ফিলিস্তিন-ইসরাইলের প্রায় শত বছরের রক্তাক্ত ইতিহাস
২১ মে ২০২১ ১২:২৮
রোজার ঈদের আগে ইসরাইল গাজায় আবারও হামলা করেছে অথবা হামাস ইসরাইলে হামলা করেছে। আর এটা নিয়ে বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযো মাধ্যমে আবারও তোলপাড় শুরু হয়েছে। অনেকেই দেখি হামাস আর ইসরাইলের এই যুদ্ধকে ধর্ম যুদ্ধ বানিয়ে দেয়। কিন্তু আসলেই কি এটা ধর্মযুদ্ধ? বা এই যুদ্ধের শুরুই বা কোথা থেকে সেটার কতটুকুই বা জানি আমরা? আসুন জেনে নেই এই দুই দেশের সংঘাতের ইতিহাস।
যেভাবে ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম
আপনার নিজ ধর্মকে একপাশে রেখে যদি ইহুদিদের দৃষ্টিকোন থেকে দেখে থাকেন তাহলে জানবেন ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষগুলো ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি অত্যাচারিত সম্প্রদায়ের একটা। এটা শুধু এই দুই একশ বছরের কথা না। হাজার বছর ধরেই এমনটা হচ্ছে। খ্রিস্টধর্ম যখন জনপ্রিয় হচ্ছিল তখনও বাজারে প্রচলত ছিল “ইহুদীরাই যীশু খ্রিস্টকে শূলে চড়াতে সাহায্য করেছে”, “ইহুদিরা তাদের রিচুয়ালে ছোট ছোট খ্রিস্টান বাচ্চাদের রক্ত পান করে”, “ইহুদিরা তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে খ্রিস্টান বাচ্চাদের বলি দেয়”। এরকম গুজবের ফল ছিল ব্যাপক হারে ইহুদি নিধন। ক্রুসেডের সময়ও দেখা যায় যেখানে প্রচুর ইহুদিদের হত্যা করা হয়েছে। এটা শুধু সেই আমলে না। শত বছর আগেও যখন ইহুদিদের নির্দিষ্ট কোন দেশ ছিল না, যখন তারা পুরো ইউরোপ অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করত তখনো বলা হত সমাজের সকল অব্যবস্থার পিছনে দায়ী এই ইহুদী সম্প্রোদায়৷ এতসব অত্যাচার আর বর্ণবাদের শিকার হয়ে ইহুদীরা আঠারশ শতকের দিকে ধীরে ধীরে ভাবতে থাকে তারা একমাত্র তখনই ভাল থাকবে যখন তাদের নিজেদের এক রাষ্ট্র হবে। আর এই ধারনা থেকেই অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাংবাদিক থিওডোর হ্যানজেল তার রাজনৈতিক প্যামফ্লেটে “জায়োনিজম” বলে এক রাজনৈতিক মুভমেন্ট শুরু করেন। যেখানে ইহুদিদের জন্য একক রাষ্ট্রের কথা বলা হয়। যদিও এটা নতুন কোন ধারণা ছিল না। আঠারশ শতকের মাঝামাঝিতেই দেখা যায় বিভিন্ন ইহুদি সংগঠন নিজেদের “লাভারস অফ জায়ান” বলে পরিচয় দিতে শুরু করে। আর এইসব অত্যাচার বলুন বা যাই বলুন সকল কিছু মিলিয়েই ১৮৮১ সালে প্রথমবারের মত ব্যাপক আকারের মাইগ্রেশন দেখা যায় ইহুদিদের মাঝে। যারা দলে দলে ফিলিস্তিন যাচ্ছিল। বলার জন্য বলে রাখি তখনকার সময়ে ফিলিস্তিন কোন আলাদা রাষ্ট্র ছিল না। এটা ছিল অটোমান সম্রাজ্যের একটা অঞ্চল মাত্র।
ইহুদিদের এভাবে গনহারে ফিলিস্তিন যাবার কারণগুলো ছিল—
*জেরুজালেম যা ইহুদিদের জন্য পবিত্র ভূমি সেটির অবস্থান ফিলিস্তিনে।
