ব্রিসবেনে আলোকিত বাংলাদেশের পতাকা
২৪ মার্চ ২০২১ ১৪:১৪
অস্ট্রেলিয়ায় বছর তিন দশক আছেন, এমন একজন নারী এ দেশে তার প্রথম দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করছিলেন। বলছিলেন, এদেশে এসে প্রথম নিউমার্কেটে গিয়ে চমৎকার একটা ডাইনিং টেবিলের কাভার কিনেছিলেন। বাড়ি ফিরলে তার স্বামী বলেন, ‘তুমি গোল ডাইনিং টেবিল কাভার কিনেছ কেন, ব্রিসবেনে আমাদের এই ডাইনিং টেবিলটা তো চারকোনা’। ওই নারী বলছিলেন, ‘আমি কিন্তু ভুল করে কিনিনি। আমার মাথায় এখানকার কোনো ডাইনিং টেবিলই ছিল না তখন, ছিল ঢাকায় ফেলে আসা আমার গোল ডাইনিং টেবিল। আমি তো নিশ্চিত ছিলাম, কিছুদিন পরই আমি ঢাকায় ফিরছি এবং গোল ডাইনিং টেবিলেই সাজবে আমার সংসার’।
তারপর ৩০ বছর পেরিয়ে গেছে, ঘটনাচক্রে তার আর ঢাকায় ফেরা হয়নি। কিন্তু প্রথম দিনগুলোয় কেনা সেই গোল ডাইনিং কাভারটি তিনি সযত্নে রেখে দিয়েছেন তার আলমারিতে। মাঝেমধ্যে বের করে দেখেন। সেই টেবিল কাভার এক অযাপিত জীবনের প্রতীক হয়ে আছে তার কাছে। প্রবাসে প্রায় সব বাংলাদেশির তেমন একটা গোপন আলমারি আছে, যেখানে তারা সঞ্চয় করে রাখেন যার যার নিজস্ব তেমন কোনো একটা গোল টেবিল কাভার। তাদের পায়ের নিচে মাতৃভূমি নেই ঠিকই, কিন্তু সবাই বুকের ভেতর একটা ছোট মাতৃভূমি নিয়ে ঘুরে বেড়ান। দেশ ত্যাগ করেন ঠিকই, কিন্তু প্রবাসে পুরোপুরি এসে পৌঁছান না। তাদের শরীর এসে পৌঁছায় নতুন দেশে, কিন্তু মনের ভেতর থাকে এক টুকরো বাংলাদেশ। অভিবাসীদের যাওয়া আছে, পৌঁছানো নেই।
প্রথম যৌবনের মান্না দে-কে ছাড়েননি হিম তুষারেও। কথা হয় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে, যিনি গত ১০ বছরে দেশে আসেননি, কিন্তু এই ১০টা বছরের বাংলাদেশের রাজনীতির প্রতিটি ঘটনার এনসাইক্লোপেডিক তথ্য আছে তার কাছে। ক্রিকেট মৌসুমে বাংলাদেশি ডাক্তার অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে ওটির পোশাক খুলেই প্রথমে মোবাইল ইন্টারনেটে গিয়ে খোঁজ নেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের স্কোর কত, এক পরিচিত যেদিন যুদ্ধাপরাধের রায় ঘোষণা হয়, তার আগের রাতে ঘুমান না, পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে কিছুক্ষণ পর পর দেখেন রায় পাঠ শুরু হয়েছে কিনা। ব্রিসবেনের একজনকে জানি, নাইট হলে কাজ সেরে গভীর রাতে বাড়ি ফিরে বাংলাদেশি টিভির চ্যানেলে চোখ রেখে রাতের পর রাত দেখেছেন দেশের করোনা পরিস্থিতি। পয়লা বৈশাখে অস্ট্রেলিয়াজুড়ে প্রায়ই থাকে ঠাণ্ডা, তবু পাঞ্জাবি আর শাড়ি পরে প্রবাসীরা মিলিত হন কারো বাড়িতে ইলিশ ভাজার আসরে।
