ওয়াজে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ ও নারী বিদ্বেষের চাষাবাস
২৪ জানুয়ারি ২০২১ ২৩:০০
আমি বাঙালি। এই বাংলাদেশ আমার জন্মভূমি। আর আমি মনে করি ‘সবার উপরে মানুষ, তাহার উপর নাই’। হোক সে যে কোনো ধর্মের, বর্ণের বা বিশ্বাসের।
বহুদিন পর বাংলাদেশে নামকরা কয়েকজন বিজ্ঞানী, গায়ক, নৃত্যশিল্পী এবং শিক্ষাবিদের আবির্ভাব ঘটেছে যারা ধর্মকে ‘জোকারি বা স্ট্যান্ডআপ কমেডি’র সঙ্গে ব্লেন্ড করার প্রাণান্তকর চেষ্টায় মেতে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়েছে দেশবাসী সম্ভবত এদের আগমনের অপেক্ষায় ছিল। নাগরিক জীবনের শত ব্যস্ততার মাঝে এদের জোকারি অনেকের কাছে অভিনব মনে হয়েছে। কারো কারো মতে, তাদের এই জোকারি প্রচলিত বিনোদনের ধরনকেও বদলে দিয়েছে। ইদানীং দেশের মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ওয়াজ! আর এ ওয়াজের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ, দেশদ্রোহিতা ও নারী বিদ্বেষকে উসকে দেওয়া হয়। কোনো বক্তার মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হয়ে ওঠেন শাশুড়ি! এসব বয়ান নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাসাহাসি (ট্রল) হয়। মাহফিলে শ্রোতাদের সামনে নিয়মিত বিরতি দিয়ে ইংরেজি ভাষায় বক্তব্য দেন কয়েকজন বক্তা।
কেউ কেউ বলছেন এসময়ের ওয়াজ টেলিভিশনের টকশো, কমেডি শো এমনকি যাত্রাপালার ‘বিকল্প’ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। টেলিভিশনের টকশো, কমেডি শো কিংবা যাত্রাপালার সাথে সওয়াব কামানোর ব্যাপারটা থাকে না কিন্তু ওয়াজের সাথে থাকে। তাই চেতন-অবচেতনে বিশ্বাসী মানুষেরা এই ‘ডিজিটাল ওয়াজে’র জগতে পা বাড়ায়। ওয়াজ শুনে প্রান্তিক মানুষদের কেউ কেউ বিশ্বাসও করতে শুরু করেছেন বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের আসল নাম এসহাক নিউটন, যিনি আসলে একজন ‘বিজ্ঞান চোর’! নিউটনের মতো আইনস্টাইনও নাকি তার আবিষ্কার মুসলমানদের কাছ থেকে চুরি করেছেন! হেলিকপ্টার একটা অস্বাস্থ্যকর বাহন তবে রকেটে চড়া কোনো ব্যাপারই নয়! অক্সফোর্ড বছর বছর এদেশের একজনকে শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মর্যাদা দেয়, নাসা (!) বার বার ওনাকে ডেকে নিয়ে যায়! সবচেয়ে ভয়ানক বিষয় হলো ধর্মীয় শিক্ষকদের নৈতিক স্খলন। প্রতিদিন সংবাদে মাদ্রাসায় ছাত্র বলাৎকার, ছাত্রী ধর্ষণের খবর পাওয়া যায়।
বিভিন্ন মসজিদে জুমার খুতবায় কোরআন-হাদিসের ভিত্তিতে সত্যনিষ্ঠ আলোচনা করার চেয়ে ব্যক্তি নিন্দা, রাজনৈতিক মতাদর্শ চর্চা, রাজনৈতিক বক্তব্য ও হুজুরদের খেদোক্তি প্রকাশই সর্বাপেক্ষা প্রাধান্য পায়। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি এক মসজিদের জুমার খুতবায় ইমাম সাহেব বয়ান করছেন ‘এই যে লাকী আক্তার, সে হলো নাস্তিক। তার এক কন্যা হইছে। মুখটা হইছে বান্দরের মতো’। গণজাগরণ মঞ্চের অগ্নিকন্যা লাকী আক্তারের পারিবারিকভাবে পরিচিত কয়েকজন নামাজ শেষে ইমাম সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন—‘আপনি কী নিজের চোখে দেখেছেন লাকী আক্তারের কন্যাকে?’
উত্তরে ইমাম সাহেব বললেন—‘হ্যাঁ, দেখেছি, তয় ফেসবুকে’।
আপনারাই বিচার করবেন আজকাল হুজুরেরা কতটুকু সত্য বলে এবং মিথ্যাচার ও গিবত এর শাস্তি বিষয়ে ইসলামের বিধান কী ফেসবুক টাইমলাইনের সুবাদে বাংলাদেশের কয়েকজন আলেমদের এলেম দানে মিথ্যাচারের ফুলঝুরি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শুধু মিথ্যাচারই নয়, সঙ্গে অল্প জানাও এর জন্য দায়ী। একজন বিশিষ্ট আলেম বলে খ্যাত বলছেন ‘দুনিয়ার সবচেয়ে বড় পয়সাওয়ালা বেলগ্রেড। আইফোনের মালিক। দেখা হয়েছে আমার সঙ্গে। আমার কাছে মনে হয়েছে টিকটিকি’। কতোগুলো মিথ্যাচার আছে এখানে? বেলগ্রেড আইফোনের মালিক নয়। বেলগ্রেড একটি রাজধানীর নাম। আইফোনের মালিকের সঙ্গে দেখা হওয়া আর তাকে টিকটিকির মতো মনে হওয়া এমন সব মিথ্যা কথা কেন বলতে হয়? আরেকজন আলেম ওয়াজে শত শত মুসল্লির সামনে বলেছেন ‘আমেরিকার সবচেয়ে বড় যে আকাশ গবেষণার কেন্দ্র নাসা। অনেকবার আমার ওখানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে নাসা বলছে, ‘Sun can rise from west instead East’। একজন ধর্মীয় স্কলার এমন মিথ্যা বলতে পারে সেটা ভাবা যায়? অন্য এক ওয়াজ মাহফিলে আরেক সমসাময়িক বিখ্যাত একজন আলেম বলছেন ‘আমি অক্সফোর্ডের তিনবার শ্রেষ্ঠ টিচার হয়েছি। আজকেই বলে ফেললাম ফট করে। এটা কেউ জানে না। আমার পরিবারও জানে না। অক্সফোর্ডের সিলেবাসেই চলে ইংল্যান্ড-আমেরিকার স্কুলগুলো’।
এইডসের জীবাণু গোল হয়, লম্বা কেন হয় না, এই থিওরির আবিষ্কারক একজন বাংলাদেশি! বিশ্বাস হচ্ছে না? তবে ওয়াজে সম্পূর্ণ ভুল ও মিথ্যা তত্ত্ব, তথ্য দেওয়ার জন্য তার মস্তিষ্ক এবং জিহ্বা জাদুঘরে রাখা উচিত।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই ওয়াজ মাহফিল শুরু করেন মাওলানা হাবিবুর রহমান যুক্তিবাদী। দেশ ও দেশের বাইরে তিনি যুক্তিবাদী হিসেবে পরিচিত। কেবল ওয়াজ করেই চলছে তার পেশাগত জীবন। যদিও তিনি মাহফিলকে পেশা হিসেবে দেখতে নারাজ। হাবিবুর রহমান যুক্তিবাদী বলেন, ‘ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য দেওয়াকে পেশা হিসেবে নেওয়া ঠিক নয়। এখানে উদ্দেশ্য হতে হবে হেদায়েতের। মানুষকে ভালো ও সুন্দর কথা শোনাতে হবে। দেশ স্বাধীনের পরপরই ওয়াজ শুরু করেছিলাম। তবে কখনও চুক্তি করিনি। বুঝিও না ব্যাপারটা। কিছু বক্তা আছে চুক্তি-টুক্তি করে।’
জ্যেষ্ঠ আলেমদের অন্যতম মাওলানা ফরীদউদ্দীন মাসঊদের পর্যবেক্ষণ, ওয়াজ মাহফিলে আগের চেয়ে এখন আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তিনি জানান, সৈয়দ আহমদ বেরেলভীর শীষ্য মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরীর হাত ধরে ওয়াজ মাহফিলের সূচনা হয় এই অঞ্চলে। সৈয়দ আহমাদ বেরেলভী তাকে সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবর্তে বাংলা ও আসাম অঞ্চলে ওয়াজ-নসিহত ও লেখনীর মাধ্যমে সমাজ সংস্কার ও ধর্মপ্রচারের নির্দেশ দেন। এর সুবাদে কারামত আলী (রহ.) নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, আসাম, রংপুরসহ বেশকিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরেছেন, ওয়াজ মাহফিলের প্রসার ঘটে তার সময়েই। তিনি সারাবাংলা চষে বেড়িয়েছেন। ওই সময় নৌকায় চড়েই তাকে যাতায়াত করতে হয়েছে। এরপর তো দেওবন্দি ওলামাদের মাধ্যমে গোটা উপমহাদেশেই মাহফিল প্রসারিত হয়েছে। দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর ও উনিশ শতকের শুরুতে সিলেটে ও চট্টগ্রামে কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার আগে কওমি শব্দটা ছিল না, আলেমরা দেওবন্দি হিসেবে পরিচিত ছিলেন।’
উইলিয়াম হান্টার রচিত ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ গ্রন্থের তথ্যমতে, উত্তর-ভারতের আলেমসমাজ ফরায়েজীপন্থীদের তৎকালীন ভারতে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যে ‘দারুল হরব’ ফতোয়া ঘোষণা করা হয়েছিল, এর বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছিলেন মাওলানা কারামত আলী জৈনপুরী। ইতিহাসে তা কলকাতা মোহামেডান সোসাইটির ফতোয়া হিসেবে স্বীকৃত। সেখানে তিনি ভারতবর্ষকে দারুল ইসলাম হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, যেখানে জিহাদ করা আইনসংগত নয়। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মে কারামত আলী ইন্তেকাল করেন। রংপুর মুন্সীপাড়া জামে মসজিদের পাশে তার মাজার রয়েছে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক পরিচালক মাওলানা ফরীদউদ্দীন মাসঊদ জানান, ‘সাতচল্লিশে দেশভাগের আগে থেকেই মাহফিলের অবয়ব পাল্টাতে থাকে। পরস্পরায় স্বাধীনতার পর মাহফিল ইসলামি ভাবগাম্ভীর্য থেকে বেরিয়ে আসে। আগে যারা ওয়াজ করতেন তাদের ইলম, আমল, তাকওয়া সবই ছিল। তাদের কোনো ব্যবসায়িক চিন্তা ছিল না। নব্বই দশকের পর ওয়াজ মাহফিল বাণিজ্যনির্ভর হয়ে ওঠে। এখন এটি ব্যাপকতর আকার নিয়েছে।’
একদল মিথ্যুকের বক্তব্য যদি ওয়াজ মাহফিল আর শুক্রবারের খুতবায় বলা হয় তাহলে কেমন শিক্ষিত মুসলমান তৈরি করছি? তারা বলে বলে পার পেয়ে যাচ্ছে বলেই অল্প অল্প করে বলতে বলতে আজ বোকামি আর মিথ্যাচারী এপিডেমিক আকার ধারণ করেছে। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বড় বড় মেধাবীরা তাদের উচিত এদের থামানো। সরকারেরও উচিত একটি আইন করা, যেখানে ওয়াজ মাহফিলে উসকানিমূলক বক্তব্য ও মিথ্যাচারের জন্য বিচারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। না হলে তাদের কাছ থেকে শিখে কেবল ভণ্ড মিথ্যাচারে ভরপুর সমাজ সৃষ্টি হবে, যার লক্ষণ এখন স্পষ্ট। গাড়ি চালাতে লাইসেন্স অর্জন করতে হয়, ডাক্তারি ও সার্জারি করতে হলে লাইসেন্স অর্জন করতে হয়। তাহলে মানুষকে যারা শিক্ষা দিয়ে বেড়াবে তাদের কেন লাইসেন্স অর্জন করা লাগবে না? এই প্রশ্নের সঠিক ব্যবস্থা না নিলে এই সমাজ কখনো সভ্য হবে না।
আরেকজনের কল্লা কাটা নয়, আরেকজনকে গালি দেয়া নয়, আরেকজনকে নাস্তিক কাফের বলা নয়, বরং নিজেকে ঠিক করাটা জরুরি। ইসলামের সবচেয়ে বড় জিহাদ নিজের নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ। নিজের ভেতরের পাপ আর লোভকে সংবরণের জিহাদ। সেটা কী তারা করছেন?
