বঙ্গবন্ধুকে শুধু মুখে নয়, বুকে লালন করতে হবে
১৭ মার্চ ২০২১ ১২:১৭
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ, পৃথিবীর মানচিত্রে এক নিভৃত গ্রামে এক মানব সন্তানের জন্ম হয়েছিল। সেদিন যে সন্তানটি পৃথিবীর আলো দেখেছিল তার পিতা মাতা বা আত্মীয়স্বজন কী সেদিন বুঝতে পেরেছিলেন এই সন্তান একদিন একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ প্রতিষ্ঠা করবে? সেদিনের বাবা মায়ের আদরের সেই খোকা একদিন এই ফরিদপুরের গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়াকে পৃথিবীর মানুষের কাছে এমনভাবে পরিচিত করে তুলবে? তার নেতৃত্বে একদিন দেশ স্বাধীন হবে? সেই খোকা শেখ মুজিবুর রহমান একদিন বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হবে। তাই হয়েছিলেন একদিন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার মহান স্থপতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। তার রাজনৈতিক দীর্ঘজীবনের সংগ্রামের ফসল এই স্বাধীন বাংলাদেশ । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগ নামক ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলটির প্রধান নেতা ও সভাপতি ছিলেন । সে সবের বাইরে তিনি দেশবাসীর কাছে বাঙালির কাছে জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধু হিসেবেই সমাধিক পরিচিত। বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মাত্র পঞ্চান্ন বছরের জীবনে তিনি চৌদ্দ বছরের বেশি সময় জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন। বাদবাকি রাজনৈতিক জীবনে জেলের বাইরে দিনগুলোতে পাকিস্তান আমলে এক দেড় বছর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সাড়ে তিন বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন । আর বাকি সময়গুলো বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। এই সময়ে তিনি তার শ্রম-ঘামে গড়া প্রাণের সংগঠন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে গণমানুষের দলে পরিণত করেছিলেন। তুলনামূলক অল্প সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু যা যা অর্জন করে গেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তিনি পাকিস্তানের বৃহৎ একটি অংশের মানুষকে শোষণ নিপীড়ন নির্যাতনের বিরুদ্ধে যেভাবে এক সুতোয় বেধেছেন এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে এবং নিজেকে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছেন তা ইতিহাসে খুব কমই দেখা যায় ।
বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল মানুষকে ভালোবাসা। তিনি তার দেশের মানুষকে যেমন ভালোবাসতেন তার দেশের মানুষও তাকে তেমনি ভালবাসতেন। মানুষের ভালোবাসাই ছিল বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের লড়াই সংগ্রামের মূল প্রেরণা। মানুষের ভালোবাসার কারণেই এবং তাদের জীবন বাজি রেখে লড়াই সংগ্রামের কারণেই ফাঁসির কাষ্ঠ থেকে ফিরে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর ফিরে এসেছিলেন বলেই তার নেতৃত্বে আমরা আমাদের শত শত বছরের কাঙ্ক্ষিত সেই স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমরা বঙ্গবন্ধুকে কী দিতে পেরেছি? বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধুকে কী দিতে পেরেছি? ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতের পর তার নামে রাজনীতি করে এই সমাজে আমরা অনেকেই এমপি, মন্ত্রী, চেয়ারম্যান,নেতা, মেয়র অনেক কিছুই হয়েছি। বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতের পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চতুর্থবারের মতো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। এই চারবারে প্রায় ৫০০ জন সংসদ সদস্য দেড় শতাধিক নেতা নতুন মন্ত্রিত্বের স্বাদ পেয়েছেন। বহু নেতা সিটি মেয়র, পৌর মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান,ইউপি চেয়ারম্যান নানা সংস্থার চেয়ারম্যানসহ অনেক কিছু হয়েছেন। সরকারি বেসরকারি বড় বড় পদ পেয়েছেন, নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা ভোগ করেছেন, অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুর শহিদ হওয়ার পরে তিন মাস যেতে না যেতেই তার চার জন সহকর্মী জেলখানার প্রকোষ্ঠে নির্মম নৃশংসভাবে জীবন দিয়েছেন। তারপরে আওয়ামী লীগের অনেক নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মী বিভিন্ন সময় সামরিক বেসামরিক স্বৈরাচারদের হাতে নির্মম নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন, সর্বস্বান্ত হয়েছেন। পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টের পর ১৯৮১ সালে তারই সুযোগ্যকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা যখন আওয়ামী লীগের হাল ধরে দেশে আসলেন, তারপর থেকেই তাকেও হত্যার উদ্দেশ্যে উনিশ বার আক্রমণ করা হয়েছে। একুশে আগস্টের মতো ঘৃণ্য গ্রেনেড হামলা করে তারেকসহ আওয়ামী লীগকে নিঃশেষ করে দেওয়ার চক্রান্ত ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে জননেত্রী শেখ হাসিনা এখনও বেঁচে আছেন এবং দেশের মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন। পঁচাত্তরের পরে যতদিন আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে ছিল ততদিন আওয়ামী লীগের শত শত নেতাকর্মী লড়াই-সংগ্রাম করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন, আহত হয়েছেন, অনেক কষ্ট নির্যাতন সহ্য করেছেন। যার ফলশ্রুতিতে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে আছে। যে কারণে অনেকেই এখন মন্ত্রী, এমপি, মেয়র, চেয়ারম্যানসহ নানা ধরনের পদ-পদবি নিয়ে আছেন।
বিশেষ করে বর্তমানে টানা তিন বারের মতো ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগে একটি বিশেষ সুবিধাবাদী শ্রেণী গড়ে উঠেছে সারা দেশে। কোনদিনও আওয়ামী লীগের লড়াই-সংগ্রাম নিপীড়ন নির্যাতন দেখেনি, নিজেরা নিপীড়ন নির্যাতন ভোগ করেনি, শুধুমাত্র ক্ষমতার স্বাদ ভোগ করেছে। আবার এর মধ্যে অনেকে আছে ক্ষমতার মসনদে বসে বঙ্গবন্ধুর নামে শুধুমাত্র ক্ষমতার ভোগ বিলাস লোভ লালসায় মত্ত হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ সংগ্রাম, জননেত্রী শেখ হাসিনার সেই অতীতের কষ্টকর দিনগুলোর কথা তারা প্রায় ভুলেই গেছে। বিশেষ করে লক্ষণীয়, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে একশ্রেণীর মোসাহেবি বাহিনী তৈরি হয়েছে। সরকারে এবং সমাজে এরা এখন দাপটের সাথে বিরাজ করছে। তারা কথায় কথায় বঙ্গবন্ধুর নাম জপে কিন্তু হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুকে লালন করে না। এক কথায় তারা বঙ্গবন্ধুর নাম বেচে খায়। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবন, শিক্ষা ত্যাগ তিতিক্ষা, যে নীতি আদর্শ রেখে গেছেন অনেকেই তা এখন লালন পালন করে না। কিন্তু কথায় কথায় বঙ্গবন্ধুর কথা বলে। বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানাতে হলে তাকে শুধু মুখে নয় বুকে লালন করতে হবে, ধারণ করতে হবে । বঙ্গবন্ধু সারা জীবন দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য যে সংগ্রাম করে গেছেন সেই সংগ্রামকে স্মরণ রেখে তার মতো সততা এবং দেশপ্রেম নিয়ে দেশের সেবা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু যেভাবে দেশের মানুষকে ভালোবেসেছেন দলীয় নেতাকর্মীদের ভালোবেসেছেন সেভাবে মানুষকে ভালোবাসতে হবে ।
আবার বঙ্গবন্ধু যেভাবে কর্মীদের ভালোবাসতেন খোঁজ খবর নিতেন এখনকার নেতাদের মধ্যে আর তেমনটা দেখা যায় না। তৃণমূলে হাইব্রিড নেতায় আওয়ামী লীগ ভরে গেছে। এসব নেতারা কর্মীদের খোঁজ নেয় না, এসব নেতাদের সাধারণ মানুষসহ দলের কর্মীরাও সম্মান করে না। স্বার্থের কাছে বন্দি হয়ে গেছে তথাকথিত এই নেতাদের ভালোবাসা, কর্মীদের প্রতি ভালোবাসা। আদর্শ দিয়ে এসব নেতাকর্মীরা পরিচালিত হয় না, হয় স্বার্থ দিয়ে। বঙ্গবন্ধুকে আমরা আমাদের নিজেদের কায়েমি স্বার্থ হাসিলের জন্য তার নাম ব্যবহার করি। মুখে মুখে বঙ্গবন্ধুর নামে ফেনা তুলে ফেলি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে প্রকৃত অর্থে বুকে ধারণ করি না, মনেপ্রাণে লালন করি না ।বঙ্গবন্ধুকে আমারা জানার চেষ্টা করি না, বঙ্গবন্ধুকে আমরা পাঠ করি না। আমরা আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনাকেও জানার চেষ্টা করি না। তিনি কী পরিমাণ দুঃখ-কষ্ট-নিপীড়ন-নির্যাতন সহ্য করে নিজের জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যকে পদদলিত করে পিতার স্বপ্ন পূরণে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। এই দীর্ঘপথে বার বার মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন কিন্তু পিছপা হননি। শেখ হাসিনার জীবনাচার, তার সততা, তার নিষ্ঠা ও দেশপ্রেমের ধারে কাছেও আমরা যেতে পারিনি । শুধু আমরা তার নাম ভাঙিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়েছি।
এখনও দলের মধ্যে বহু নেতা, মন্ত্রী, এমপি, কর্মী আছেন যারা দলের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। জেলজুলুম নির্যাতন ভোগ করেছেন। কষ্ট সহ্য করেছেন। তারা আজ হয়তো কিছুটা ক্ষমতার স্বাদ ভোগ করছেন, দেশের জন্য কাজ করছেন, কর্মীদের খোঁজ খবর নিচ্ছেন। কিন্তু টানা এই তিন মেয়াদে আরও অনেকেই এমপি-মন্ত্রী দলের নেতা পদপদবি পেয়েছেন তারা অতীতে দলের জন্যও কিছুই করেনি, তারা এখনো কর্মীদের চেনে না জানে না। কর্মীদের বিপদ আপদে পাশে নাই। অনেকেই আছেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ পরিপূর্ণ ধারণ করেন না, লালন করেন না। তারা বঙ্গবন্ধুকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করেন কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে বুকে লালন করেন না। তারা শুধু বঙ্গবন্ধুকে মুখে মুখে রাখেন, বুকে নয়। তাদের কিছু অনুসারী কর্মীও আছে, যারা আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকালীন সময়ে দলের সাথে যোগ হয়েছে। তারা ওই নেতার সৈনিক, তারা বঙ্গবন্ধুর বা শেখ হাসিনার সৈনিক নয়। তারা সুবিধাবাদী, বসন্তের কোকিল তারা সুদিনে থাকে দুর্দিনে থাকে না। তারা বঙ্গবন্ধুকে মুখে লালন করে হৃদয়ে লালন করে না, ধারন করে না ।বঙ্গবন্ধুকে মুখে নয়, বুকে লালন করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