স্বাধীনতার স্বর্ণকমল প্রাপ্তির মাহেন্দ্রক্ষণে গোটা বাঙালি জাতি এক অভূতপূর্ব আবেগের সাক্ষী। মুক্তিযুদ্ধ আজ অর্ধশত বছরে পা দিচ্ছে। তাৎপর্যের দিক থেকে বাঙালি জাতির কাছে একাত্তর সালের প্রতিটি দিন ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। মহান বাংলা ভাষা রক্ষার আন্দোলনের ভেতর উৎসারিত ১৯৭১-এর দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধের ফসল আজকের বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন ভূখণ্ড। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এমন একটি মাইলফলক, ৫০ বছর উদযাপিত হচ্ছে, কী গৌরব, কী উচ্ছ্বাস।
যারা প্রবাসে থাকেন, দেশের পতাকা, দেশের মাটি―তাদের ভালোবাসা আর তাদের শ্রদ্ধায় প্রতিনিয়ত উচ্ছ্বাসপূর্ণ থাকে। কোথাও একত্রিত হলে আলাপের মধ্যে ফেলে আসা জন্মভিটার আনন্দের স্মৃতি রোমন্থন করে। তাদের অনুভূতিগুলো জ্বল জ্বল করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার গৌরব উদযাপনের অসাধারণ গল্পটা তৈরি করেছেন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিরা। প্রচণ্ড মুগ্ধতা নিয়ে সেই গল্পের ছবিগুলো দেখছি।
২০১৮ সাল থেকে এ আয়োজনের চেষ্টা করা হলেও এবারই সম্ভব হলো। বেশ কয়েকদিন ধরে শুনেছিলাম এ আয়োজনের কথা। ভেতরে ভেতরে একটা উত্তেজনা কাজ করছিল। লাল-সবুজে আলোকিত হলো অস্ট্রেলিয়ার দু’টি ঐতিহাসিক স্থাপনা স্টোরি ব্রিজ ও ভিক্টোরিয়া ব্রিজ। কুইন্সল্যান্ডে শহর ব্রিসবেনের এ দু’টি উল্লেখযোগ্য স্থাপনা শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। অস্ট্রেলিয়ার কোনো বিশেষ স্থাপনা বাংলাদেশের পতাকার রঙ-এ আলোকিত করার ঘটনা এই প্রথম। এটাই সেখানকার বাঙালিদের স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে তারুণ্যের এক বাংলাদেশ গড়ার দেশপ্রেম। প্রিয় মাতৃভূমির মর্যাদা বৃদ্ধিতে ব্রিসবেন প্রবাসীদের অবদান অনুসরণীয় হয়ে থাকবে পৃথিবীর ভিন্ন প্রান্তের অন্যসব বাংলাদেশ কমিউনিটির জন্য।
ব্রিসবেন সিটি কাউন্সিলকে সঙ্গে নিয়ে ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এই স্বপ্নকে সত্যি করেছে ব্রিসবেনের সৃজনশীল বাংলাদেশিদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ইন ব্রিসবেন (ব্যাব) ও ড. জিশু দাস গুপ্ত। দিনের আলো যখন হারিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই মিটমিট করে জ্বলে ওঠে ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া লাল-সবুজ পতাকা। স্থানীয় সময় ২২ মার্চ সন্ধ্যা ৭টায় পূর্ণভাবে আলো জ্বলে ওঠে। তখন ব্রিসবেন নদীর জলে উজ্জ্বলভাবে প্রতিফলিত হয় বাংলাদেশের পতাকা, যেনো এক টুকরো লাল-সবুজ কাপড়। মুহূর্তেই উচ্ছ্বসিত হন স্থানীয় বাংলাদেশিরা। বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করা গর্বের ছবি ছড়িয়ে পড়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
