একাকীত্বের মন্ত্রী
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৫:৪৫
জাপানে মানুষের নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্ব এত বেড়ে গেছে যে তাদের প্রধানমন্ত্রী এ মাসে একজন নিঃসঙ্গতার মন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছেন। ফাজলামো করছি না, সত্য বলছি। করোনার সময়ে জাপানীদের নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্ব এত বেড়ে গেছে যে প্রধানমন্ত্রী ইয়োশোহিদে সুগা; টেটসুকি সাকামোতোকে তার বর্তমান মন্ত্রণালয়ের বাইরে একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতার মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করতে বলেছেন। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে জাপানই প্রথম নয়, ২০১৮ সালে যুক্তরাজ্য প্রথম একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতার মন্ত্রী নিয়োগ দেয়। এই বিষয়ে পরে ফিরছি, চলুন অন্যকিছু গল্প শুনে আসা যাক।
রেনে টরোন্টো জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ওপেন হার্ট সার্জারির মাত্র ১৪ সপ্তাহের মাথায়। সে পড়ে গিয়ে নিজেকে আহত করেছে। আগের অপারেশনের জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার এই অপারেশন আবার করতে হবে। আগেরবার যে চিকিৎসক অপারেশন করেছিলেন, তিনি রেনেকে জিজ্ঞেস করলেন পড়ে গেলে কীভাবে? রেনে মৃদু হেসে বললেন, “পড়ে গিয়েছি সেটা কোন সমস্যা না। পড়ার পর আর উঠতে পারিনি সেটা সমস্যা।” ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন কতক্ষণ এভাবে পড়ে ছিলে? রেনে বললেন, “১৪ ঘণ্টা।” ডাক্তার বলল, “সেকি! পড়ে কীভাবে উঠলে? কে তোমাকে উদ্ধার করল?”। রেনে, “এক ডেলিভারি ম্যান ভুল করে পাশের বাসার জায়গায় আমার দরজায় ধাক্কা দিয়েছিল। চিৎকার করে তাকেই ডাকি, সেই আমাকে উদ্ধার করে ৯১১ এ ফোন করে, কী লজ্জার ব্যাপার বলো তো!”
স্বামী প্যাট্রিক মারা যাবার পর রেনে একাকী থাকেন একটা এপার্টমেন্টে। আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই কাছাকাছি। ছেলে-মেয়েরাও বড় হয়ে দূরে চলে গেছে। অল্প বয়সে মনে হতো এই একাকী জীবন, ছোট ফ্যামিলি দারুণ, ঝামেলা নেই, কিন্তু রেনে এখন অন্যভাবে ভাবেন। হতাশায় ভোগেন, একাকীত্বে ভোগেন। (ধরেন কাল্পনিক গল্প লিখলাম!)
একাকীত্ব আর নিঃসঙ্গতার গল্প আমরা শুধু তরুণদেরই শুনি, লাখ লাখ বৃদ্ধের একাকীত্বের গল্প আমরা কমই শুনি। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক অর্থনীতি মানুষকে এটা ‘গিলিয়েছে’ যে যার জীবন তার। হাসো, খেলো, ফুর্তি করো, তারপর একদিন মরে যাও। এই অর্থনৈতিক ‘ধোঁকা’ যে আসলেই একটা ধোঁকা সেটা মানুষ বুঝতে পারে শেষ বয়সে, যখন আর তেমন কিছু করার থাকে না। আবার অন্যদিকে তাদেরই পরবর্তী প্রজন্মও ততদিনে এই ধোঁকা-সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। বের হতে পারে না। ভোগে বিষণ্ণতায়।
সিবা গেইগির সেই বিষণ্ণতার বিজ্ঞাপনটা আমাদের জেনারেশনের কেউ নিশ্চয় ভুলে যাননি। ওই প্রথম বাংলাদেশে বিষণ্ণতা নিয়ে হালকা আলাপ শুরু হয়। বিষণ্ণতার নানা প্রতিক্রিয়ার সবচেয়ে শেষ ধাপ হচ্ছে আত্মহত্যা। প্রতিবছর গড়ে ৮ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যায় মারা যান। হ্যাঁ, ভুল লিখিনি। ৮ লক্ষ মানুষ। আমার এই লেখা পড়তে পড়তে কমপক্ষে ১০ জন মানুষ আত্মহত্যায় মারা গেছেন, প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন।
এই লেখার উদ্দেশ্য আত্মহত্যাকে মহিমান্বিত করা নয়। তাকে হেয় করাও নয়। পৃথিবীর কোন মৃত্যুই মহিমান্বিত বা হেয় করার মতো নয়। কিছু বিসর্জন হয়ত গৌরবের, কিন্তু কোন মৃত্যুই আনন্দের নয়। শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৮ সালে ১ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করা নিয়ে চিন্তা করেছে, ৩৩ লক্ষ আমেরিকান আত্মহত্যার পরিকল্পনা করেছে এবং প্রায় ১৪ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে।
চলুন আবার ঘুরে আসা যাক যুক্তরাজ্য থেকে, যেখানে ২০১৮ সালে প্রথম নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্বের মন্ত্রী নিয়োগ দেয়া হয়। ইংরেজি ভাষার চাইতে বাংলা ভাষা বেশী শ্রুতিমধুর। ইংরেজি লোনলিনেসের বাংলা একাকীত্বও হতে পারে আবার নিঃসঙ্গতাও হতে পারে। মন্ত্রী নিয়োগ দেয়ার সময় যুক্তরাজ্য লোনলিনেসের সাথে সাথে আইসোলেসন শব্দটাও ব্যবহার করেছে সমস্যা হিসেবে। তাই আমার মনে হচ্ছে বাংলায় নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্ব দুটোরই প্রয়োগ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
মানুষের একাকীত্বের গভীরতা পরিমাপ করার জন্য যুক্তরাজ্যে জো কক্স কমিশনও গঠন করা হয় যারা ২০১৭ সালে তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করে। এর পর পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে ২০১৮ সালে একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতার মন্ত্রী নিয়োগ দেন। তিনি বলেন অসংখ্য মানুষ নিঃসঙ্গতায় ভুগছে এবং একাকীত্ব আধুনিক সভ্যতার একটা হতাশাব্যঞ্জক বাস্তবতা। তিনি বলেন একজন মানুষ যে কারণেই নিঃসঙ্গতায় ভুগুক না কেন, বার্ধক্যের কারণে, প্রিয়জন হারানোর বেদনায়, কথা বলার কেউ না থাকার কারণে, আমাদের এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।
ট্রেসি ক্রাউচকে তার দায়িত্বের সাথে একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতার মন্ত্রীও করা হয়। কিন্তু কিছুদিন পরেই সরকারের সহযোগিতার অভাবে তিনি পদত্যাগ করেন। ট্রেসি বলেন জুয়া খেলার ভয়াবহতার কারণে যুক্তরাজ্যে প্রতিদিন ২ জন মানুষ আত্মহত্যা করেন, কিন্তু এই সমস্যার সমাধানে তিনি সরকারের সহযোগিতা পাননি। ট্রেসি নিজে ডিপ্রেশনে ভুগেন তার সন্তান হবার পর। পরিবার, বন্ধু ও চমৎকার একজন পার্টনার থাকার পরও তিনি বিষণ্ণতায় ভোগেন এবং বলেন যে বিষণ্ণতার এই জায়গাটা ভয়াবহ অন্ধকারময়।
ট্রেসির পদত্যাগের পর মিমস ডেভিসকে যুক্তরাজ্যের দ্বিতীয় একাকীত্বের মন্ত্রী নিয়োগ দেয়া হয়। ডেভিস জানান তিনি নিজেও দীর্ঘদিন বিষণ্ণতায় ভুগেছেন, বিশেষত তার বাবা দুর্ঘটনায় অচল হয়ে যাবার পর প্রায় ২৫ বছর ধরে যখন তিনি ও তার মা তার বাবার সেবা করেছেন। এছাড়া সরকারি কাজও অত্যন্ত নিঃসঙ্গতাময় বলে তিনি জানান। ডেভিসের চালু করা #LetsTalkLoneliness ক্যাম্পেইন সবার মধ্যে জনপ্রিয়তা পায়। এছাড়াও তিনি ১২ মিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্দ করে ১২৬টা প্রোগ্রাম চালু করেন যার মধ্যে বৃদ্ধদের একে অপরের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো, বৃদ্ধদের সাথে তরুণদের যোগাযোগ বাড়ানো এবং চরম একাকীত্ব ভোগা মানুষদের খুঁজে বের করে তাদের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয়া অন্যতম। বরিস জনসনের সরকার ক্ষমতায় আসার পর ব্যারোনেস ডায়ানা ব্যারান তৃতীয় একাকীত্বের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন এবং ২ মিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্দ দেন একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতা দূরীকরণ প্রজেক্ট করার জন্য।
