প্রেরণার উৎস হোক ৭ মার্চের ভাষণ
৭ মার্চ ২০২১ ১১:২৮
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বাঙালি জাতির জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের এদিনে ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় দাঁড়িয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৭ মিনিটের এক জাদুকরী ভাষণে বাঙালি জাতিকে স্বপ্নে বিভোর করেছিলেন। তাঁর ভাষণে তিনি স্বাধীনতার যে ডাক দিয়েছিলেন তা বাঙালির মনে সারাজীবন অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে থাকবে। তৎকালীন শোষিত, বঞ্চিত, মুক্তিকামী ও লাঞ্ছিত জনগণকে আন্দোলনের ডাক দেওয়া তার ঐতিহাসিক সেই ভাষণে সাড়া দিয়েছিলেন লাখ লাখ জনতা। কালজয়ী এই ভাষণে আগুন ঝরা কণ্ঠে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মূলত ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক ভাষণের সেই ধারাবাহিকতায় ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে জাতির পিতা ঘোষণা করেন বাঙালি জাতির বহুকাঙ্খিত স্বাধীনতা। সঙ্গত কারণে এদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। কারণ ৭ মার্চের ভাষণের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই ভাষণ তাই মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণার এক অনন্য উৎস।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এই ভাষণের তাৎপর্য কতটা তা ভাষণটি শুনলেই বুঝা যায়। ভাষণটি শুনলেই যেন শরীরের ভেতর যুদ্ধের বাসনা জেগে উঠে। ঠিক যেমন ১৯৭১ জেগে উঠেছিল বাঙালিরা। মূলত ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের তাৎপর্য অনেক গভীর। ১৮ মিনিটের এই ভাষণের প্রভাব আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উপর কতটা ছিল তা ১৮ দিন পর অর্থাৎ ২৫ মার্চ রাত আমাদের বলে দেয়। ওই দিন রাতে ঢাকা শহরে শুরু হয় গণহত্যা, ধর্ষণ। তাজা প্রাণ লুটেছে মাটিতে। তারপর বাংলার দামাল ছেলেরা ভয় পায়নি। বরং নয় মাস নিজের শেষ রক্ত দিয়ে লড়ে গেছে দেশের জন্য, একটি সুন্দর লাল সবুজের পতাকার জন্য। এর পেছনে যে শক্তিটি কাজ করেছে তা হলাে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কো বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ৪২৭টি প্রামাণ্য ঐতিহ্যের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর এই ৭ মার্চের ভাষণটি প্রথম অলিখিত ভাষণ। সংস্থাটি বিশ্বের ৭৮টি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল, নথি ও বক্তৃতার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণও অন্তর্ভুক্ত করে। এটা নিঃসন্দেহে সমস্ত বাঙালির জন্যই গৌরবের বিষয়। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত এই ঐতিহাসিক দলিলটি ১২টি ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশ্ববাসীর নিকট এক আলোর দিশারি হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক এই ভাষণ বিশ্ববাসীর জন্যও প্রেরণার চিরন্তন উৎস হয়ে থাকবে। এই একটি মাত্র ভাষণ পাল্টে দিয়েছে একটি দেশের মানচিত্র, জন্ম দিয়েছে একটি জাতীয় পতাকা আর তৈরি করেছে নতুন এক জাতীয় সঙ্গীত। ৭ মার্চের এ ভাষণ শুধুমাত্র বাঙালি জাতির জন্যই নয় বরং বিশ্বমানবতার জন্যও প্রেরণার চিরন্তন উৎস হয়ে থাকবে।
বর্তমান নতুন প্রজন্মের কাছে এই ভাষণ প্রেরণার উৎস। যতদিন যাবে নতুন প্রজন্মের কাছে ৭ মার্চের ভাষণ অনুপ্রেরণার সারথি হিসেবে কাজ করবে। তরুণ প্রজন্ম এই ভাষণের প্রেরণায় জাতির জনকের সোনার বাংলাকে বিশ্বের বুকে একদিন উজ্জ্বল-ভাস্কর হিসেবে তুলে ধরবে। আমরা যারা স্বাধীনতার পরে জন্মগ্রহণ করেছি এ ভাষণটি সরাসরি দেখতে বা শুনতে পারিনি। কিন্তু আজও যখন এই ভাষণ শুনি, আমরা উজ্জীবিত হই। নব উদ্যমে এগিয়ে চলার প্রেরণা পাই। ভাষণটি বর্তমান প্রজন্মকে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে কিভাবে প্রতিবাদী হতে হয় সে শিক্ষা দেয়। কিভাবে মাথানত না করে অবিচল থাকতে হয় আর কিভাবে সামনে দিকে এগিয়ে যেতে হয় সে বিষয়গুলোও সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। ভাষণটি যতবার শোনা হয়, ততবারই নতুন নতুন ভাবনার তৈরি হয়। এর প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য একেকটি স্বতন্ত্র অর্থ বহন করে, নতুন বার্তা দেয়। জ্বালাময়ী এ ভাষণ নতুন প্রজন্মকে শিখিয়েছে কিভাবে গণতান্ত্রিক উপায়ে সামনে এগিয়ে যেতে হয়, অন্যের মতামতকে প্রাধান্য দিতে হয়। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ না দিয়ে, উসকানি না দিয়ে কিভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয় সেই শিক্ষা দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। আর সেজন্যই এই ভাষণ তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে, প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে, এগিয়ে যাওয়ার শক্তি যোগায়।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়