এদিন ব্রিসবেনে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা মিলিত হন স্টোরি ব্রিজের নিচে। সারাদিন চলতে থাকা বৃষ্টি উপেক্ষা করে সবাই একসঙ্গে গলা মিলিয়ে গেয়ে ওঠেন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’। এ যেন অন্য অনুভূতি। বিদেশের মাটিতে নিজের দেশের পতাকা দেখতে পারার আনন্দ উপচে পড়ে সবার চোখেমুখে। ব্রিসবেনের স্নাতকোত্তর ছাত্র ও গিটারশিল্পী মুশফিকুর রহমান শোভন বলেছেন, ‘সবার দিকে তাকিয়ে কেবলই মনে হয়েছে, ব্রিজভর্তি বাঙালি, বুকভর্তি দেশপ্রেম ও ভালোবাসা। বিদেশের বুকে ও লাল সবুজের প্রতি এই ভালোবাসা দেখে মনটা আসলেই ভরে যায়’।
এদিকে ভিক্টোরিয়া ব্রিজেও দেখা মেলে আলোকিত বাংলাদেশের পতাকা। সেখানেও বসে বাঙালিদের মিলনমেলা। ব্রিসবেনে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা এ গর্বের মুহূর্তটি মিস করতে চাননি। তাই কয়েক দিন ধরে চলতে থাকা বৃষ্টি উপেক্ষা করে সবাই একত্রিত হন এই ব্রিজের কাছে।
এই আয়োজনের স্বপ্নদ্রষ্টা ড. জিশু দাস গুপ্ত, জেডি ভাই নামে ব্রিসবেন বাংলাদেশি কমিউনিটিতে যিনি ব্যাপক এবং আপনজন হিসেবে পরিচিত, তার সাথে এ আয়োজন নিয়ে কথা হচ্ছিল। তিনি বলেন, ‘২০১৮ সাল থেকে আমার ও কমিউনিটির সব সদস্যের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চেষ্টার ফলেই আমাদের এ অর্জন। আমরা চাই এ অর্জন ছড়িয়ে পড়ুক পৃথিবীর আনাচে-কানাচে। জ্বলে উঠুক বাংলাদেশের নাম’।
কম্পিউটার প্রকৌশলী ড. জিশু কুইন্সল্যান্ড সরকারের জাস্টিস অ্যান্ড অ্যাটর্নি জেনারেল ডিপার্টমেন্টে কর্মরত আছেন। এছাড়া তার উদ্যোগে কুইন্সল্যান্ডের ৩০টি ওয়েবসাইটে বাংলা ভাষা যুক্ত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে কুইন্সল্যান্ড পার্লামেন্টে তার নাম উল্লেখ করা হয়।
অস্ট্রেলিয়ায় বাংলা ভাষা প্রচলনের উদ্যোক্তা ড. জিশু দাস গুপ্তের প্রচেষ্টায় গত ২২ মার্চ বাংলাদেশ কমিউনিটির পক্ষ থেকে ব্রিসবেন মেয়রের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে লাল-সবুজের পতাকা হস্তান্তর করা হয়। আগামী ২৬ মার্চ রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্রিসবেন শহরের প্রাণকেন্দ্র এবং ব্যস্ততম এলাকা সিটি হলে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হবে।
ব্যাবের প্রেসিডেন্ট মুনির রহমান বলেন, ‘একজন গর্বিত বাংলাদেশি হিসেবে এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমাদের অনেক দিনের প্রচেষ্টার ফলে এ আয়োজন করা সম্ভব হয়েছে। এটি আমাদের সূচনা মাত্র। আমরা আগামী দিনে ব্রিসবেন তথা গোটা অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশকে তুলে ধরব আরও উঁচু থেকে উঁচুতে, যা হবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দেশের প্রতি দায়িত্ব এবং ভালবাসার দৃষ্টান্ত’।
বাংলাদেশের মানুষের দেশপ্রেমের কোনো তুলনা নেই। দেশের প্রশ্নে আবেগাক্রান্ত হন না, এমন মানুষ খুব কমই আছে। এই যে ক্রিকেট বলে আমরা পাগলপারা, সেটা তো দেশকে ভালোবাসি বলেই। ‘এই যৌবনতরঙ্গ রুধিবি কি দিয়া বালির বাঁধ’?
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, ঢাকা মহানগর