ইন্ডিয়া ইজ বার্নিং
১ মে ২০২১ ২১:২৪
আমি গত ৭ দিন ধরে বিদশি চ্যানেল দেখছি আর শিউরে শিউরে উঠছি। ইন্ডিয়ার একি অবস্থা!
কলকাতায় থাকা আমার কিছু বন্ধুরা জোর দিয়ে বলছে এসব মিডিয়ার প্রপাগান্ডা। ঢাকার বন্ধুরা বলছে বিদেশি চ্যানেলই দেখা বন্ধ করতে। ১ লাখ ৯০ হাজার, গত ৭ দিনে করোনায় মারা গেছে। সংক্রমিত ২ কোটি ১৬ লাখ ৯ হাজার ৩০৮ জন। এমনকি ভল্নাটিয়ারও করোনা পজিটিভ নিয়ে কাজ করছে। এই নম্বরগুলি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। কাজেই লেখা ছাপার সময় আরও বেশি হবে তা বলাই বাহুল্য। অনেকেই বলছেন, ভারতে এত মানুষ! এই সংখ্যা কোনো সংখ্যাই না। সত্যিই কি তাই? মানুষের জীবন কি তবে মূল্যহীন?
কেন এই লেখা?
কারণ, পাশের বাড়িতে আগুন ধরলে নিজ বাড়িতে আয়েশে বসে থাকা যায় না। তেমনি পাশের দেশ যাদের সঙ্গে তিনদিকেই স্থল সীমান্ত, কোভিডে তাদের এই হাল হলে আমাদের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কা জাগেই। ভারতের অবস্থা দেখে এখনই আমাদের সাংঘাতিকভাবে সচেতন হতে হবে। ভারতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজের দেশকে করতে হবে প্রস্তুত। এখনই। যে কোন সময় ধেঁয়ে আসতে পারে ভারত থেকে এই দ্বিতীয় কোভিড অ্যাটাক।
মানুষ মরছে, কিন্তু কোভিডে নয়
হ্যা, ঠিকই বলেছি ভারতে কোভিডের ভয়ানক দ্বিতীয় ধাক্কায় অগণিত মানুষ মারা যাচ্ছে কিন্তু আসলে তারা মারা যাচ্ছে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাবে। হাসপাতালে বেড আর ভেন্টিলেটরের অভাবে। মসজিদ, মদির, শিখদের গুরুদুয়ারা, সব জায়গায় মৃতপ্রায় ব্যক্তিদের পরিবারের লোকজন নিয়ে আসছে হাসপাতালে জায়গা না পেয়ে। চোখের সামনেই চলে যাচ্ছে মা/বাবা/সন্তান বা স্বামী-স্ত্রী। অক্সিজেন বিক্রি হচ্ছে ব্ল্যাক মার্কেটে। শ্মশান ঘাটগুলি জ্বলছে বিরামহীন। বাড়ির পার্কিং, খোলা জায়গাতেও পোড়ানো হচ্ছে মৃতদেহ। মুসলমানদের কবরস্হানে জায়গা নাই। যেটুকু জায়গা জুটছে কোনোরকমে দাফন চলছে। ড্রোনে তোলা ছবিগুলি দেখে যেন বিশ্বাস হয় না। অনেকে বলছে একই ছবি দেখানো হচ্ছে বারবার। না, প্রতিদিন নতুন নতুন ফুটেজ আসছে।
যখন মানুষের জীবনের আগে ভোট
প্রতিটি চ্যানেল প্রতিটি মানুষ মোদী সরকারের কাছে জবাবদিহিতা চাচ্ছে এই চরম পরিস্হিতির। বিদেশি সব চ্যানেলে চলছে চরম সমালোচনা। কিন্তু মোদীজি স্পিকটি নট। এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত ভারতে নির্বাচনের নামে লাখ লাখ মানুষের জনসমাগম ছিল স্বাভবিক চিত্র। লাখো লোকের সমাগম হয়ে গেল গঙ্গাতীরের কুম্ভ মেলায়। তাছাড়া বিয়ের অনুষ্ঠানসহ সব কিছুই চলছিল ভারতে কোভিডকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। যেখানে ডিসেম্বরে ইংল্যান্ড প্রায় প্রেতপুরি হতে চলেছিল কোভিডের সেকেন্ড ওয়েভে। বিশ্বের প্রতিটি দেশ ছিল সচেতন। সেখানে ভারত সরকার ছিল সবচেয়ে বেপরোয়া। ২০২০ সালে মহারাষ্ট্র এবং দিল্লী সরকারকে ৮টি করে অক্সিজেন প্ল্যান্ট বানানোর অনুদান দেওয়া হয়েছিল। বানানো হয়েছে ১টি করে। কলকাতার এক ‘ইডিয়ট’ বন্ধু বললো বছরে ১ টার চেয়ে বেশি বানাবে কিভাবে। হিসাব সহজ, ৮ টি ভিন্ন কোম্পানিকে টেন্ডার ডেকে কাজ দিয়ে দিলেই আজকে ভারতে ১৬ টা অক্সিজেন প্ল্যান্ট থাকত। মানুষকে আজ পোকা-মাকড়ের মত যেখানে সেখানে অক্সিজেনের অভাবে মরতে হত না। রাজ্য সরকার বাকী অ-নির্মিত প্ল্যান্টের অনুদিত অর্থের হিসেবও দিতে হিমশিম খাচ্ছে। অন্যদিকে এমন জরুরি পরিস্থিতিতেও দিল্লীতে নতুন সংসদ ভবনের নির্মানকাজ চলছে দারুণ গতিতে।
এদিকে ভ্যাকসিনও শেষ
ফেব্রুয়ারী ১৫ তারিখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জরুরি ভিত্তিতে দুই ধরণের ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেয়। একটি হল অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভ্যাক্স যার ৬০ শতাংশ ভারত উৎপাদন করছে। কথাই ছিল এর ৫০ শতাংশ ভারতের জন্য। বাকীটা বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে যাবে। ফেব্রুয়ারী ২১ তারিখে সিরাম ইন্সটিউট অব ইন্ডিয়ার সিইও আদার পুনেওয়ালা প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশবাসীকে ধৈর্য ধরতে বলেন ভ্যাকসিনের জন্য। সব ঠিকঠাকই চলছিল।হঠাতই মোদী সরকার ভারতে ১৮’র বেশি বয়সীদের ভ্যাকসিন দেওয়ার অনুমোদন দেয়। বাস, এখানেই কেচ্ছা খতম! আমরা বাংলাদশিরা ভারতের কমিটমেন্ট অনুযায়ী চাহিদামত ভ্যাকসিন পাওয়া বাদ গেলাম। শুধু তাই নয়।আজকের লেখা পর্যন্ত খোদ ভারতেই কোভিশিল্ডের দারুণ অভাব চলছে। সরবরাহ নাই। মাত্রই টিভিতে দেখলাম রেজিস্ট্রেশন করে এসেও ৩ ঘন্টা অপেক্ষার পর মানুষ ফেরত যাচ্ছে। গতকাল আমেরিকান লেইট নাইট শো’তে দেখলাম অবশেষে বাইডেন ওদের স্টকের অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভারতে পাঠাচ্ছে। ভাবলে অবাক হচ্ছি পুরো বিশ্ব যেখানে কোভিডের প্রকোপে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনসংখ্যার হলেও ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক দেশ হিসেবে প্রথম স্থানে থেকেও এতটাই ‘কেয়ারলেস’ কিভাবে হয়। তর্কের খাতিরে বিশাল রচনা লেখা যায় এই নিয়ে। কিন্তু মোদ্দা কথা এটাই যে ভারত কোভিডের ভয়াবহতাকে পাত্তা দেয়নি, যার ফলে ওরা এখন ভুগছে।
আমরা কি করছি
আমাদের সরকার অবশ্যই বুদ্ধিমানের মতো এবারে লক-ডাউন দিয়েছে ভারতের এই হাল হবার আগেই। এটা সরকারের দূরদর্শিতাই বটে। দারুণভাবে ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। ১.৭ শতাংশ জনগণ দুই ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছেন ইতোমধ্যে। যদিও নতুন রেজিস্ট্রেসন বন্ধ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভারত থেকে ভ্যাকসিন না আসায়। খোলা জায়গায় ঈদের জামাত বন্ধ ঘোষণা এসেছে। ঈদের আগে পর্যন্ত লক-ডাউন বলবৎ রাখার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এটুকুই কি যথেষ্ট? ইতোমধ্যে কোভিডে মানুষ মারা যাওয়া শুরু হয়েছে। মৃতের সংখ্যা এই বাড়ছে, এই কমছে। মানুষ যথেষ্ট সচেতন নয়। স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রতি রয়েছে চরম অনীহা। ফলে তৈরি হয়েছে ভবিষ্যত নিয়ে অনিশ্চয়তা।
আমরা কি প্রস্তুত?
ভারতের মতো কোভিডের ভয়ংকর রূপ ধারন করতে কত দিন বাকি? আমরা কি প্রস্তুত? প্রথমত হাসপাতালে পর্যাপ্ত বেড এবং অক্সিজেন সিলিন্ডার কি আমাদের স্টকে আছে? আছে কি পর্যাপ্ত পিপিই, অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, সাধারন মধ্যবিত্তের জন্য সরকারি মেডিকেয়ার? কেন চালু করতে পারছে না “শেখ হাসিনা মেডিকেয়ার”? এসব প্রশ্ন মাথায় আসলে মনে হয় গরীবদের জীবনের মূল্য কি আসলেই নাই? তবে এখন টিভিতে যা দেখছি টাকা দিয়েও ভারতে জীবন বাচাঁনো যাচ্ছে না। যা আমরা গতবার আমাদের দেশেই দেখেছি। ধনকুবেরদের মরতে দেখেছি কোটি কোটি টাকা থাকবার পরও। এবার দেখছি চার্টার্ড ফ্লাইটে ভারতীয় ধনকুবের এবং বলিউড সেলিব্রিটিরা সব মালদ্বীপ বা অন্য সব দেশে উড়াল দিচ্ছে। এসব তো কোন সমাধান না। প্রহসনমাত্র। আমরা কি করবো? আপনি বা আমি? গতবার তো বেচেঁ গেছি। আর এবার? আমাদের বাচ্চারা? বাঁচবে কি? কিছু কি বদলেছে? নাকি অর্ধেক মানুষ মরবার পর ভারতের মত হুশ ফিরবে আমাদের? সেদিন দেখার আগেই চাই সচেতনতা। সরকার থেকে সাধারণ মানুষ সবমহলেই প্রয়োজন সচেতনতা ও পূর্ব প্রস্তুতি। তবেই যদি রোখা যায় কোভিডে মৃত্যুর মিছিল।
লেখক: সাংবাদিক ও মিডিয়া ব্যাক্তিত্ব
সারাবাংলা/আরএফ/
অক্সিজেন সিলিন্ডার করোনা কোভিড ১৯ কোভিড পরিস্থিতি ভারতের করোনা পরিস্থিতি