*তৎকালীন অটোমান সাম্রাজ্যে মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি সকলেই অনেকটাই শান্তিপ্রিয়ভাবে একসাথে বসবাস করত।
আবার এদিকে অটোমান সম্রাট এই বিশাল সংখ্যার মাইগ্রেশন আটকাতে কোন ব্যবস্থা করে নি। তার কারণ ছিল তখনকার ফিলিস্তিন অঞ্চলে খুব একটা মানুষের বসবাস ছিল না। আর তাই অটোমানদের এটা নিয়ে তেমন মাথাব্যথাও ছিল না।
সময়টা তখন ১৯১৫। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। গ্রেট ব্রিটেন এবং ফ্রান্স এক হয়ে লড়ে যায় অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে। যুদ্ধ জয় করতে ব্রিটিশরা তাদের পুরনো চাল চালে এই ফিলিস্তিন অঞ্চলে। ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনে আরব বিদ্রোহীদের বলে তোমরা আমাদের সাথে যোগ দাও তাহলে আমরা তোমাদের ফিলিস্তিন অঞ্চলে নিজেদের রাষ্ট্র বানাতে সাহায্য করব। তৎকালীন আরব বিপ্লবীরা সিরিয়া থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত এক সমন্বিত আরব দেশের স্বপ্নে বিভোর ছিল। তাই তারা ব্রিটিশদের সাথে যোগ দেয়। আবার আমেরিকান ইহুদি ব্যবসায়ীদের নিজেদের দিকে টানতে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনে বাসকারী ইহুদিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র দেওয়ার প্রতিজ্ঞাও করে যদি তারা যুদ্ধে ব্রিটিশদের সাথে যোগ দেয় তবে। বৃটিশরা ভেবেছিলে ইহুদিদের তাদের পাশে রাখতে পারলে আমেরিকাতে তাদের প্রভাব বাড়বে। কিন্তু এই দুই দলকেই বোকা বানিয়েই বৃটিশরা ফ্রান্সের সাথে অন্য এক চুক্তি করে এরকম যে যুদ্ধ জয়ের পর আরব অঞ্চলগুলো তারা নিজেরা আলাদা আলাদা ভাগ করে নিবে। এবং হয়েছিলো তাইই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বৃটেন এবং ফ্রান্স নিজেদের মধ্যেই আরব অঞ্চলগুলো ভাগ করে নেয়। যেখানে ফিলিস্তিন অঞ্চল চলে আসে এবার গ্রেট বৃটেনের হাতে। এবং বৃটেন সেখানে নিজেদের বসতি স্থাপন চালু করে।
সময়টা এবার ১৯৪০ এর পরবর্তী। জার্মানির স্বৈরাচারী এডলফ হিটলার ইউরোপের সকল ইহুদি নিধনের পন করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে। প্রায় ছয় মিলিয়ন ইহুদি হত্যা করে হিটলার। বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে এসে ইহুদিরা আবার এখানে সেখানে রিফিউজ হতে থাকে যার বিশাল একটা সংখ্যা আবারো ফিলিস্তিনের দিকেই আসে। আর ফিলিস্তিন তখন বৃটেনের অধিকারে। শুরুর দিকে বৃটেন ইহুদিদের ফিলিস্তিনের ঢুকতে দিলেও একটা সময় এসে তাদের ফিলিস্তিনে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। আর এখান থেকেই ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরেও ইহুদিদের মধ্যে এক ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং তারা নিজেদের আলাদা দেশের জন্য আন্দোলন করতে থাকে।
