বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির অগ্রদূত হয়ে জন্মেছিলেন
১৭ মার্চ ২০২১ ১১:২৮
বাঙালি জাতির ইতিহাসে অনেক জাতীয় নেতার আবির্ভাব ঘটেছে। জাতীয় জীবনে অমূল্য অবদানের জন্য তারা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার অবিসংবাদিত জাতীয় নেতা। দেশ ও জাতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। এ চার মহান জাতীয় নেতার মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা। স্বাধীনতা সংগ্রামে যিনি অবিসংবাদিত বা মহান নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পান, তাকেই জাতির জনকের অভিধায় বিভূষিত করা হয়।
‘সাত কোটি বাঙালির ভালোবাসার কাঙ্গাল আমি। আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারব না। বাঙালির ভালোবাসার ঋণ বুকের রক্ত দিয়ে শোধ করবো ইনশাআল্লাহ’—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধুর শুধুমাত্র এই কথাটুকু দ্বারা আমরা এটা বুঝি যে,বাংলার মানুষকে তিনি অনেক বেশি ভালোবাসতেন। তিনি বলেছেন, ‘সাত কোটি বাঙালির ভালোবাসার কাঙ্গাল আমি’, বাংলার মানুষকে বাংলার মাটিকে কতটা ভালোবাসলে একজন মানুষ অন্তরের অন্তস্তল থেকে এমন কথা বলতে পারে!
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০১তম জন্মবার্ষিকী আজ। যিনি ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মূলত শেখ মুজিবুরের জন্মের মাধ্যমেই বাঙালি পেয়েছিল স্বাধীনতা। বাঙালি পেয়েছিল স্বাধীন দেশ, বাংলাদেশ। আজ থেকে শত বছর পূর্বে যদি বাংলার বুকে শেখ মুজিবের জন্ম না হতো তাহলে হয়তো পরাধীনতার অন্ধকারেই থেকে যেতে হতো আমাদের আরও একশ বছর। শেখ মুজিবের এমন অবিশ্বাস্য নেতৃত্ব ক্ষমতা, এমন দূরদর্শিতা যার অবদান এই বাংলার মানুষ কখনও শোধ করতে পারবে না।
শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও রাজনীতি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাঙালির হাজার বছরের আশা-আকাঙ্ক্ষা বেদনা-বিক্ষোভ ও আবহমান বাংলার ঐতিহ্যকে তিনি নিজের চেতনায় আত্মস্থ করেছেন। তার কণ্ঠে বাঙালি জাতির সার্বিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক।
ছাত্রজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ব্রিটিশ আমলের শেষ পর্যায়ে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের নেতৃস্থানীয় ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল হয় ঢাকা। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। ১৯৪৮ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। এ বছরই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয় এবং ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের দায়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। জেলে থেকেই শেখ মুজিব ১৯৪৯ সালে গঠিত আওয়ামী লীগের যুগ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সাল থেকে তিনি এ দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবং ১৯৬৬ সালে সভাপতি নির্বাচিত হন। ছয় দফাকে কেন্দ্র করে তার রাজনৈতিক খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এবং তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে আরােহণ করেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী।
রাজনৈতিক বিশ্বশান্তি আন্দোলনের অন্যতম সেনালী এবং সমকালীন বিশ্বের মানবজাতির মুক্তিসংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ উৎসর্গীকৃত সন্তানদের একজন। শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ও স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা—জাতির জনক।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানি শাসকশ্রেণীর বৈষম্য-নীতি, শোষণ ও অগণতান্ত্রিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামের কথাই বারবার ঘুরে-ফিরে আসে। দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, বাঙালি জীবনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেন বঙ্গবন্ধু। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালির জন্য ভেবেছেন— কোনো শ্রেণী, সংগঠন, পেশা বা কোনো গোষ্ঠীর কথা আলাদা করে ভাবেননি। কিন্তু এসব সামাজিক-আর্থিক অবস্থানের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সমস্যাগুলোকে তার কর্মে ও ভাবনায় তিনি স্থান দিয়েছিলেন।
পাকিস্তান গোঁড়া থেকেই পূর্ব বাংলার ক্ষেত্রে বৈষম্যনীতি অনুসরণ করে আসছিল। রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বৈষম্য ক্রমাগত বাড়তে থাকে। পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী ব্রিটিশের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পূর্ব বাংলাকে তাদের কাঁচামাল সরবরাহের উৎকৃষ্ট কেন্দ্র এবং তাদের শিল্প পণ্যের বাজার হিসেবে ব্যবহার করেছিল। পাকিস্তানি শাসন ও শােষণের ফলে পূর্ব বাংলার সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে থাকে। পূর্ব বাংলার অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে মরুভূমি পশ্চিম পাকিস্তান হয় সুজলা- সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমার সােনার বাংলা পরিণত হতে থাকে।
পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর সীমাহীন শােষণের প্রতিকারকল্পে এবং বাঙালির স্বাধিকারের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি ঘােষণা করেন। এটাই ছিল বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম এবং যৌক্তিক প্রস্তাবনা। আপাতদৃষ্টিতে ছয় দফা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্য নিরসনের স্মারকপত্র হলেও এর পেছনে প্রচ্ছন্নভাবে লুকিয়ে ছিল স্বাধীনতার ইঙ্গিত । এতােদিনে বাঙালি জাতির সুপ্ত অথচ জীবন্ত জাতীয়তাবােধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল এক দুর্বার পতিতে। এ কারণে একদিকে ছয়দফা বাঙালির প্রাণের দাবিতে পরিণত হলাে, অন্যদিকে শেখ মুজিব হয়ে উঠলেন বাঙালি জাতির নন্দিত নেতা। ছয় দফাভিত্তিক দুর্বার এ আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য সরকার দমননীতির আশ্রয় নেয়, গ্রেফতার করে বঙ্গবন্ধুকে। তাকে প্রধান আসামী করে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে। আগরতলা মামলা দায়ের করা হয়। আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের দাবি যুক্ত হয়ে আন্দোলন অর্জন করে তীব্র ব্যাপকতা।
এবার আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়ে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। পরিস্থিতি সরকারের আয়ত্তের বাইরে চলে যাওয়ায় আইয়ুব খান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে রাজনীতি হতে বিদায় গ্রহণ করেন। ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করে ১৯৭০ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘােষণা দেন। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে জয়লাভ করে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। এ অভূতপূর্ব বিজয়ে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং লিপ্ত হয় জনতার রায়কে বানচাল করার ষড়যন্ত্রে ।
বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে রেসকোর্স ময়দানে স্মরণাতীতকালের বৃহত্তম জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এ ভাষণ ছিল মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দিক-নির্দেশনা, বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের শাশ্বত প্রেরণার উৎস ও প্রতীক। স্বাধীনতার ঘােষণা ২৫ মার্চ কালরাতে পাকবাহিনী নিরীহ বাঙালিদের ওপর নারকীয় অভিযান শুরু করার পর রাত ১২:০৫ মিনিটে অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। রাত একটার সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল অনুপস্থিতি সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ও সর্বাধিনায়ক করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। তার নামানুসারে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানীর (মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা) নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের দখলে। কাজেই দেশ যুক্ত করতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়। এ মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক সর্বজনীন গণযুদ্ধ। ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিক, শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীসহ সকল স্তরের মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্ত ও দুই লক্ষ মা বােনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা অর্জন করি বিজয় ।
মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায় । এ যুদ্ধই বাঙালি জাতিকে তার স্বাধীনতা এনে দেয়। প্রাচীন যুগ থেকে বাঙালির স্বাধীন আবাসভূমির গড়ে তােলার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হলাে। এর জন্য তিতুমীর, হাজী শরিয়তুল্লাহ, ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা প্রমুখ সংগ্রামী বীর বাঙালি বিদেশি শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। সর্বশেষ পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসন-শােষণের ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘটনাবলি আবর্তিত হয়েছে তাকে কেন্দ্র করেই এবং তিনিই ছিলেন তার কেন্দ্রবিন্দু। বঙ্গবন্ধুর সম্মােহনী নেতৃত্ব জাতীয় ঐক্য ও সংহতি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে কাজ করেছে। বঙ্গবন্ধুই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা, তারই নামে চলেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়