীরাও এই কু-সংস্কারকে বিশ্বাস করবে। আর সাধারণ মানুষ তো তাদের অনুসরণে টিকা দেখলেই ভেঙেচুরে দৌড় দেবে। দশচক্রে ভগবান ভুত হবার অবস্থা। ১৫ আগস্টসহ সকল দিবসে হাসপাতালের রোগী রেখে ব্যানার নিয়ে রাস্তা বন্ধ করা হাজার হাজার ভুয়া জয় বাংলার ডাক্তারদের নিয়ে কী যে বিপদে পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী!
এই লেখা ব্যক্তিগতভাবে কাউকে আঘাত করার জন্য নয়। শুভচেতনা জেগে উঠুক মানবিকতায় সেই কামনায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারভেনশন কার্ডিওলজির ডা. মোস্তফা জামান বাবুল ভাই আর ভাবীকে শুভাশিস তারা ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য রেজিস্ট্রেশন করেছেন বলে। অন্ধকারে আলোকবর্তিকা নিয়ে দিনশেষে কিছু মানুষ থেকেই যায়।
লেখক: চিকিৎসক; ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস, যুক্তরাজ্য