দেশবিরোধী চক্রান্ত ও বাক স্বাধীনতার সীমারেখা
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১১:০৬
করোনার সংক্রমণে সংকট নিরসনে মতভেদ ভুলে যখন একে অপরের সহযোগী হওয়ার কথা ছিল, তখন বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে একটি গোষ্ঠীকে অতিমাত্রায় তৎপর হতে দেখা যায়। অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির প্রয়াসে গুজব ও বিভ্রান্তিকর প্রচারণাই ছিল তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য।
বাক-স্বাধীনতা ও নৈতিকতা
‘জন্ম ও মৃত্যু আল্লাহর হাতে, করোনা ভাইরাস হচ্ছে দুর্নীতি ও লুটপাটের বাহানা’– এ জাতীয় তথ্য দিয়ে অপপ্রচার শুরু হলেও পরবর্তীতে ‘করোনায় বাংলাদেশে ২০ লাখ মানুষের মৃত্যু হবে’– এমন অপপ্রচার শুরু হয়। শুধু করোনাতেই এই অপপ্রচার সীমিত ছিল না। তথাকথিত লেখক, ব্লগার সাংবাদিক ও শিক্ষিতদের নিয়ে পরিচালিত পেইজে অকথ্য ভাষার গালি ব্যবহার অচিন্তনীয় হলেও, উচ্চারণের অতীত ভাষা ব্যবহার করে সরকার বা আওয়ামী লীগের প্রতি বিদ্বেষের পরিচয় দেয়া হয়েছে ‘I am Bangladeshi’ নামের পেইজে। জাতির পিতা, প্রধানমন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্ম সহ বিভিন্ন বিষয়ে কটূক্তি ও কটাক্ষ করা সহ ঘৃণ্য অপপ্রচার চালানো হয়।
করোনা নিয়ে বিভ্রান্তি
করোনা মহামারির শুরুতে প্রচার করা হয়েছিল মুজিববর্ষ পালনের জন্য দেশে করোনা থাকার কথা আড়াল করা হচ্ছে। গত বছর ১৪ মার্চ করোনার কারণে শেখ হাসিনা যখন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী তথা মুজিববর্ষের সকল অনুষ্ঠান স্থগিত করেন, তখন প্রচার করা হয়েছে, নরেন্দ্র মোদীর আগমনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কারণে করোনার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে ‘দেশে ২০ লাখ মানুষের মৃত্যু হবে’ এই মর্মেও অপপ্রচার চালানো হয়। অপপ্রচার করোনার সীমা ছাড়িয়ে অশালীন গালিগালাজেও পরিণত হয়।
বঙ্গবন্ধু কেন আক্রমণের উপলক্ষ?
‘I am Bangladeshi’ পেইজ থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বরাবরই কটূক্তি করা হয়েছে। মুজিববর্ষের সকল অনুষ্ঠান স্থগিত করার পরও “গজববর্ষ” বলে কটাক্ষ করে পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। এর আগে ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদণ্ড করা হলেও “ধর্ষণবর্ষ” বলে কটাক্ষ করা হয়েছিল। জামায়াত শিবিরের স্টাইলে ইতিহাস নিয়ে করা হয়েছে বিকৃতি। এই পেইজের উদ্দেশ্য যদি বাংলাদেশ ও এর জনগণের মঙ্গলের জন্য হতো তাহলে বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিদ্বেষের কারণ কি এটা খুব সহজাত একটি প্রশ্ন!
ওরা কারা?
