নারীর প্রতি সহিংসতার শেষ কোথায়?
৮ মার্চ ২০২১ ২২:৫৭
পৃথিবীতে সন্তান ধারণ এবং লালন-পালন করতে যার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি সে নারী। জীবনব্যাপী একজন নারী নানা ভূমিকা পালন করেন। কখনো মা, বোন, বন্ধু, সহকর্মী, স্ত্রী হিসাবে তারা কর্মে, সংগ্রামে এগিয়ে যান অবিরাম। আজকের পৃথিবী বিনির্মানে যারা ছিলেন পুরুষের সহযোগী, অনুপ্রেরণার অসীম আধার হয়ে। কিন্তু বাস্তবের মাটিতে, সবকিছু ব্যবস্থাপনায় তারা অতুলনীয় হলেও দিনশেষে তাঁরাই সহিংসতার শিকার।
স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবীর গতিধারা আগাতে থাকলে আজ নারী সংক্রান্ত ধ্যান-ধারণা আলোচনার বিষয়বস্তুু হতো না। অধিকার রক্ষার মূলমন্ত্র নিয়ে নারী দিবস ঘোষণারো হয়তো প্রয়োজন পড়তো না৷ ধর্ম, নৈতিকতার ব্যাখাগুলো আমরা সর্বদা মানলেও যেন এক্ষেত্রে এসে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়ায়। অনেকক্ষেত্রে, আমরাই এসবের অপব্যাখা দিয়ে মিল-তালে নারী নির্যাতন কিংবা শোষণকে বৈধতা জানাই শুধুই নিজ স্বার্থে, নিচুভাবে নিজ দানবীয় অস্তিত্ব রক্ষার্থে।
অনেকেই প্রকাশ্যে না হলেও আড়ালে হয়তো এমনটা ভাবেন যে বিশ্ব এগিয়ে চলেছে আপন মহিমায়। বিজ্ঞান, প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পৃথিবী এসেছে হাতের মুঠোয়। তবে, সব কাজ ছেড়ে দিবসকেন্দ্রিক উদযাপনে শুধুমাত্র সভা সেমিনার বা লেখনী দিয়ে নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরা সময়ের অপচয়। বাস্তবতা হলো- হিলারি ক্লিনটন, জেসিন্ডা আরডেন, কামালা হ্যারিস, মালালা কিংবা নাম না জানা অসংখ্য নারী স্বাবলম্বী হয়েছে ঠিকই তবে তারা কিন্তু পুরো সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করে না। বরং, তাঁদের সফলতা ও স্বাবলম্বী হওয়ার মন্ত্র দ্বারা অন্যদের অনুপ্রাণিত করে মাত্র। বাস্তবের মাটিতে সাধারণ নারীদের অবস্থা অবশ্যই ভয়াবহ। দেশকাল ভেদে নির্যাতনের পরিসংখ্যানের পার্থক্য পাওয়া যাবে হয়তো। তবে, সহিংসতা মুক্ত কোন এলাকা খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।
স্বভাবতই বাংলাদেশও সেদিক থেকে আলাদা নয়। ধর্ষণ, বাল্যবিবাহ, যৌতুকসহ কতশত শারীরিক, মানসিক নির্যাতন বয়ে বেড়ান নারীরা তা বলে শেষ করা যাবে না। শিক্ষার অগ্রগতির ফলে বাল্যবিবাহ, যৌতুকের হার কমছে সত্যি তবে তা সংখ্যা বিবেচনায় একদম কম নয়। WHO (বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা) এর মতে, বর্তমান বাংলাদেশে ২৮ মিলিয়ন শিশু বয়ঃসন্ধিকাল অতিবাহিত করছে। যাদের মধ্যে ১৩.৭ মিলিয়ন মেয়ে ও ১৪.৩ মিলিয়ন ছেলে। এসব মেয়েদের ৩৩ শতাংশের বিয়ে হয় ১৫বছর বয়সে বা তার পূর্বে। বিবাহিত এসব মেয়েদের মধ্যে ৬০ শতাংশ মেয়েই ১৯ বছর বয়স বা তার পূর্বেই মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করেন। যা অবশ্যই বিরাট ঝুঁকি। ২০ বছরের আগে গর্ভধারণ করা একদমই সঠিক সিদ্ধান্ত নয় । এতে নবজাতক ও মা দুজনের জীবনই ঝুঁকিতে পড়ে। সাম্প্রতিক আরেকটি রিপোর্টে বলা হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার ৩৭ শতাংশ নারী মাতৃত্বজনিত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে!
বাল্যবিবাহের মতো কমতে পারতো ধর্ষণ নামক নামক আরেক কুপ্রথা। শিক্ষা, বিজ্ঞানের অগ্রগতি ধর্ষণ কমাতে পারে নি বরং উল্টো বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। অশ্লীল নাটক, পর্ণ ভিডিওর সহজলভ্যতা এসবকে আরও উস্কে দিচ্ছে ভয়াবহভাবে। একসময় পাড়ার বখাটে ছেলেদের এসব কাজের জন্য দোষী বলা হতো। আজ বখাটের স্থান দখল করে নিয়েছে সমাজের প্রায় সবাই। শিক্ষক, ইমাম, গির্জার ফাদার, আত্মীয় এমনকি পিছিয়ে নেই অনেকক্ষেত্রে বাবারাও! পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর ৫ হাজার ৪০০ জন নারী এবং ৮১৫ জন শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ২০১৮ সালে যার পরিমাণ ৩ হাজার ৯০০ এবং ৭২৭। নির্যাতনের শিকার শুধু নয়, অনেকে এতে করে হারিয়েছেন মহামূল্যবান জীবন। গতবছর নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গিয়েছেন ২৬ নারী এবং ১২ শিশু। [সূত্র; বাংলাদেশ পুলিশ]। এমন অসংখ্য নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা আমাদের অজানাই থেকে যায়।
২০২০ সালে বেশকিছু ধর্ষণের ঘটনা সাড়া ফেলেছিল। বছরের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ধর্ষণ, বছরের শেষে সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে ধর্ষণ। পরিস্থিতি বিবেচনায় বাড়ানো হয়েছে ধর্ষণের শাস্তি ( সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড)। পরিস্থিতি আদৌ বদলেছে কি?
বিচারহীনতার এ সংস্কৃতি তো দীর্ঘদিনের। রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় নানা অপব্যাখার আড়াল থেকে মুক্ত হয়ে নারী যেদিন মুক্ত হবে, থাকবেনা ধর্ষণ সেদিন স্বার্থক হবে নারী দিবস। বর্তমানে সোশাল মিডিয়া নামক যোগাযোগ গড়ে ওঠায় মানুষের মাঝে বাস্তববিবর্জিত দেখানোর প্রবনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাইতো বিচারের চেয়ে বিচার প্রক্রিয়া বা নানা বিষয় নিয়ে অযথাই কথাবার্তা চলে বছরের পর বছর। ধর্ষণ পরবর্তী অবস্থায় প্রথাগত ভাবনা থেকে আমরা এখনো বের হতে পারি নি বরং যুক্ত হয়েছে নতুন নানা অপ্রয়োজনীয় বিষয়৷
প্রকৃতপক্ষে, নারী যেদিন বন্ধ জাল ছিন্ন করে বের হবে, দূর হবে নারীর প্রতি সকল সহিংসতা সেদিন আন্তজার্তিক নারী দিবসের প্রকৃত মাহাত্ম্য হবে প্রতীয়মান। নারী দিবসের দিনকেদ্রিক শুভেচ্ছা, হলাম না হয় একটু প্রথাগত কাঠামোর বলি। তবে, অবস্থার উত্তরণ চাই সবসময়।
লেখক- শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
সারাবাংলা/আরএফ