জন্মদিবসে তোমায় স্মরিণু, হে জাতির পিতা
১৮ মার্চ ২০২১ ০১:২৮
আজ থেকে ১০১ বছর আগের কথা। আজকের বাংলাদেশ তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবিভক্ত বাংলা।
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শেখ লুৎফুর রহমান আর সায়েরা খাতুনের ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পুরো নাম শেখ মুজিবুর রহমান, ডাক নাম খোকা। টুঙ্গিপাড়ার শেখ পরিবারের খোকা থেকে পরবর্তীকালে তিনি হয়ে উঠেন সমগ্র বাঙালি জাতির আশার বাতিঘর—বঙ্গবন্ধু।
১৭৫৭ সালে পলাশীর ময়দানে যে বাংলা পরাধীনতার বেড়াজালে বন্দী হয়, সে বাংলার মানুষকে তিনি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শেখান। রেসকোর্স ময়দানে তার সেই মর্মস্পর্শী বানী, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম! কোটি বাঙালিকে স্বাধীনতার পথে প্রেরণা যোগায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামটি তাই শুধুই নাম নয়, এ এক মহাকাব্য। যে মহাকাব্য বাংলার বুকে বাঙালি জাতির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে, যে মহাকাব্যের মাঝে বিদ্যমান বাঙালি জাতির অস্তিত্বের ইতিহাস।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শান্তির নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধে তিনি ছিলেন অবিচল চির সাহসী। স্বাধীনতা লড়াইয়ে অস্ত্র তুলে ধরতে তিনি বাংলার মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন, অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন।
বিশ্বশান্তির জন্যে তিনি চিরকাল আওয়াজ তুলেছেন। তিনি আওয়াজ দিয়েছেন সারা পৃথিবীর স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্যে, এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকায় জুলুমের শিকার, বঞ্চনার শিকার সেইসব মানুষের জন্য। ১৯৬৬ সালের ১৩ জুলাই কারাগারে বসে তিনি লিখেছেন কাশ্মীরের মানুষের অধিকার আদায় নিয়ে। স্বাধীনতার পর বিশ্বমঞ্চে তিনি ফিলিস্তিনে প্রতি সংহতি জানিয়েছেন, ইসরাইলি দখলদারিত্বের প্রতিবাদ জানিয়েছেন পরাশক্তিদের ভয়কে উপেক্ষা করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানুষের জন্যে জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি ছিলেন পৃথিবীর বুকে স্বাতন্ত্র্য আদর্শিক প্রবক্তা। তার রাষ্ট্রচিন্তা, সম্ভাবনা, অর্থনৈতিক চিন্তা, বিশ্বদর্শন, পররাষ্ট্রনীতি সবকিছুই ছিল অনন্য।
স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ও ষড়যন্ত্রকারী চিরকাল চেষ্টা করেছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কুৎসা রটানোর, গুজব প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করার। কারণ ষড়যন্ত্রকারীরা ভয় পায় মুজিববাদকে, যে মুজিববাদ মানুষের কথা বলে, যে মুজিববাদ কল্যাণের কথা বলে। বঙ্গবন্ধুর অন্যতম দর্শন হলো জাতীয়তাবাদ। তিনিই বাঙালি জাতীয়তাবাদের সফল রূপকার, এই জাতীয়তাবাদ বাঙালিকে বিশ্ববুকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সহিত মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখায়। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।
বঙ্গবন্ধুর জীবনের আরেকটি প্রধান দর্শন হচ্ছে সমাজতন্ত্র। বঙ্গবন্ধু পুঁজিবাদকে অপছন্দ করতেন, তাই বলে তিনি কমিউনিজমেও বিশ্বাসী ছিলেন না। তার নিজস্ব ব্যক্তিগত মতবাদ ছিল। তিনি রাশিয়া কিংবা চীন থেকে ধার করে আনা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন না। বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে শোষণহীন সমাজ এবং সম্পদের সুষম বণ্টন। দেশের প্রত্যেক মানুষকে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা দিতে পারে সেই সমাজতন্ত্র। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা গড়ার—যা হবে একটি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সমাজতন্ত্র আমরা দুনিয়া থেকে হাওলাত করে আনতে চাই না। একেক দেশ একেক পন্থায় সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলেছে। সমাজতন্ত্রের মূল কথা হলো শোষকহীন সমাজ। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে সেই দেশের কী আবহাওয়া, কী ধরনের অবস্থা, কী ধরনের মনোভাব, কী ধরনের আর্থিক অবস্থা, সবকিছু বিবেচনা করে ক্রমশ এগিয়ে যেতে হয় সমাজতন্ত্রের দিকে এবং তা আজকে স্বীকৃত হয়েছে’। কার্যত যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আপ্রাণ চেষ্টা করেন। বঙ্গবন্ধু কৃষি সমবায়, কৃষিতে ভর্তুকি ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় শিল্পোন্নয়নের দিকে দৃষ্টিপাত করেন। তিনি কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে গ্রামকেন্দ্রিক কৃষি উন্নয়নকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। বঙ্গবন্ধু কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন, পুনঃসংস্কার, উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, ইক্ষু গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ অনেক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি ও পুনর্জাগরণ করেন। এছাড়াও তিনি পাঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণের উদ্যোগ নেন। সীমিত সম্পদ ও দুর্যোগের ভার নিয়েই দেশের উন্নয়নে নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি। বঙ্গবন্ধু গুণী মানুষদের কদর করতে জানতেন। তিনি দেশের মেধাবী ও দক্ষ ব্যক্তিদের দেশ মেরামতে নিযুক্ত করেন। যুগোপযোগী শিক্ষাখাত গড়ে তুলতে নির্দেশনা দেন, থানা স্বাস্থ্য প্রকল্পও তারই পরিকল্পনা। তার সময়কাল হয়তো খুবই ক্ষুদ্র ছিল, এর মাঝে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত সামাল দিতে হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর সমর্থন করতেন ধর্মনিরপেক্ষতায়; কিন্তু সেই ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতার কথা বলে না, সেই ধর্মনিরপেক্ষতা সমাজে সকল ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ বসবাসের। ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে ব্যক্তিজীবনে ইসলাম ধর্মপালনকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে, হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রিস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধ তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই ধর্মনিরপেক্ষতা আছে’।
বঙ্গবন্ধু শান্তির ধর্ম ইসলামকে কখনও রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেননি। কিন্তু ইসলামের খেদমতে কাজ করেছেন, অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষকেও সম্মান করেছেন।
ইয়াসির আরাফাত যথার্থ বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে, ‘আপসহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য’।
মূলকথা বঙ্গবন্ধু সারাজীবন এক জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র ও শান্তিপূর্ণ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছেন। ১৯৭২ সালে সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া বিবিসির এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেন, “My greatest strength is the love for my people, my greatest weakness is that I love them too much.” বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ে তিনি জীবনের দীর্ঘ সময় কারাগারে থাকেন, জীবন দিয়ে ভালোবেসেছেন বাংলার মাটি ও মানুষকে।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ দু’টি নাম একে অন্যের অস্তিত্বের ধারক,পরিপূরক। আপনি বাম, ডান, মধ্য যে পন্থারই হন না কেন—বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুকে আপনার একত্রেই স্বীকার করে নিতে হবে।
১০১তম জন্মদিনে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি ও ভালোবাসা। জয় হোক মুজিববাদের। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়