বাংলাদেশ, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও হাঙ্গেরি থেকে পরিচালিত ‘I am Bangladeshi’ পেইজের কন্টেন্ট তৈরি ও প্রচারণায় যারা ভূমিকা রাখেন তাদের মধ্যে মুশতাক আহমেদ, কার্টুনিস্ট কিশোর, ডিএসইর সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান, রাষ্ট্রচিন্তার দিদারুল ভূঁইয়া, প্রতারক খ্যাত সায়ের জুলকারনাইন সামি, আসিফ মহিউদ্দিন, তাসনিম খলিল, আসিফ ইমরান, ওয়াহিদ উন নবী স্বপন, সাহেদ আলম ও ফিলিপ শুমাখার অন্যতম। রাষ্ট্র/সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অভিপ্রায়ে গুজব, অপপ্রচার ও বিভ্রান্তি ছড়ানো ও দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে ২০২০ সালের মে মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এই পেইজের সাথে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা হয়। কিন্তু এই পেইজের অপতৎপরতা অব্যাহত থাকে।
অভিযোগের তথ্য-প্রমাণ
গোয়েন্দা হওয়ার প্রয়োজন নেই, খোলা চোখে পর্যবেক্ষণ করলেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের প্রমাণ পাওয়া যায়। কোনো বিষয়ে ‘I am Bangladeshi’ পেইজে পোস্ট হওয়ার সাথে সাথেই তা সংশ্লিষ্টদের শেয়ার করতে দেখা গেছে। কখনো পেইজে প্রকাশের আগেই অভিযুক্তদের টাইমলাইনে তা দেখা যায়। এদের অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে কয়েক বছর ধরে, অনেকের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বেও মামলা হয়েছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোকে কোনোভাবেই সাধারণ সমালোচনার আওতায় আনা যায় না, বরং এটি ছিল ক্ষোভ, বিদ্বেষ ও হিংসার বহিঃপ্রকাশ।
কার্টুনিস্ট কিশোর তার ‘আমি কিশোর’ ফেসবুক অ্যাকাউন্টে বাংলাদেশ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ধর্ম এবং বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে কটাক্ষ করে কার্টুন আঁকতেন। করোনাভাইরাস নিয়ে গুজব সৃষ্টিতে তার কার্টুন ও পোস্টার ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছিল। এছাড়া মুশতাক তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে বিতর্কিত পোস্ট ও কিশোরের পোস্ট শেয়ার করতেন। এছাড়া কার্টুনিস্ট কিশোর, তাসনিম খলিল, জুলকারনাইন, শাহেদ আলম ও আসিফ মহিউদ্দিনের মধ্যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চ্যাটিং এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। দিদারুল, মিনহাজ ও মুশতাকের হোয়াটস অ্যাপ ও ফেসবুক মেসেঞ্জারে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চ্যাটিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অভিযুক্তদের যোগসূত্র– ক্ষোভ কার বিরুদ্ধে?
অনলাইন বা সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় অনেকেই অবগত যে বিদেশে পালিয়ে থাকা কয়েকজন ব্যক্তির সমন্বয়ে পরিচালিত অপপ্রচারের এই সিন্ডিকেটের প্রসারে ভূমিকা রাখছেন কথিত সাংবাদিক শহীদুল আলম ও ডেভিড বার্গম্যানের মতো নামধারী সুশীল, বিতর্কিত গণমাধ্যম আল জাজিরা এবং নেত্র নিউজের তাসনিম খলিল। তারা আগে থেকেই বাংলাদেশ বিদ্বেষী এবং একপেশে অবস্থানের কারণে সমালোচিত। কখনো তারা যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়েছে, কখনো আন্তঃরাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পক্ষে এডভোকেসি করেছে, সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করেছে, কখনো জাতির পিতা, প্রধানমন্ত্রী, দেশের সর্বোচ্চ আদালত এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মনগড়া অভিযোগ তুলে কটাক্ষ ও কটূক্তি করেছে, বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে।
রাষ্ট্রদ্রোহের সংযোগ সমীকরণ