এদিকে, এক গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্রের ৪০ শতাংশ মানুষ একাকীত্বে ভোগে বলে জানা যায়। জাপানে ২০২০ সালে ২১ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে যা প্রতিবছর বেড়েই চলেছে। জাপানে ৬০ বছরের অধিক বয়সী ১৬ শতাংশ মানুষ মনে করেন তাদের কথা বলার মতো কেউ নেই। জাপানের পুরুষদের একটা বড় অংশ কাজে এত ব্যস্ত থাকে যে তাদের প্রায় ১৭ শতাংশ প্রায় কখনও বন্ধু, সহকর্মী বা প্রতিবেশীদের সাথে সময় কাটায় না। জাপানে কাজের সময় অনেক বেশী এবং অবসরের কোন নির্দিষ্ট বয়সসীমা নেই অনেক ক্ষেত্রেই। গত কয়েকবছরে অনেক তরুণকে গভীর রাতে কাজ থেকে বাসায় ফিরতে গিয়ে রাস্তার পাশে অচেতন হয়ে মারা যেতে দেখা গেছে।
জাপানে কাজই আনন্দ, কাজই সুখ এমন একটা ধারণা গড়ে উঠেছিল বেশ কয়েক দশক ধরে যা এখন আত্মঘাতী বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। জাপানে বর্তমানে ৩০ শতাংশ মানুষ একা বসবাস করে এবং প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ এমনকি তাদের প্রতিবেশীদের সাথেও মেশে না। কাজের চাপ, দারিদ্র, মহামারি ইত্যাদি এই একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ যা একজন মন্ত্রীকে একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতার পোর্টফোলিও দিতে বাধ্য করল।
বাংলাদেশে এখনও বিচ্ছিন্নভাবে একাকীত্ব ও বিষণ্ণতার ঘটনা ঘটছে। সামাজিকভাবে বিষণ্ণতাকে স্বীকার না করা প্রবণতা আমাদের মধ্যে প্রবল। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দ্বারা সমাজে নিজের অবস্থান খোঁজার চেষ্টা, ইগোসেন্ট্রিক উচ্চ মধ্যবিত্তের আগ্রাসন, নানা স্তরে “আমি ও আমার স্বাধীনতাকেন্দ্রিক” চিন্তার উন্মেষ, পরিবারের চাইতে ব্যক্তি বড় এইধরনের পুঁজিবাদী পাশ্চাত্য বিশ্বাসের প্রচলন খুব দ্রুত আমাদের সমাজেও বিষণ্ণতা, একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতার মহামারীর জন্ম দেবে। ইগোসেন্ট্রিক সমাজের আদিযুগ হিসেবে এখনও অনেকে সেটা স্বীকার না করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উল্লাসের অতি আস্ফালনের মাধ্যমে তাকে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করবেন বটে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সেটি মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর চাপ সৃষ্টি করবে, আত্মহত্যাকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থাকে উপরে তুলে আনবে।
“এখনও সময় আছে” একথাটি বলতে পারলে ভালো লাগত, কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি সময় আসলে আর নাই। আজকে থেকে ১০-১৫ বছর পরে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশেই একাকীত্বের মন্ত্রী, নিঃসঙ্গতার মন্ত্রী নিয়োগ দিতে হতে পারে। এর আগে যদি নিজেরাই পরিবার, বন্ধু ও সমাজকে ঘিরে মেলবন্ধন বাড়ানো যায় ভালো, নাহলে বিষণ্ণতার কালো অন্ধকার থেকে কারও মুক্তি নেই হয়ত।