ধর্মীয় প্রচার অনুষ্ঠান হিসেবে ওয়াজ মাহফিল স্বীকৃত হলেও বাংলাদেশে শুরু থেকেই এর সঙ্গে ‘রাজনীতি’ অঙ্গা অঙ্গিভাবে যুক্ত। একদিকে ধর্মভিত্তিক দলগুলো ‘প্রচারণা’র অংশ হিসেবে বেছে নিয়েছে ওয়াজকে, অন্যদিকে গত একযুগে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও প্রশাসনের লোকেরা মাহফিলমুখী হয়েছেন। প্রায় প্রতিটি মাহফিলেই মন্ত্রী, সংসদ সদস্য বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা প্রধান ও বিশেষ অতিথির আসন অলংকৃত করছেন। আলেমদের ধারণা, ধর্মীয় সভায় ক্ষমতাসীন বা রাজনীতিকদের উপস্থিতি সামাজিকভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় আলেমরা দুই ভাগে বিভক্ত হন। ভারতের দেওবন্দি আদর্শের আলেমরা দেশভাগের বিপক্ষে আর অন্য আলেমরা পাকিস্তান সৃষ্টিকে ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার সুযোগ হিসেবে দেখেছেন। এর প্রভাব পড়েছে ওয়াজে। পূর্বসূরিদের সেই রাজনৈতিক অবস্থান ছায়া ফেলেছে মাহফিলে। ওয়াজের প্রবণতা ১৯৭১ সালের আগেও ছিল। এরপর বিশেষ করে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর থেকে মাহফিলের প্রসার ঘটতে থাকে।
মাহফিলের বাইরে পীর-মাশায়েখ বা মাজার-খানকার আচরণেও কখনো কখনো রাজনীতির প্রভাব পড়েছে। মাজার-খানকাপন্থীদের মধ্যেও অনেকে রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তবে তারা ওয়াজ মাহফিলের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখলেও মাজারকেন্দ্রিক ওরস আয়োজন করে থাকেন। বাংলা সাহিত্যেও এই মাজার-খানকার সঙ্গে রাজনৈতিক অভিসন্ধির বর্ণনা পাওয়া গেছে। জীবন ও জীবিকার তাগিদে পাহাড় ছেড়ে সমতলের মহব্বতনগর গ্রামে এসেছিল ‘লালসালু’র মজিদ। ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচিত এই উপন্যাসের পটভূমি চল্লিশের দশক। তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি উঠে এসেছে এতে। দেশভাগ থেকে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সময়ের প্রবহমানতায় পরিবর্তিত হয়ে একবিংশ শতাব্দীতে এসে ‘মজিদ’দের অবয়ব ও পরিচয় পাল্টেছে। এখন মাজার-খানকার দায়িত্বশীলরা সরাসরি রাজনৈতিক দলে যুক্ত আছেন।
জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জামায়াতপন্থী বক্তাদের মধ্যে আছেন মাওলানা কামাল উদ্দিন জাফরী, মাওলানা তারেক মনোয়ার, মাওলানা আবদুল্লাহ আল মামুন, মাওলানা আমীর হামজা, মাওলানা মিজানুর রহমান আযহারী, মাওলানা মোল্লা নাজিম প্রমুখ। জামায়াতপন্থী বক্তাদের প্রায় সব ওয়াজেই জামায়াতে ইসলামীর নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর প্রসঙ্গ উঠে আসে। বক্তাদের মুখে মুখে নিয়মিত বিবৃত হয় সাঈদী প্রসঙ্গ। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে সাজা খাটছেন তিনি।
এক শ্রেণির বক্তার বয়ানের প্রধান অংশ হয়ে ওঠে কবি, সাহিত্যিক, নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকাদের নিয়ে বিষোদগার, গিবত। গিবত অর্থ বিনা প্রয়োজনে কোনো ব্যক্তির দোষ অন্যের কাছে উল্লেখ করা। রাসুল (স.) গিবতের পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘গিবত হলো তোমার ভাইয়ের এমন আচরণ বর্ণনা করা, যা সে অপছন্দ করে।’ গিবত কবিরা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত। গিবত ব্যভিচার থেকেও ভয়ানক।
মৃত ব্যক্তিদের নিয়েও এক শ্রেণির বক্তা বিষোদগার করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ, একজন সংগীত ব্যক্তিত্বের মৃত্যুর পর এক বক্তা ওয়াজে বলেছেন, ‘কিছুদিন আগে একজন অলি মইরা গেছে। ওই শয়তান কবরে এখন আপেল খাচ্ছে।’ আরেক বক্তা বলেছেন, ‘কিছু কুলাঙ্গার, যাদের জন্মের ঠিক নেই।’ এদিকে, একজন সংগীতশিল্পী মারা যাওয়ার পর কিছু বক্তা ওয়াজের নামে বিষোদগার, কুৎসা করেছেন। ইসলাম বলে মৃত ব্যক্তির নামে কোনও খারাপ কথা বলা যাবে না। ইসলামে মৃত ব্যক্তির দোষ চর্চা বা তার ওপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
কিছু ওয়াজ মাহফিলে কয়েক কিলোমিটার এলাকায় মাইক লাগিয়ে সারা রাত কিংবা গভীর রাত অবধি ওয়াজ করা হয়। ফলে অসুস্থ, পরীক্ষার্থী, কর্মজীবীদের কষ্টে ফেলা হয়। বাসায় বসে ওয়াক্ত নামাজ ও তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়কারীর একাগ্রতা নষ্ট করা হয়। ইসলাম যেখানে পশু-পাখির অধিকারের বিষয়েও আমাদের সতর্ক করেছে, সেখানে কোনো অসুস্থ মুসলমান, পরীক্ষার্থীকে কষ্ট দেওয়া, কারও ব্যক্তিগত কাজে ব্যাঘাত ঘটানো, নামাজ আদায়কারীর একাগ্রতা নষ্ট করা কি ইসলামে বৈধ হতে পারে?
