প্রগতির আঙিনায় একুশ শতকের ছাত্র রাজনীতি
৯ মে ২০২১ ২৩:২৯
বাংলাদেশের রাজনীতির সাথে অপরাপর বিভিন্ন মিশ্র দল মতের মিশেল রয়েছে। এখানে প্রগতির কথা বলে কেউ রাজনীতিতে ফায়দা নেওয়ার তাড়না করে, আবার কেউ পুঁজিপতি ধারণার অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করে। তবে বাংলাদেশে মূল ধারার রাজনীতিতে এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও এর সাথে সম্পৃক্ত সপক্ষের শক্তির সাথে এবং একই সাথে বিপক্ষের শক্তি কিংবা সে সময়ে ভাবাদর্শের বিকৃতি ঘটিয়ে সন্তর্পণে জনমনে একচ্ছত্র প্রতিপত্তি কায়েমের সাথে যারা জড়িত তারাই মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রারম্ভে অখণ্ড পাকিস্তান চেয়ে সে সময়ে ধর্মীয় ফতোয়া জারি করে, গায়েবি দালালি করেছে বাংলাদেশের একদল বিশেষ সম্প্রদায়।
জাতিগত ও ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠী হিসেবে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিবেচনায় এদেশের মানুষ বরাবরই ধর্মীয় ও এ সংশ্লিষ্ট আনুষঙ্গিক বিষয়াদিতে স্পর্শকাতর। এই স্পর্শকাতরতার সুযোগ নিয়ে আধিকারিক গোষ্ঠী জনগণকে তাসের টেক্কা হিসেবে ব্যবহার করার মোক্ষম চাল দিয়ে বরাবরই ছলনার মূর্ছনায় কুক্ষিগত করে আসছে।
আশ্চর্যের বিষয় বাংলাদেশের বামপন্থী দলগুলো এবং এদের ছাত্র সংগঠনগুলোর মূলনীতি সাম্য মানবিক মর্যাদার ভিত্তিতে সমাজে বৈষম্যের ফারাক তলানিতে নিয়ে আসার মন্ত্রে উজ্জীবিত হলেও কালের বিবর্তনে তাদের কার্যকলাপ পপুলিস্ট আইডিয়ায় রূপান্তরিত হয়েছে। সেটা জনগণের জন্য স্থায়ী কোনো শুভ বার্তা বয়ে নিয়ে আসুক বা না আসুক এক্ষেত্রে তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। তা না হলে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশে আগমন নিয়ে তাদের উৎকণ্ঠিত হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। কারণ এই প্রসঙ্গটি দেশের ইথিকাল কোনো ডেভেলপমেন্ট এর সাথে জড়িত নয়। একসময় বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের ম্যান্ডেট নিয়ে হাজির হতো। শিক্ষাঙ্গনে প্রগতিশীলতা ও টেকসই শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়নে তারা সরব ছিল। কিন্তু কালের পরিক্রমায় তারা যে তাদের মূলনীতি কমিউনিজম থেকে সরে এসে বাংলাদেশের অন্যতম মূলমন্ত্র সমাজতন্ত্রকেই বিলীন করে দেওয়ার পায়তারা করছে এটি জাতির জন্য হতাশাজনক। বাম ছাত্র সংগঠনগুলো যে প্রগতিশীল ও মননশীল প্রতিযোগিতার একটা আসর জমিয়েছিল ৮০’র দশকে তাতে এদেশের জন্য খ্যাতিমান কিছু রাজনৈতিক নেতৃত্ব আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে প্রগতির পসরা বসিয়ে তারা যে বৈষম্যভিত্তিক সামাজিক এজেন্ডা কায়েমের দিকে ধাবিত হচ্ছে এটি আমাদের জন্য বেদনাদায়ক।
আবার অন্যদিকে বাংলাদেশে বর্তমানে এমন একদল সুশীল সমাজ ব্যাপ্তি ছড়াচ্ছে যারা মনে করেন শিক্ষার্থীদের কাজ ও কর্মপ্রক্রিয়া শুধুমাত্রই ছাত্রদের অধিকার সংশ্লিষ্ট বিষয়েই হওয়া উচিত। দেশীয় বা জাতীয় রাজনৈতিক ইস্যু অথবা বৈদেশিক কূটনীতি নিয়ে ছাত্রদের অভিপ্রায় জানানোটা ঠিক ততোটা সমীচীন নয় বলে তারা মনে করেন । কিন্তু অপরাপর যখন সংকটে পড়েন তখন আবার ছাত্রদের দিকেই শরণাপন্ন হন। আসলে ৬০ এর দশক থেকে এদেশীয় মূলমন্ত্রগুলোসহ দেশের উদারনৈতিক সকল প্রেক্ষাপটেই ছাত্রনেতারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে এসেছে। কিন্তু বর্তমানের সবচেয়ে বড় সংকট ও উৎকণ্ঠার বিষয় এই যে, ছাত্ররাজনীতিতে শিক্ষার্থীরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীবান্ধব সংগঠন হিসেবে সেদিক থেকে কেবল ছাত্রলীগই সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নিজেদের অভিযোজিত করতে পেরেছে। ছাত্ররাজনীতিতে জনমানুষের আকাঙ্ক্ষাকে অনুধাবন করতে না পারলে আপনি যে শনি গ্রহে পতিত হবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই।
দেশীয় প্রোপাগান্ডার ছায়াতলে যদি ছাত্র প্রতিনিধিরা গা ভাসিয়ে দেন তাহলে এটি আগামীর জন্য অশনিসংকেত। কেননা যখন আমরা উন্নয়নের সিঁড়ি বেয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলেছি তখনই এদেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য কূটনৈতিক ও দেশীয় ষড়যন্ত্র সরব হচ্ছে। কোটি কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ হচ্ছে শুধুমাত্র অরাজকতা সৃষ্টি করার জন্য। বাংলাদেশের এলিট ক্লাস এবং লোয়ার মিডিল ক্লাস সম্প্রদায়কে মন্থরার গুণকীর্তন করা হচ্ছে। আসলে মূল পার্থিব বিষয়টুকুন হলো, বন্দুকের নল আর গ্রেনেডের গণতন্ত্র থেকে যাদের উত্থান তারাও এখন বুড়ো আঙুলের ছাপের কথা বলে দেশকে চালকবিহীন স্টিমারে সওয়ার করার প্ররোচনা দিচ্ছেন। বাংলাদেশের একদল সম্প্রদায় যখন রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে চায় তখন আরেকদল সম্প্রদায় সেক্যুলার হিসেবে রাষ্ট্রকে পেতে চায়। দুজনের ভাবধারাই কিন্তু প্রাসঙ্গিক কেননা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীর পরিসরকে রাষ্ট্রীয় সকল খাতে বিবেচনায় রাখতেই হবে। আবার অন্যদিকে যারা সেক্যুলার দেশ চায় তাদের মূল ভাবাদর্শ হলো সেক্যুলার মানেই ধর্মহীনতা নয়, এখানে যেন সকল ধর্মের লোক সমান অধিকার পায়। একজনের উপর যেন অন্যজন পেশিশক্তির প্রভাব খাটাতে না পারে। এ বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে গেলে অমর্ত্য সেন খুব সম্প্রতি বলেছেন যে, বাংলাদেশই শুধু নয় বঙ্গবন্ধুর ভাবাদর্শ “মুজিববাদ” এখনও বিশ্বের জন্য প্রাসঙ্গিক। কেননা তিনি সংবিধানে ইসলামকে মর্যাদা দিয়েছেন পাশাপাশি বাংলাদেশের মূলমন্ত্র হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন যেখানে যে যার যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে এবং সেখানে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না আবার ধর্ম নিয়ে রাজনীতিকে তিনি নিষিদ্ধ করেছেন তার সকল ভাবাদর্শে। “ধর্ম বনাম রাষ্ট্র ” এই বিষয়টির সুরাহা কিন্তু মুজিববাদের মাধ্যমেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
আমাদের দেশের রাজনীতির চাকাকে প্রগতির দিকে ধাবিত করতে এখন প্রয়োজন মননশীল ধারার ছাত্ররাজনীতি যার পক্ষ-বিপক্ষ নিজেদের প্রতি স্পর্ধী সুরকে সম্মান জানাবে। ককটেলবাজীর রাজনীতি থেকে সরে এসে তাদের মননশীল রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার যে আহ্বান জানানো হয়েছে তারা সেটি সাদরে গ্রহণ করবে। ছাত্রদের মুখের বাণী যেন স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়বে মুগ্ধতার পরশে। যে ছাত্রদের নেতৃত্বে ৫২’র ভাষা আন্দোলন হয়েছে, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে সেই ছাত্রদের হাত ধরেই যেন আগামীর বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব সাধিত হয় সেদিকেই আমাদের মনোনিবেশ করা এখন অতীব জরুরি বলে ছাত্ররাজনীতির সাথে জড়িত একজন শিক্ষার্থী বলে আমি মনে করি।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়