বাংলাদেশ-নেপাল সম্পর্ক শুধুই সম্ভাবনার
২১ মার্চ ২০২১ ১৭:২৮
বাংলাদেশ ও নেপাল দক্ষিণ এশিয়ার দুই নিকটতম বন্ধুপ্রতিম ও শান্তিপ্রিয় প্রতিবেশী। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশের মধ্যে হাই প্রোফাইলের রাষ্ট্রীয় সফর বিনিময় হয়েছে। ২০১৯ সালে নেপাল সফর করেছেন বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে গুরুত্বপূর্ণ অতিথি হিসেবে বাংলাদেশ সফরে আসছেন নেপালের রাষ্ট্রপ্রধান শ্রী বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারী।
দুই দেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় নেপাল নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছিল, কিন্তু ১৯৭১-এ নেপালের পাকিস্তান দূতাবাসের এক কর্মকর্তা পদত্যাগ করলে নেপাল তাকে আশ্রয় দিয়েছিল। বিশ্বের সপ্তম দেশ হিসেবে ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় নেপাল। এর ফলে পাকিস্তান নেপালের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল কিন্তু নেপাল বাংলাদেশের পক্ষে অটল ছিল। ১৯৭৬ সাল থেকে ছয়টি রুটে নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ার পর থেকে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। ১৯৭৮ সালে নেপালের রাজা বীরেন্দ্রের ঢাকা সফরের মাধ্যমে সম্পর্ক আরও সমৃদ্ধ হয়। বর্তমানে দুই দেশই জাতিসংঘ, ডব্লিউটিও, সার্ক ও বিবিআইনের সদস্য। নেপাল ও বাংলাদেশ উভয় দেশই এলডিসি থেকে বের হওয়ার পথে রয়েছে। নেপাল সরকার ‘সুখী নেপাল, সমৃদ্ধ নেপাল’ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারও রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১ হাতে নিয়েছে। ফলে দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক বিস্তারে শুধুই সম্ভাবনার দুয়ার সামনে।
২০১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে হিমালয় কন্যা নেপালে পর্যটক গেছে ৪০ হাজার। বর্তমানে ৪-৫ হাজার নেপালি শিক্ষার্থী বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। নেপালে কর্মক্ষেত্রে যোগ দিয়ে এসব ডাক্তাররা প্রেসক্রিপশিনে লিখছেন বাংলাদেশি কোম্পানির ওষুধ। ফলে বাংলাদেশের ওষুধের ভালো একটা বাজার তৈরি হয়েছে নেপালে। বর্তমানে ৮টি কোম্পানি নেপালে ওষুধ রফতানি করে। দুঃখজনকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে কাঙ্ক্ষিত সাফটা চুক্তি না হওয়ায় দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য সম্ভাবনা নানাভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে দেশগুলো দ্বিপাক্ষিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতে যাচ্ছে। ভারতের সঙ্গে নেপাল ও ভুটানের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে, শ্রীলংকার সঙ্গে আলোচনাধীন। বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য নেপাল বাংলাদেশের সঙ্গে অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি বা পিটিএ স্বাক্ষর করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। গতবছর থেকে এই আলোচনা ব্যাপক মাত্রায় শুরু হলেও এখনও চুক্তিটি সম্পন্ন না হওয়ায় নেপালের পক্ষে হতাশা রয়েছে। নেপালের কাঠমুন্ডু পোস্ট এই নিয়ে কয়েকবার প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে। বর্তমানে নেপালিরা বাংলাদেশে রফতানি করতে চাইলে টোটাল চার্জ ১৩০-১৩৫ শতাংশ করে পড়ছে। ফলে বাংলাদেশে পণ্য বাড়িয়ে নেপালি ব্যবসায়ীরা লাভবান হতে পারছে না।
নেপাল কাছের দেশ হওয়ায় দেশটি থেকে আমরা সহজেই সবজি, ফল, হারবাল ও মসলা আমদানি করতে পারি। অন্যদিকে নেপালের বাজারে বাংলাদেশের প্রবেশ শুধু সম্ভাবনার। নেপাল ৯০ শতাংশ পণ্যের ক্ষেত্রে আমদানি নির্ভর। নেপাল দুই কোটি ৯০ লাখ জনসংখ্যার ও ৩০ বিলিয়ন ডলার অর্থনীতির দেশ। অনেকে মনে করেন নেপালের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কম। কিন্তু নেপালিরা বেশ সৌখিন জাতি। ফলে বাংলাদেশের ইলেকট্রনিকস পণ্য, সিরামিক পণ্য, গার্মেন্টস, ফার্নিচার ও দেশীয় পোশাক ব্র্যান্ডের ভালো বাজার হতে পারে নেপাল। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সে পথে বহুদূর এগিয়েছে। ২০১৯-এর বাংলাদেশ নেপালে ৫.২৯ বিলিয়ন ডলার রফতানি করেছে আর নেপাল রফতানি করেছে ৯৫৪ মিলিয়ন ডলার। কাঙ্ক্ষিত পিটিএ চুক্তি সম্পন্ন হলে দুই দেশের বাণিজ্যে বড় দিগন্ত সূচিত হবে। ভুটানের সঙ্গে পিটিএ চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ভুটান বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক দ্বিগুণ হয়েছে। কাঠমুন্ডু পোস্ট সেদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, নেপাল ইতিমধ্যে পিটিএ নিয়ে তাদের খসড়া পাঠিয়েছে, এখন তারা বাংলাদেশের সাড়ার জন্য অপেক্ষা করছে।