যে ওয়াজ করতেছে তার ধর্মীয় জ্ঞান, মানবিক বোধ এগুলা যাচাই করবে কে? সব হুজুরের এলেম বা মানবিক বোধ তো এক নয়! ওয়াজের মধ্যে অনেক হুজুরকে দেখছি ভুল তথ্য দেয়, জঘন্য ভাষায় ঘৃণা ছড়ায়, মিসোজিনি ছড়ায়, বিধর্মী বা তাদের দৃষ্টিতে ইসলামবিরোধীদের পারলে সেখানেই শেষ করে দেয়! কথা হলো, এরকম ওয়াজে মানুষ বিগড়ালে তার বিধান কী? একবার ভাবুন, যে কোমলমতি ছেলেটা ওয়াজে যায় এটা ভেবে যে হুজুর যা বলতেছে সেটাই ঠিক, ও সেখান থেকে কী শিক্ষা নিয়ে বের হচ্ছে! তারপর সেই শিক্ষার আলো সে যখন সমাজে ছড়াবে তখন সেই সমাজের চেহারা তো লালমনিরহাটের নারকীয় ঘটনার মতোই হবে! এই যে কথায় কথায় কারো মৃত্যুদণ্ড চাওয়া, কাউকে কতল করতে চাওয়া এটা কি ফৌজদারি অপরাধ নয়?
নারী নেতৃত্ব ও নারীদের নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ এবং বিষোদগার থাকে ওয়াজে। অন্য ধর্মের অনুসারীদের নিয়ে ঠাট্টা মশকরা ও ছোট করার প্রবণতা লক্ষণীয় যা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর জন্য যথেষ্ট। সাধারণ প্রান্তিক মানুষের ভেতর তিল তিল করে এরা ছড়িয়ে দেয় নারী বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতা। মোটাদাগের অশ্লীল এই উপস্থাপন ওয়াজের নামে শুরু করেছিলেন যুদ্ধাপরাধী সাইদী নিজেই। ‘আলিফ খালি বে এর নিচে এক নখতা’র মতো দেখবেন, এই যুগের নারীর বুক খালি পেট খালি কপালের ওপর এক নখতা নাভির নিচে…’ সাইদীর এমন ওয়াজ ভোলেননি অনেকে। নিশ্চয় ভোলেননি মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িতদের শাস্তি প্রদানের দাবীতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলন। নিকৃষ্ট সাইদী শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে ওয়াজের মধ্যে বলতেন, ‘জাহান্নামের ইমাম’! রাস্তায় যৌন উত্তেজক ওষুধের বিক্রেতা বা ক্যানভাসারদের মতোই সাইদী বা একালের অনেকের ওয়াজ আজও দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এই ওয়াজকারীরা উসকানি দিয়ে বলে ‘রবীন্দ্রনাথ কাফের কাজেই জাতীয় সংগীত বদলাতে হবে, চাপিয়ে দেয়া যাবে না’!
ওয়াজ মাহফিল নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন ও সুপারিশে আলেমরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, ওয়াজ মাহফিলসহ দিনের দাওয়াত আলেমদের গুরুত্বপূর্ণ কর্ম। এর তদারকির জন্য শীর্ষস্থানীয় আলেমরাই যথেষ্ট। প্রশ্ন হলো ওয়াজের নামে যদি ইসলামকে বিকৃত-বিতর্কিত করা হয়, বিদ্বেষ ছড়ানো হয়, অন্য ধর্মকে অবজ্ঞা করা হয়, ফিতনা সৃষ্টি করা হয়, সমাজ-রাষ্ট্রের নিরাপত্তায় হুমকি সৃষ্টি করা হয়, উগ্রবাদকে উসকে দেওয়া হয়, কারও চরিত্রহনন করা হয়, তখন কি সরকারের হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার সুযোগ আছে?
লেখক: সহকারী সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন