Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভ্যাকসিনের কোন পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক, কোনগুলো নয়


১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৫:১০

যে কোনো ভ্যাকসিনের মতো করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত ভ্যাকসিনেরও কিছু পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হতে পারে। কিছু পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া থাকা স্বাভাবিক, এতে অবাক বা বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। চিন্তা করে দেখুন, এমন একটা ভাইরাস যার আক্রমণে পৃথিবীতে মাত্র এক বছরে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ মারা গেছে; সেটি প্রতিরোধে আপনি যে ভ্যাকসিন নিচ্ছেন, যা আপনাকে মৃত্যু থেকে বাঁচিয়ে দিতে পারে, তার খানিকটা পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া কি খুব অস্বাভাবিক? আসুন করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের কিছু পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা যাক।

১. ব্যথা, ফুলে যাওয়া, অথবা ভ্যাকসিন নেওয়ার জায়গায় লালচে হওয়া অথবা চুলকানি ভ্যাকসিনের খুবই সাধারণ পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া। ভ্যাকসিন নেওয়ার ১২ ঘণ্টার মধ্যেই সাধারণত এই প্রতিক্রিয়াগুলো দেখা যায়। তবে সকলের ক্ষেত্রে একই সময়ে প্রতিক্রিয়া হবে এমনটা নয়। করোনার ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। বেশিরভাগ মানুষই এই পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াগুলো অনুভব করেছেন। কেউ কম, কেউ বেশি। ভ্যাকসিন নেওয়ার পর থেকে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত এসব পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া খুবই স্বাভাবিক। কারও কারও ক্ষেত্রে এটি এমনকি সপ্তাহখানেকও থাকতে পারে। এসব উপসর্গের মাত্রা অত্যধিক না হলে চিন্তার কিছু নেই।

২. মৃদু জ্বর ভ্যাকসিনের আরেকটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। এটি কারও ক্ষেত্রে হয় কারও ক্ষেত্রে হয় না। ভ্যাকসিন নেওয়ার পর জ্বরের একাধিক কারণ আছে। একটা খুব স্বাভাবিক কারণ হচ্ছে, শরীর চায় ভ্যাকসিন নেওয়ার পর তাপমাত্রা একটু বাড়িয়ে দিতে, যাতে সাধারণ রোগজীবাণু এই সময়ে শরীরে খুব বেশি কার্যকর হতে না পারে। অর্থাৎ আপনার শরীর চায় এই সময়টাতে ওই নির্দিষ্ট ভাইরাসের বিরুদ্ধে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে, এই সময় যাতে অন্য কোনো জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে না হয়। ফলে তাপমাত্রা একটু বেড়ে যায়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে, ভ্যাকসিন কীভাবে কাজ করে সেটা। ভ্যাকসিন আপনার শরীরে এমন উপাদান প্রবেশ করায় যা আপনার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে জেগে উঠতে সহায়তা করে। কিন্তু ভ্যাকসিন ওই উপাদান অতটুকুই প্রবেশ করায় যা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে জেগে উঠতে সাহায্য করবে, অথচ আপনাকে আক্রান্ত করতে পারবে না। কিন্তু কারও কারও ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দ্রুত কার্যকর হয়, এবং প্রতিরোধ তৈরি করা শুরু করে, যার ফলশ্রুতিতে মৃদু জ্বর দেখা দিতে পারে। এর মানে হলো ভ্যাকসিন আপনার শরীরে কাজ করছে, সুতরাং চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।

৩. গা শিরশির করা, ঠাণ্ডা অনুভূত হওয়া, গা ম্যাজম্যাজ করা অনুভূতিও কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। অল্প জ্বরের সময়ে আমাদের অনেকেরই গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন দেওয়ার পর আপনার এমন কিছু অস্বস্তি হতে পারে। গা শিরশির করতে পারে, ঠাণ্ডা লাগতে পারে, গা ম্যাজম্যাজ করতে পারে। এগুলোর যে কোনটিই থাকতে পারে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত। জেনে রাখুন এগুলো স্বাভাবিক, চিন্তার কিছু নেই।

৪. দুর্বল লাগা ভ্যাকসিনের কার্যকরীতার একটা লক্ষণ। মনে রাখবেন, ভ্যাকসিন আপনার শরীরকে বোঝাতে চায় যে, আপনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, যাতে সে তার প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে কার্যকর করে। তারপর ভ্যাকসিনের অন্যান্য উপাদান সেই প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করে আপনার শরীরকে এমনভাবে প্রস্তুত করে, যাতে ভবিষ্যতে আপনি করোনায় আক্রান্ত হলে সে আপনাকে প্রতিরক্ষা দিতে পারে। এই পুরো ব্যাপারটি আমি যে দুই-তিন লাইনে বললাম তার চাইতে অনেক জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। ফলশ্রুতিতে আপনার শরীর আপনার অজান্তেই ভেতরে ভেতরে ভ্যাকসিন নেওয়ার পর অনেক কাজ করতে থাকে। এই পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য আপনার শরীরের উপর দিয়ে অনেক চাপ যায়, ফলশ্রুতিতে খানিকটা দুর্বল লাগাটাই স্বাভাবিক।

৫. মাথাব্যথা হলে ভয় পাবেন না। করোনা প্রতিরোধক ভ্যাকসিন নেওয়ার পর যে মাথাব্যথা হয় এটাকে বলে সিস্টেমেটিক সাইড ইফেক্ট। ভ্যাকসিন যেখানে কাজ করে তার থেকে দূরে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় যে মৃদু প্রতিক্রিয়া হয় সেগুলোই সিস্টেমেটিক সাইড ইফেক্ট। মাথাব্যথা এর মধ্যে অন্যতম। মনে রাখবেন, ভ্যাকসিনের মধ্যে হাজারো উপাদান থাকতে পারে যা নানাভাবে আপনার শরীরকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রস্তুত করে। এর অনেকগুলো হচ্ছে কেমিক্যাল রিয়েকশন, অর্থাৎ ভ্যাকসিন আপনার শরীরের স্বাভাবিক নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে কিছু সময়ের জন্য প্রভাবিত করে, মাথাব্যথা তারই একটি সাময়িক লক্ষণ। দুই দিনের মধ্যেই মাথাব্যথা এমনিতেই চলে যাওয়ার কথা।

৬. মাংসপেশি ও গিটে (হাড়ের জোড়ায়) ব্যথা হলেও অবাক হবেন না। এছাড়াও ঘাড়ে ব্যথা, হাত নাড়তে ব্যথা, চোয়ালে ব্যথা এগুলো সবই হতে পারে কারও কারও ক্ষেত্রে। ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত হলে কোনো চিন্তার কারণই নেই। উপরে ভ্যাকসিন কীভাবে কাজ করে বলেছি, সে কারণে এমন ব্যথা হতে পারে যে কারো ক্ষেত্রে।

অক্সফোর্ড-এস্ট্রোজেনেকা ভ্যাকসিন নেওয়ার পর আপনি যদি উপরের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াগুলো অনুভব করেন, তবে আপনাকে অভিনন্দন, আপনার শরীরে ভ্যাকসিনটি কাজ করছে। আপনার রোগ প্রতিরোধক্ষম কোষগুলো কাজে নেমে পড়েছে আক্রান্ত হওয়ার আগেই, তাই আপনি এগুলো অনুভব করছেন। ভ্যাকসিন নেওয়ার পর যদি উপরোক্ত পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াগুলো আপনি অনুভব না করেন, তবে আপনাকেও অভিনন্দন, আপনার শরীরেও ভ্যাকসিন কাজ করছে। কিন্তু আপনার শরীর সম্ভবত যথাযথ মাত্রায় প্রস্তুত হচ্ছে, তাই এখনই প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না।

যাদের বয়স কম, এবং শারীরিকভাবে বেশি সক্ষম, তাদের মধ্যে পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া কম হওয়ার কথা। যাদের বয়স বেশি, বা বয়স কম হলেও শরীর তুলনামূলকভাবে দুর্বল, তাদের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া বেশি দেখা যেতে পারে। কোনো ক্ষেত্রেই চিন্তার কিছু নেই।

কোন পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় গুরুত্ব দেবেন
আপনার শরীরের যদি হঠাৎ করে অত্যাধিক চুলকানি দেখা যায়, সারা শরীর ফুলে যায়, র‍্যাশ দেখা যায়, নিঃশ্বাস নিতে সাংঘাতিক সমস্যা দেখা যায়, তবে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলুন। প্রতি ১ লাখের মধ্যে ১ জনের এমন হতে পারে। মনে রাখবেন গত বছর ঘুমের মধ্যে বিছানা থেকে মাটিতে পড়ে গিয়ে পৃথিবীতে ৪৫০ জন মানুষ মারা গিয়েছে। সুতরাং ১০ লাখে একজন মানুষের এমন হলে সেটা দুর্ভাগ্য, আর কিছু নয়। এখানে ভ্যাকসিনের কোনো দোষ নেই।

পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার এই সময়ে কী করতে পারেন

  • বেশি অস্বস্তি, ব্যথা, জ্বর হলে ২টা প্যারাসিটামল খেয়ে নেন বেশি করে পানির সঙ্গে।
  • ভ্যাকসিন নেওয়ার পর ১-২ দিন ছুটিতে থাকতে পারেন যদি আপনার কর্মক্ষেত্র সেটা অনুমোদন করে। বিশ্রাম দ্রুত আপনাকে চাঙা করে দেবে।
  • ভ্যাকসিন নেওয়ার জায়গায় ব্যথা হলে বরফ দিতে পারেন বা ঠাণ্ডা পানিতে কাপড় ভিজিয়ে সেটা দিয়েও চেপে রাখতে পারেন।
  • প্রচুর পানি পান করুন।
  • আপনার চিকিৎসকের ফোন নাম্বার জেনে রাখুন।

মনে রাখবেন এস্ট্রোজেনেকা ভ্যাকসিন নেওয়ার পর প্রতি ১০ জনের মধ্যে অন্তত ২ জনের মধ্যে এইসব পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। বয়স, জীবনযাপনের ধরণ, শারীরিক সুস্থতা, ওজন ইত্যাদির উপর নির্ভর করে কে কেমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনুভব করবেন। কিন্তু মনে রাখবেন আপনি যতই অসুস্থ হন না কেন, এলার্জি ছাড়া আপনার ভ্যাকসিন নেওয়া জরুরি। আর খুবই সীমিত ক্ষেত্রে কারও কারও ক্ষেত্রে হয়তো ডাক্তার ভ্যাকসিন নিতে মানা করতে পারেন। এস্ট্রোজেনেকা ভ্যাকসিন প্রথম ডোজ নেওয়ার পরই সাধারণত বেশিরভাগ মানুষ পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া অনুভব করেছেন। দ্বিতীয় ডোজের ক্ষেত্রে এটি কম বা না হওয়ার কথা। এস্ট্রোজেনেকার ক্ষেত্রে মাথা ঘোরা, বমি বা ডায়রিয়াও হতে পারে। উদ্বিগ্ন হবেন না।

আরও কিছু জিনিস জেনে রাখা দরকার

১. ভ্যাকসিন ডোজ শেষ করার পর অন্তত ৩ সপ্তাহ লাগতে পারে এটি কার্যকর হতে। অর্থাৎ ভ্যাকসিন দেওয়ার ৩ বা ৫ দিন পরও আপনার করোনা হতে পারে। তাই ভ্যাকসিন ডোজ শেষ করা জরুরি এবং ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পরা ও হাত ধোয়ার অভ্যাস জারি রাখা ভালো।

২. ভ্যাকসিন দেওয়ার পরও আপনার করোনা হতে পারে। সকল ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানই বলেছে যে, করোনার ভ্যাকসিন নিলেও আপনার আবার করোনা হতে পারে। ভ্যাকসিনের মূল কাজ আপনি যাতে করোনা আক্রান্ত হলে মারা না যান সেটি নিশ্চিত করা, কিন্তু করোনা একেবারে হবেই না, এটি নিশ্চিত করে বলার মতো দীর্ঘসময়ের গবেষণা করা সম্ভব হয়নি।

৩. করোনার ভ্যাকসিন নিলে তা আপনাকে কতদিনের প্রতিরক্ষা দেবে? বিজ্ঞানীরা তা জানেন না, কারণ এটা জানার জন্য যে দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা করা দরকার সে সময় কেউ পায়নি। সুতরাং যদি ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও আবার আপনার করোনা হয়, অবাক বা হতাশ হবেন না। কিন্তু জেনে রাখবেন এই ভ্যাকসিন সম্ভবত আপনাকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া থেকে রক্ষা করেছে।

৪. আপনার যদি ইতিমধ্যে করোনা হয়ে গিয়েও থাকে, তবু আপনাকে ভ্যাকসিন নিতে হবে। কারণ বিজ্ঞানীরা জানেন না যে,  এন্টিবডি আসলে আপনাকে কতদিনের প্রতিরক্ষা দেয়। সুতরাং ভ্যাকসিন না নিলে ঝুঁকি থেকে যায়, নিয়ে নিলে কোনো ক্ষতি নেই।

আমি উপরে যে আলোচনা করেছি আশা করি তা আপনাদের ভ্যাকসিন নিতে উৎসাহিত করবে। আমরা সৌভাগ্যবান যে, বাংলাদেশে এত সহজে ও দ্রুত বিনা পয়সায় করোনার ভ্যাকসিন পাওয়া যাচ্ছে। আমি উপরে যা আলোচনা করেছি কোনটিই আমার নিজের অনুমান নির্ভর নয়। ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টো, সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন, জন হপকিনস ইউনিভার্সিটি এবং আমার জনস্বাস্থ্যের জ্ঞান ও গবেষণা থেকে লেখা। কিন্তু মনে রাখবেন একটি রোগ ও ভ্যাকসিন নিয়ে গ্রহণযোগ্য কিছু বলার জন্য ন্যূনতম ৫ থেকে ১০ বছর সময় লাগে। কিন্তু করোনা বিশ্বকে সেই সুযোগ দেয়নি। আমরা চেষ্টা করছি সম্ভাব্য সবচেয়ে সেরা তথ্যটি আপনাকে দিতে, কিন্তু এর ব্যতিক্রম হবে না, সেটি নিশ্চিত করে বলতে পারছি না।

সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।

লেখক: সোশ্যাল এন্ড বিহেভিয়ারাল হেলথ সায়েন্টিস্ট, ডক্টরাল রিসার্চার, ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টো


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর