শীতনিদ্রায় ক্যানসার কোষ
৩০ জানুয়ারি ২০২১ ১৯:২১
“প্রচণ্ড গোলাগুলি হচ্ছে চারপাশে। স্থানীয়রা আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। কখন মাথার ওপর কেমিক্যালের গোলা এসে পড়ে তারও ঠিক নেই। এসবের মাঝেই আমরা আমাদের প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছি, ছোট্ট ভূখণ্ডে আমাদেরও বেঁচে থাকার অধিকারের পক্ষে লড়াই করে চলেছি! হঠাৎ আকাশে কালো মেঘ ছেয়ে গেল। কেমো অ্যাটাক! আমরা হতবিহবল হয়ে পড়েছিলাম, ঠিক তখনই হেড কোয়ার্টার থেকে নির্দেশ এলো লুকিয়ে পড়ার। আমরা যতটা সম্ভব চেষ্টা করলাম তাদের রাডারে ধরা না পড়তে, চুপচাপ প্রায় নিশ্চল হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম মেঘ কেটে যাওয়ার, এবং অপেক্ষা করতে লাগলাম ফিরে আসার, আরও শক্তিশালী হয়ে!”
ওপরের বিবরণ এমন এক যুদ্ধক্ষেত্রের যার অবস্থান আমাদের শরীরের ভেতরেই। গল্পের নায়ক (কিংবা খলনায়ক) হলো ক্যানসার কোষ—যাদের নির্মূল করার জন্য বিভিন্ন কেমিক্যাল থেরাপি দেওয়া হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ক্যানসার কোষ এই কেমিক্যালদের থেকে বেঁচে থাকার জন্য কিছু অদ্ভুত কৌশল রপ্ত করেছে এবং পরবর্তীতে উক্ত কেমোথেরাপির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছে। আজকে সেটা নিয়েই বিস্তারিত আলাপ।
শুরুতেই ক্যানসারের পরিচিতি জানা প্রয়োজন। এটা নিয়ে আমার ছোট্ট একটি অগোছালো লেখা রয়েছে, সেটা পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করতে পারেন।
মূলত, ক্যানসার কোষেরা আমাদেরই কোষ যাদের মাঝে বিভাজন নিয়ন্ত্রণ করার মেকানিজম কোনো কারণে নষ্ট হয়ে গেছে। তাদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকলে শক্তি-চাহিদাও বৃদ্ধি পায় যার ফলে সেটা রোগীর জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। শুরুতে শরীরের ইমিউন সিস্টেম এদের বিরুদ্ধে ভালো কাজ করলেও ধিরে ধিরে যখন ক্যানসার কোষ অস্থি মজ্জায় ছড়িয়ে পড়ে তখন কার্যকরী শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা কমতে শুরু করে। যার ফলে তাদের দমিয়ে রাখা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
চিকিৎসার জন্য কেমোথেরাপি নিতে হতে পারে আপনাকে। কেমোথেরাপির ওষুধ সাধারণত সেই কোষদের মেরে ফেলে যেগুলোতে বিভাজন খুব দ্রুতগতিতে হয়। যেটার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হিসেবে শরীরের সাধারণ কোষ যেগুলো দ্রুতগতিতে বিভাজিত হয় সেগুলোও মারা যায়। যেমন চুলের কোষ। ক্যানসার কোষ তাই এই কেমো অ্যাটাক এড়িয়ে চলার জন্য নিজেদের দ্রুতগতির বিভাজন শ্লথ করে দেয়।
দাঁড়ান দাঁড়ান, কী ব্যাপার?
ক্যানসার কোষ যদি তাদেরই বলা হয় যাদের বিভাজিত হওয়ার প্রক্রিয়া অনিয়ন্ত্রিত তাহলে তারা কী করে সেই প্রক্রিয়ার গতি কমিয়ে দিতে পারে?
এখানেই শীতনিদ্রা কথাটি আসে। যদিও কোনো প্রাণী শীতনিদ্রায় গেলে তার কোষের যেমন অবস্থা হয় ক্যানসার কোষের বিষয়টা তেমন নয়। এদের অবস্থা তুলনা করা যায় ডায়াপজ (Diapause) শব্দটির সঙ্গে। কিন্তু “ডায়াপজে ক্যান্সার কোষ” শিরোনাম নিশ্চয়ই আকর্ষণীয় শোনায় না।
ডায়াপজ হলো ভ্রূণ কোষের এমন অবস্থা যখন তার বিভাজিত হওয়ার হার কমে যায়। এটা একটি সুন্দর সার্ভাইভাল মেকানিজম। যদি গর্ভবতী মা খাবার কম পায়, কিংবা কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়ে যায়, যেমন কম তাপমাত্রা বা খরা ইত্যাদি, তখন মায়ের গর্ভে থাকা ভ্রূণ কম গতিতে বিভাজিত হয়, যাতে প্রতিকূল পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার প্রয়োজনীয় সময় পায়। যদিও মানুষের ক্ষেত্রে এই ডায়াপজ মেকানিজমটি এখন আর নেই, তবে পৃথিবীর প্রায় ১০০ প্রজাতির স্তন্যপায়ীদের মাঝে এখনও এই মেকানিজম কাজ করে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো—দুনিয়ার যে কোনো প্রাণীর যে কোনো ক্যানসার কোষই এই ডায়াপজ অবস্থায় যেতে সক্ষম, যদিও তার প্রজাতির ভ্রূণে এই মেকানিজম হারিয়ে গেছে।
বিষয়টি নিয়ে নিশ্চিত হয়েছিলেন ক্যাথরিন ও মিগেল নামক দু’জন বিজ্ঞানী যখন তারা হিউম্যান কলোরেকটাল ক্যানসার কোষ পেট্রি ডিশে রেখে সেখানে কেমোথেরাপি প্রয়োগ করেছিলেন। দেখা গেল, তাদের বিভাজিত হওয়ার হার কমে গেল, তাদের শক্তিচাহিদা কমে গেল এবং যতক্ষণ কেমোথেরাপির কেমিক্যাল সেখানে ছিল তারা কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই বেঁচে রইল। কিছু সংখ্যক কোষ কেমোথেরাপির ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকও হয়ে গেল।
ভ্রূণ কোষেরা যেভাবে ডায়াপজ অবস্থায় থাকে সেখানে খাবারের ঘাটতি পড়লে তারা অটোফ্যাজি বা নিজেই নিজের মাঝে থাকা প্রোটিন ভেঙে শক্তির চাহিদা পূরণ করে। এটা অনেকটা খাবারের অভাবে নিজের আঙুল খাওয়ার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। ক্যানসার কোষও একই কাজ করে কি-না তা দেখার জন্য সেই পেট্রি ডিশে এমন কিছু কেমিক্যাল দেওয়া হলো যেগুলো অটোফ্যাজি প্রক্রিয়াটি হতে দেয় না। দেখা গেল, ক্যানসার কোষেরা আর ডায়াপজ অবস্থায় থাকতে পারছে না এবং তাদের সহজেই কেমো দিয়ে নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে।
এই গবেষণা থেকে আমরা কেমোথেরাপি আরও উন্নত করতে পারব। কেমো দেওয়ার কারণে যদি ক্যানসার কোষ ডায়াপজ অবস্থায় চলে যায় তবে তাদের লক্ষ্য করে এন্টি অটোফ্যাজি ড্রাগ ব্যবহার করা যাবে, যাতে তারা প্রতিরোধক হয়ে যেতে না পারে।
লেখক: শিক্ষক