লেখক মুশতাক আহমেদ, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন, খালেদা জিয়ার সাবেক বডিগার্ড ওয়াহিদ উন নবী স্বপন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সাবেক ছাত্র। বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্র মিশনের অন্যতম সমন্বয়কারী লেখক মুশতাক আহমেদ জালিয়াতি ও প্রতারণামূলক কার্যক্রমের জন্য বেছে নেন হাঙ্গেরি নিবাসী প্রতারক সায়ের জুলকারনাইন সামিকে। মুশতাকের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সম্পর্কযুক্ত আহমেদ কবির কিশোর বেতনভুক্ত একজন হিসেবে পেইজের জন্য কন্টেন্ট তৈরি করতো। রাষ্ট্রচিন্তার দিদারুল আলম, সাংবাদিক শাহেদ আলম ও ফিলিপ শুমাখার গত জাতীয় নির্বাচনের আগে থেকেই সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে জড়িত। পরবর্তীতে আল জাজিরার বানোয়াট ফিল্মের সূত্র ধরে নেত্র নিউজের তাসনিম খলিল, বিতর্কিত সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়। এছাড়া ইসলাম বিদ্বেষী ও স্বাধীন জুম্মু ল্যান্ডের সমর্থক হিসেবে তাসনিম খলিল, কিশোর, মুশতাক, শহীদুল আলম ও আসিফ মহিউদ্দিন একে অপরের ঘনিষ্ঠ ছিল। নেত্র নিউজের স্বীকারোক্তি অনুসারে তারা যুক্তরাষ্ট্রের NED নামীয় একটি সংগঠনের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত যাদের বিরুদ্ধে ভারত, রাশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকাসহ কয়েকটি দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরিতে অর্থায়নের অভিযোগ রয়েছে।
বিদ্বেষ থেকে দ্বৈতনীতি
মুক্তমত বা বাক-স্বাধীনতা মানে যা ইচ্ছা তা বলা বা লেখা নয়। ইউরোপে কেউ চাইলেই হলোকাস্ট নিয়ে সমালোচনা করতে পারে না, ইংল্যান্ডে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের নিয়ে সমালোচনা আইনত দণ্ডনীয়। প্রতিটি দেশেই রাষ্ট্রদ্রোহিতার সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা রয়েছে। এছাড়া অশালীন ও ভিত্তিহীন কিছু প্রচার বা প্রকাশ করা নৈতিকতা-বিরুদ্ধ বিষয়। মুজিববর্ষের ব্যয়ের কথা বলে সমালোচনা করে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক মুজিববর্ষ উদযাপনের জন্য আর্থিক উপহারের বিষয় এড়িয়ে যাওয়া নিরপেক্ষতা নয়। মুজিববর্ষ উপলক্ষে গৃহহীনদের আশ্রয় দেওয়ার প্রশংসা করতে তাদেরকে দেখা যায় নি। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মতো যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়ে কটাক্ষ করা হয়েছে। করোনায় ২০ লাখ মানুষের মৃত্যুর গুজব ছড়ালেও করোনা নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রধানমন্ত্রীর যে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ, বিশ্বের ১০টি কোভিড ভ্যাকসিন প্রদানকারী দেশের একটি হওয়া, করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক প্রণোদনা বা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার মতো মানবিক বিষয়গুলো নিয়েও কখনো তাদেরকে সাধুবাদ দিতে দেখা যায়নি। বরং বানোয়াট বিষয়ের উপর ভিত্তি করে আল জাজিরায় প্রদর্শনের জন্য হাস্যকর একটি ফিল্ম নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে প্রধানমন্ত্রীর ন্যূনতম সংশ্লিষ্টতা দেখাতে ব্যর্থ হলেও নামকরণ করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নামে। একচোখা সমালোচনার যে ধারাবাহিকতা সেখানে এই অপপ্রচারকারী চক্রের নেই কোনো দেশপ্রেম, নেই নৈতিক কাণ্ডজ্ঞান, না রয়েছে অথেনটিক তথ্যের গ্রহণযোগ্য উপস্থাপন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের মডেল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আর্থ-সামাজিক, যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন সহ মহামারি ও দুর্যোগ মোকাবেলায় অনন্য নজির স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার বিপরীতে অপপ্রচার ও গুজবকে কেন্দ্র করে চক্রান্তকারী ও স্বাধীনতা বিরোধী গোষ্ঠীর যে অপতৎপরতা তার উপসংহার একটিই হতে পারে, আর তা হচ্ছে বাংলাদেশ বিরোধিতা। যে কোনো বিষয়ে গঠনমূলক সমালোচনা হতে পারে সাফল্যের যোগসূত্র। কিন্তু সমালোচনা যখন বিদ্বেষে পরিণত হয় তখন তাতে আর কোনো মঙ্গল নিহিত থাকে না। সমালোচনা করার অধিকার অবশ্যই বাক-স্বাধীনতা, কিন্তু সেটি যদি বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ হয় তখন তা আপত্তিকর ও অশুভ পাঁয়তারা হিসেবে গণ্য হয়।