অনেকে মনে করে নেপালে পণ্য পাঠানো অনেক কঠিন কাজ। কিন্তু বাংলাবান্ধার নেপাল ওয়্যারহাউজে পণ্য দিয়ে আসলেই তা নেপাল পৌঁছে যায়, মাঝে ভারত চেকও করে না। ফলে নেপালে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার শুধুই সম্ভাবনাময়। তবে বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করতে হবে। বর্তমানে রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে সারা বিশ্বব্যাপী শোরগোল। ফলে মধ্যমসারির দেশসমূহ উন্নত ও প্রভাবশালী দেশের বিনিয়োগ নিতে সতর্ক থাকছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিনিয়োগকে সাদরে গ্রহণ করবে নেপালিরা।
দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের আরেক দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে বিদ্যুৎ আমদানি। প্রাকৃতিকভাবে নেপাল প্রায় ৪২ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ রফতানি করার সক্ষমতা রাখে। দ্রুত শিল্প বর্ধনশীল বাংলাদেশ সে বিদ্যুৎ আমদানি করতে পারে। ইতিমধ্যে ভারতের পক্ষে এই বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দেওয়া হয়েছে।
দুই দেশ মাত্র ২২ কিলোমিটার দূরে আর বাংলাবান্ধা থেকে নেপালের কাকঁরভিটা পর্যন্ত সড়ক পথের দূরত্ব ৩৯ কিলোমিটার। অনেকটা ঢাকার সঙ্গে কোনো শহরতলীর দূরত্বের মতো। তবে রেলপথও সম্ভাবনা যোগাচ্ছে। বাংলাদেশের চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার রোহনপুর থেকে ভারতের সিঙ্গাবাদ হয়ে যে রেল যোগাযোগ তাতে যুক্ত হতে চাইছে নেপাল। এই রেলপথে কাঠমুন্ডুর দূরত্ব হয় ২১৭ কিলোমিটার। চীন তিব্বতের লাসা থেকে নেপালের সীমান্ত শহর খাসা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করছে। নেপাল সে পথ কাঠমুন্ডু পর্যন্ত আনতে চায়। ফলে চেষ্টা ও ইচ্ছা থাকলে বাংলাদেশ কাঠমুন্ডু হয়ে চীন যেতে পারে।
বর্তমানে কাঠমুন্ডুর সঙ্গে ঢাকার আকাশপথে যোগাযোগ রয়েছে। নেপাল সেটিকে সিলেট ও চট্টগ্রামের সঙ্গেও প্রসারিত করতে চায়। তবে উভয় দেশের সম্পর্কে আরেকটি টুইস্ট হলো বাংলাদেশের সৈয়দপুর নেপালের বিরাটনগর বিমানবন্দরের যোগাযোগ স্থাপন। এই যোগাযোগে মাত্র ১৫ মিনিটে সৈয়দপুর থেকে নেপালে পৌঁছানো যাবে। দুই’দেশের পর্যটন শিল্প বিকাশ ও ব্যবসায়ীক সম্পর্কের উন্নয়নে যারা সড়ক পথের ট্রানজিট ভিসার ঝামেলা এড়াতে চান তাদের জন্য এই আকাশ যোগাযোগ এক স্বস্তির নিঃশ্বাস। উভয় সরকার এই সৈয়দপুর-বিরাটনগর আকাশ যোগাযোগের আন্তর্জাতিক শুল্ক প্রত্যাহার করতে পারে। সেটা হলে নেপালে বাংলাদেশি পর্যটক কয়েক লাখে পৌঁছাবে।
দুই দেশের সম্পর্কে আরেকটি সম্ভাবনা যোগাতে পারে ক্রিকেট। নেপালের প্রধান খেলা ফুটবলকে ছাড়িয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ক্রিকেট। ২০১৪ টি-টুয়েন্টিতে নেপাল হংকংকে হারিয়ে তাক লাগিয়ে দেয়। নেপালি ক্রিকেটার সন্দীপ লামিচান বিপিএল খেলে গেছে। ফলে নেপালের ক্রিকেট উন্নয়নে বাংলাদেশ হতে পারে নেপালের কাঙ্ক্ষিত বন্ধু।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও দু’দেশের মধ্যে অদ্ভুত মিল রয়েছে। দু’দেশই শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়া গঠনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নেপালে বর্তমানে ১ লাখ ২০ হাজার ‘ভুটানি’ ও ২৫ হাজার ‘তিব্বতি’ শরণার্থী রয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশেও প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বোঝা বইতে হচ্ছে। ফলে শরণার্থী ইস্যুতে উভয় দেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যৌথ অঙ্গীকারে আসতে পারে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক