উত্থাপিত উগ্র মৌলবাদ ও সংকট উত্তরণ
১০ এপ্রিল ২০২১ ০০:৩৬
প্রখ্যাত নোবেল জয়ী সাহিত্যিক ও দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন, “ধর্মের ব্যাপারে যারা অন্ধ তারা কখনও স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারেনা”। আবার এদিকে দেশবরেণ্য কিংবদন্তি ভাষাবিদ প্রয়াত শিক্ষাগুরু ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেছিলেন, “ধর্ম নিয়ে যারা কোন্দল করে ধর্মের মর্ম তারা বোঝে না”। ধর্মের গান গেয়ে নর্দমার লঙ্গরখানা খুলে বসা মানুষ আর যাই হোক দেশের জন্য সুখকর কিছু বয়ে নিয়ে আসবে না গত কয়েকদিনের অভিজ্ঞতায় এতটুকুন হলফ করে বলে দেওয়া যায়। ধর্মান্ধদের গোঁড়ামি এবং ধর্ম ব্যবসায়ীদের রাজনীতি করার সুযোগ করে দেওয়া মানুষ এদেশে যুগে যুগে কালের গর্ভে বারংবার খোলস পাল্টেছে। তারা জাতির মনস্তাত্ত্বিক জাগরণের যেমন অন্তরায় ছিল তারা জাতির প্রাগ্রসরতায়ও ছিল অনুর্বর গোষ্ঠী। যাদের প্রত্যক্ষ মদদে সংস্কারপন্থীরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রকোষ্ঠে বারংবার চপেটাঘাত করেছে, সৃজন কাহনের প্রতিটি পাণ্ডুলিপিতে শৃঙ্খল বেঁধে দিয়ে বাঙালি জাতিকে সমৃদ্ধির সোপানে ম্রিয়মাণ করার পেটেন্ট তারা অতীতেও কায়েমের প্রয়াস চালিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হয়তো এ প্রয়াস জারি থাকবে।
তবে এ থেকে উত্তরণে আবারও সেই গোঁড়া থেকেই শুরু করতে হবে। জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে পরিচিত ‘শিক্ষাব্যবস্থা’র বৈচিত্র্যতা এবং স্বদেশি জাতীয়তাবাদের স্ফুরণ সম্পর্কিত শিক্ষা পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্তিকরণ এক্ষেত্রে একহাতে সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেমন শিশুবস্থায় ‘নৈতিক শিক্ষা এবং ‘দেশীয় সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য’ মূলক শিক্ষার পটপ্রণালী ফলাও করে শেখানো হয় এবং সেসব বিষয়ে শিশুতোষ চিত্ত বিনোদন মূলক অনুষ্ঠান, সভা, সমাবেশ ও সেমিনার সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা হয় সেসব গঠনমূলক ও তাত্ত্বিক পরিবর্তনের দিকে বিশেষভাবে নজর দেওয়া উচিত।
নৈতিক স্খলনের বিষয়ে জরিপ করলে দেখা যাবে প্রাথমিক,মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের পরিমণ্ডল যারা অতিবাহিত করে এসেছেন তাদের থেকে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার পরিগণ্ডি যারা অতিক্রম করেছেন তাদের মধ্যে ইসলামিক এলেম থাকলেও বিচার-বুদ্ধিভিত্তিক জ্ঞান ও সামাজিক নৈতিকতার এক বিরাট অবক্ষয় রয়েছে।
আমাদের দেশে শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই একমাত্র সামাজিকীকরণের মাধ্যম নয়, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া ও এছাড়াও গণমাধ্যমের বিভিন্ন পর্যায় ও অন্যান্য সামাজিকীকরণের যে মাধ্যমগুলো রয়েছে সেগুলোকে একটি নির্দিষ্ট শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে হবে— তাহলে হয়তো এসব অবক্ষয় থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।
আমাদের বর্তমান সমসাময়িকের প্রেক্ষিতে আমরা খুব ভালোভাবেই নজর আন্দাজ করতে পারছি যে, ধর্মীয় অনুভূতির ফায়দা নিয়ে এদেশে রাজনীতি করা কতটা সস্তা। বাংলাদেশের ধর্মীয় গোঁড়ামির আয়ুকাল যে আরও অনেক বছর তা বর্তমান প্রেক্ষাপট থেকে অনুমান করা সম্ভব।
এদেশের মানুষ এখনও স্বদেশি জাতীয়তাবাদের সাথে ধর্মীয় মতানৈক্যর ভেদাভেদ করতে শিখেনি। ধর্মকে যারা দেশীয় জাতীয়তাবাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করায় তাদের মাঝে এক ধরণের অজ্ঞতা কাজ করে কিন্তু সেই অজ্ঞতা দূরীকরণের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় গোঁড়ামি। স্রেফ নিরেট স্বচ্ছ কাঁচের মতো পরিষ্কার দৃশ্যকেও যারা প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিতে চায় তাদের হাতে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ যে বিশাল হুমকির মুখে এ কথা নিয়ে বিরাগভাজন হলেও মতানৈক্যে আসতে খুব একটা কালক্ষেপণ হবে না।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় সংস্কৃতি পুরোপুরি ভিন্ন একটি ক্ষেত্র তবে এটার মধ্যে দ্বান্দ্বিক বিতর্কের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল ব্রিটিশরা। সেই দীর্ঘসূত্রিতায় এখনও এর রেশ ব্যাপক হারে রয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতের এক মুখপাত্রের নারী কেলেঙ্কারি, কওমি মাদরাসায় বলাৎকার, রাজনৈতিক ইস্যুতে ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যাবহার করে রাষ্ট্রযন্ত্রকে বিকলাঙ্গ করার জন্য ইন্ধন সব মিলিয়েই বাংলাদেশের সমসাময়িক ও ভবিষ্যতের রাজনীতিতে যে ধর্মভিত্তিক উগ্র গোষ্ঠীরা একটা বিরাট প্রতিপত্তি কায়েম করবে এটা সন্দেহাতীত। এই অশনি বার্তার এখনি মূলোৎপাটন না করলে প্রজন্মের আবহমান ধারায় আগামীর জন্য ভয়ংকর দৃশ্যপট অপেক্ষমাণ তা নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায়।
তবে, বর্তমান রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু তনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনা এই ধর্মীয় গোষ্ঠীর লাগাম টেনে ধরতে বিশাল মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। কওমি মাদরাসায় আলেমদের সর্বোচ্চ সার্টিফিকেটকে তিনি স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) এর সম মর্যাদার সম্মান দিয়েছেন।পুরো বাংলাদেশের ৪৯২টি উপজেলায় তিনি মডেল মসজিদ নির্মাণের প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে নিয়েছেন। কওমি মাদরাসায় পৃষ্ঠপোষকতার জন্য তিনি ‘কওমি জননী’ উপাধিতেও ভূষিত হয়েছেন। এখন এদের মধ্যে থেকে উত্থাপিত উগ্র গোষ্ঠীকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দমন করাই হয়তো বঙ্গবন্ধু তনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনার একমাত্র টার্গেট। বাংলাদেশের সকল প্রগতিশীল ও মুক্ত বুদ্ধিচিন্তা চেতনার মানুষের কাছে দেশরত্ন শেখ হাসিনার সফলতালাভই হয়তো এখন একমাত্র বাসনা।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়