করোনার ভয়ের চেয়ে না খেয়ে থাকার ভয় কম নয়
২৬ এপ্রিল ২০২১ ২১:১৫
জীবন নাকি জীবিকা—কোনটি আগে? কিছুদিন থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে এটি নিয়ে তুমুল বিতর্ক হচ্ছে। কেউ বলছেন, জীবন বাঁচানোর জন্য ঘরে থাকতে হবে, প্রয়োজনে না খেয়ে হলেও। আবার কেউ কেউ বলছেন, ক্ষুধার কষ্ট নিয়ে ঘরে থাকা সম্ভব নয়।
করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় অসংখ্য মানুষ হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটছে। হাসপাতালগুলোতে ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই অবস্থা। অক্সিজেন নেই, আইসিইউ নাই, ভেন্টিলেটর নাই। করোনার নতুন নতুন ভেরিয়্যান্টের কারণে দ্রুতই মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। প্রতিবেশী ভারতের দুঃসহ অবস্থা দেখে রক্ত হিম হয়ে আসে।
এমতাবস্থায় সরকার লকডাউন দিয়েছে। প্রথমে শিথিল, তারপর কঠোর লকডাউন। সেই কঠোর লকডাউনও কিন্তু কার্যকর হয়নি। এই অবস্থায় ২৫ এপ্রিল থেকে শপিংমল, দোকানপাট খেলে দেওয়া হয়েছে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত। গণপরিবহনও হয়তো খুলে দেওয়া হবে। ঢাকার বাইরে যাওয়ার হিড়িক যেমন পড়েছিল, তেমনি ঢাকায় ফেরার জন্যও ভিড় করে চলাচল চলছে।
বাংলাদেশের মতো পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের সাড়ে ষোলো কোটি মানুষের স্বল্পোন্নত দেশে সত্যিকারের লকডাউন আদৌ সম্ভব কি না তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইটালি ইত্যাদি ইউরোপের ধনী দেশগুলোর লকডাউনের সাথে আমাদের লকডাউনের কোনোভাবেই তুলনা চলে না। তাদের অর্থনীতি, জনসংখ্যা, আর্থিক সামর্থ্যের সাথে আমাদের কোথাও মিল নেই।
করোনাভাইরাসের সর্বগ্রাসী ছোবলে অনেকের সব কিছু ধ্বংস হয়েছে। সবখানেই অস্থিরতা, সবার মাঝেই শঙ্কা। একইসাথে জীবন এবং মৃত্যুর শঙ্কা। গেল এক বছরে অসংখ্য মানুষ কাজ হারিয়েছে। মধ্যবিত্তরা দরিদ্র হয়েছে, দরিদ্ররা চলে গিয়েছে দরিদ্র সীমার একেবারে নিচে। শহুরে মধ্যবিত্তের জীবন ছেড়ে একটা বড় অংশ পাড়ি জমিয়েছেন গ্রামে। যারা শহরে মানসম্পন্ন জীবন যাপন করতেন, তারা গ্রামে কোনোমতে বেঁচে থাকার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। নিম্নবিত্তরাও শহর ছেড়েছেন। লাখে লাখে মানুষ আবারো সেই গ্রামেই ফিরে গিয়েছেন। কিন্তু গ্রামেই বা কর্মসংস্থান কোথায়?
এরমধ্যে বিভিন্ন গবেষণায় এটা দেখা যাচ্ছে যে, গত এক বছরে দেশে গরিব মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা ২১ শতাংশ থেকে ৪২ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে বলে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করছেন। একটি জরিপে বলা হয়েছে, ৬৬ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। রিকশাচালক, পথশিশু, হোটেল কর্মচারী, ফুটপাথের ক্ষুদ্র হকার-ব্যবসায়ীদের অবস্থা খুবই খারাপ। এর সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি যুক্ত হয়ে দরিদ্র মানুষের ওপর বাড়তি এবং অসহনীয় চাপ সৃষ্টি করেছে।
শখ করে একবেলা দু’বেলা না খেয়ে থাকা আর খাদ্যের অভাবে না খেয়ে থাকা এক নয়। ক্ষুধার জ্বালা যে বড় জ্বালা। ক্ষুধার্ত সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে কোন বাবাই ঘরে চোখ বন্ধ করে থাকতে পারবে না।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে করোনা সেই অর্থে ছোবল বসাতে পারেনি। হয়তো তাদের স্ট্রং এন্টিবডির কারণে অথবা দরিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করতে করতে তাদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। গবেষণায় বিষয়টি বেরিয়ে আসতে পারে। তাই বিত্তবানরা ঘরে থাকলেও বিত্তহীনদের ঘরে থাকার সুযোগ নেই। আর সরকারি যৎসামান্য প্রণোদনা দিয়ে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর অভাব ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
তাই করোনাকে বধ করার সংকল্পে সমন্বিত উদ্যোগের বিকল্প নেই। কর্মসংস্থান ঠিক রেখে মানুষকে শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করতে হবে। ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে, সেইসাথে আইন প্রয়োগ করতে হবে। সংক্রমণ রোধের জন্য যেমন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই, তেমনি দৈনিক উপার্জন করে যাদের বেঁচে থাকতে হয়, তাদের মুখে খাবার তুলে না দিলেও চলবে না। এই দুইয়ের সমন্বয়সাধনে সরকারকে অবিলম্বে উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নিতে হবে। করোনা থেকে বাঁচতে গিয়ে অনাহারে মৃত্যুও কাম্য হতে পারে না। সময়টা কঠিন। তাই কোনো পক্ষেরই হেলাফেলা করার সুযোগ নেই।
অসহনীয় এই সময়ে জীবন এবং জীবিকার মধ্যপন্থা অবলম্বন করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এভাবেই মরতে মরতে বেঁচে থাকা অথবা বাঁচতে বাঁচতে মরে যাওয়া – এই অনিশ্চয়তা মানুষের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হতে পারে না ।
করোনা অথবা খাদ্যাভাবে অকালে মৃত্যুকে বরণ করা যেন কারো ভবিতব্য, নিয়তি না হয়ে দাঁড়ায়!
লেখক : শিক্ষক ও কলাম লেখক