১৯৪৮ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার বাহিনীর পরাজয় ঘটে। এই যুদ্ধে বেশ ক্ষতি হয় বৃটেনেরও। অর্থনৈতিক মন্দা আবার রাজনৈতিক অস্থিরতা সব মিলিয়েই বৃটেন আস্তে আস্তে নিজের কলোনি সবখান থেকেই গুটিয়ে নেয়। আমাদের এটা ভালোই জানার কথা। কারণ ঠিক সেই সময়ে আমরাও যে বৃটেনের কাছ থেকে মুক্তি পাই। তো বৃটেন সেবার ফিলিস্তিনি এবং ইহুদিদের আলাদা রাষ্ট্র দেওয়ার কথা বলে ফিলিস্তিন অঞ্চলের কর্তৃত্ব ছেড়ে দেয়। কিন্তু দেশ বৃটিশরা ভাগ করে দিয়ে যায় না। তারা এর দায়িত্ব দেয় জাতিসংঘকে।
জাতিসংঘই সেবার ফিলিস্তিন অঞ্চলকে দুই ভাগ করে দুটি দেশ করে দেয়। যেখানের প্রায় ৫৫ শতাংশ দেওয়া হয় ইহুদিদের এবং প্রায় ৪৫ শতাংশ দেওয়া হয় ফিলিস্তিনের। এবং এটাও বলা হয় যেহেতু জেরুজালেম ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমান তিন ধর্মের মানুষের কাছেই পবিত্র ভূমি তাই এর ক্ষমতা দুই দেশের কারো কাছেই থাকবে না। এর কর্তৃত্ব থাকবে জাতিসংঘের কাছে। ইহুদিরা জাতসংঘের এই প্রস্তাব মেনে নেয় এবং ১৪ মে ১৯৪৮ সালে দেশের নাম ইসরাইল রেখে নিজেদের দেশের যাত্রা শুরু করে। এভাবেই তৈরি হয় ইসরাইল নামক দেশের।
প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ
ইহুদিরা জাতিসংঘের প্রস্তাব মেনে ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করলেও ফিলিস্তিন অঞ্চলের আশেপাশের আরব রাষ্ট্র জাতিসংঘের প্রস্তাব নাকোচ করে দেয়। এবং তারা ইসরাইলকে বিন্দু মাত্র জমি দিতে অস্বীকার করে। এবং ১৯৪৮ সালে মাত্র একদিন বয়সী রাষ্ট্র ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে মিশর, জর্ডান, সিরিয়া এবং ইরাক। তাদের সাথে পরবর্তীতে যোগ দেয় সৌদি আরব, মরক্কো,ইয়েমেন এবং সুদান। ইসরাইলবাসীদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘা তখনো শুকায় নি। হিটলারের কৃতকর্মও তারা ভুলে যায় নি। তাই তারা জানতো তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এবার যদি তারা প্রানপন লড়ে না যায় তাহলে দুনিয়া থেকে ইহুদি সম্প্রদায়ই মুছে যাবে। আর তাই তারাও তাদের সমগ্র শক্তি দিয়ে লড়ে যায়। পরের ঘটনা যে কাউকেই আশ্চর্য করে দিতে বাধ্য। মাত্রই জন্ম নেয়া একটা দেশ একই সাথে আটটা দেশের বিরুদ্ধে লড়েও যুদ্ধে জয়ী হয়ে যায়। প্রায় এক বছরব্যাপি চলে বন্ধ হয় এই যুদ্ধের। ইসরাইলের এই যুদ্ধে তেমন কোন ক্ষতি না হলেও মূল ক্ষতি হয় ফিলিস্তিনের। যুদ্ধের পর দেখা গেল ফিলিস্তিন বলে যে দেশটা হবার কথা ছিল সেটা ছিল দুটো অঞ্চল নিয়ে। একটা গাজা স্ট্রিপ অন্যটা পশ্চিম তীর। যুদ্ধের পর দেখা যায় গাজা স্ট্রিপের দখলদারিত্ব এবার মিশরের হাতে আর পশ্চিম দখল করে রেখেছে জর্ডান। যার মানে দাঁড়ায় ফিলিস্তিনের আর কোন দেশই বাকি থাকে না। নিজেদের মাটি মিশর আর জর্ডানের কাছে হারিয়ে প্রায় সাত লাখ ফিলিস্তিনিদের সেবার বিভিন্ন আরব দেশে শরনার্থী হতে হয়েছিল।
১৯৬৭ দ্বিতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধ
১৯৬৭ সালে আবারো ইসরাইল এবং আশেপাশের বাকি আরব দেশগুলোর সাথে যুদ্ধ বাধে। যা দ্বিতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধ নামেই পরিচিত। মাত্র ছয়দিন ব্যাপি এই যুদ্ধ মিশর, জর্ডান, সিরিয়ার জন্য এক লজ্জারই নাম বলা যায়। কারন এই যুদ্ধেও ইসরাইলের জয় এবং আরবদের হার হয়। শুধু হারই না এবার ইসরাইল মিশরের কাছে থাকা গাজা স্ট্রিপ এবং জর্ডানের কাছে থাকা পশ্চিম তীর দখল করে নেয়। শুধু তাই না ইসরাইল এই যুদ্ধে মিশরের কাছ থেকে শুধু গাজা স্ট্রিপ না মিশরের নিজস্ব ভূমি সিনাই পেনিনসুলাও দখল করে নেয় এবং সিরিয়া থেকে দখল করে সিরিয়ার গোলান হাইটস।
পিএলও সৃষ্টি
কথায় আছে “রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রান যায়”। ফিলিস্তিনিদের অবস্থাও ঠিক এমনই ছিল। আরব-ইসরাইল যুদ্ধে মারা পড়েছিল মূলত ফিলিস্তিনিরাই। তাদের ভূমি একবার এর হাতে যায় তো একবার ওর হাতে। তাদের হাতে আর আসে না। আর এই থেকেই ১৯৬৪ সালে জন্ম হয় “ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশন”। যাকে ছোট করে বলা হয় পি.এল.ও। পিএলও শুরুতে অস্ত্র দিয়ে সবকিছু জয় করতে চাওয়ায় এবং ইসরাইলকে অস্বীকার করে তাদের থেকে ভূমি কেড়ে নিতে চাওয়াতে শুরতে তাদের সন্ত্রাসী সংগঠন বলা হত। আস্তে আস্তে তারা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ থেকে সরে আসলে ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নেয়। এবং তাদের ফিলিস্তিনবাসীদের অভিভাবক হিসেবে গন্য করে।
১৯৭৮ ইসরাইল-মিশর শান্তি চুক্তি
১৯৭৭-৭৮ সালে ইসরাইল এবং মিশরের মধ্যে কয়েক দফায় শান্তি বৈঠক চলে এবং শেষ পর্যন্ত এই বৈঠক সফল হয়। মিশর প্রথম আরব কোন দেশ হয় যারা ইসরাইলকে রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয় এতে। এবং ইসরাইলও প্রায় দশ বছর ধরে দখল করে রাখা মিশরের সিনাই পেনিনসুলা মিশরকে ফিরিয়ে দেয়। এই শান্তি বৈঠকের কারনে ১৮৭৮ সালে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী মেনাশ্যাম বেগিম এবং মিশরের রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাতকে নোবেল শান্তি পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়। ইসরাইলের সাথে করা এই শান্তি বৈঠক আনোয়ার সাদাতের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ইসরাইলকে মেনে নেয়ায় এবং শান্তি চুক্তি করায় তার বিরুদ্ধে উগ্রবাদীরা দাঁড়িয়ে যায়। এবং ১৯৮১ সালে সেনাবাহিনীর কিছু উগ্রবাদী সদস্য তাকে হত্যা করে।
ইসরাইলের ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি
১৯৬৭ সাল থেকেই ইসরাইল ফিলিস্তিনের ভূমি গাজা স্ট্রিপ এবং পশ্চিম তীর দখল করে রাখে। এই দখলের সময় যত বাড়ছিল ততই ইসরাইল বাসী জেরুজালেমের নিকটবর্তী বলে পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন হচ্ছিল। আন্তর্জাতিক ভাবে এই বসতি স্থাপনকে অবৈধ বলা হলেও ইসরাইল সরকার এইসব বসতি স্থাপন বা সেটেলমেন্টে নিজেদের হস্তক্ষেপ নেই বলে বারবার বলতে থাকে। যদিও এতে ইসরাইল সরকারের হাত ছিলই। পশ্চিম তীর অঞ্চলের জমির দামও ছিল তুলনামূলক সস্তা যা এই বসতি স্থাপনের অন্যতম এরো একটি কারণ। তাই ধর্মপ্রাণ ধনী ইহুদিদের জন্য এটা লুফে নেওয়ার মতই ব্যাপার ছিল। এসবের মধ্যেই ১৯৯২ সালে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী হন ইৎসাক রাবিন। যে কিনা সরাসরি পি.এল.ও কে স্বীকার করে নেয়। নিজের বক্তব্যে তিনি বলে পিএলও কোন সন্ত্রাসী সংগঠন নয়। তারা শুধু নিজেদের দেশ চায়। এবং এর ফলস্বরূপ ইৎসাক রাবিন এবং পিএলও প্রধান ইয়াসির আরাফাতের মধ্যে শান্তি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকের পর থেকে ফিলিস্তিন অলমোস্ট নিজেদের আলাদা দেশ তৈরির দ্বারপ্রান্তে চলে আসে৷ জাতিসংঘের প্রস্তাবনা অনুযায়ী গাজা স্ট্রিপ ও পশ্চিম তীর ফিলিস্তিনের হলেও তখন এসে দেখা যায় যুদ্ধের দামামায় ফিলিস্তিনিরা খুবই ছোট ছোট হয়ে একেক জায়গায় বাস করছে। এবং অনেক বেশি ইসরাইলি বসতি স্থাপনও হয়ে গেছে সেখানে। আর তাই পশ্চিম তীরে সেবার তিনভাগে ভাগ করা হয় এরিয়া এ, বি ও সি নামে। যেখানে এরিয়া সি এর ক্ষমতা থাকবে পিএলও এর হাতে, এরিয়া সি এর ক্ষমতা ইসরাইলের হাতে। এবং এরিয়া বি ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন দুই দেশ মিলে পরিচালিত হবে। এটাই ঐতিহাসিক অসলো একোর্ড। আর এই একোর্ড মোতাবেক ১৯৯৪ সালে ফিলিস্তিনে প্রথম ফিলিস্তিনি সরকার গঠিত হয় যার নাম দেওয়া হয় প্যালেস্টিনিয়ান ন্যাশনাল অথোরিটি। এই শান্তি আলোচনার কারনেও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী এবং পিএলও প্রধান ইয়াসির আরাফাত দুজন শান্তিতে নোবেল পান।
আরও পড়ুন- ইয়াসির আরাফাতের পথই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পথ
এদিকে ১৯৮৭ সালে কিছু কট্টরবাদী ফিলিস্তিনি নেতা পিএলও কে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ আখ্যা দিয়ে নিজেদের আলাদা এক দল তৈরি করে এবং যার নাম দেওয়া হয় হামাস। হামাসের আদর্শ সেই প্রথম দিকের পিএলও-র মতই। এরা ইসরাইলকে অস্বীকার করে এবং তাদের এই ভূমি থেকে চীরতরে মিটিয়ে দিতে চায়।
একদিকে হামাসের করা পিএলওর বিরোধিতা অন্যদিকে ইসরাইলেও রাবিনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে কট্টরবাদীরা। ইসরাইলি কট্টরবাদীরা বলে “ছোট কেন, এক ফোটা জমিও দেওয়া যাবে না ফিলিস্তিনিদের” আবার হামাস প্রশ্ন তোলে, “কেমন করে পিএলও ইহুদিদের সাথে হাত মেলায়”। ইসরাইলে কট্টরবাদীদের এই বিক্ষোভের মাঝেই ১৯৯৫ সালে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে ইসরাইলি এক কট্টরবাদী হত্যা করে প্রধানমন্ত্রী ইৎসাক রাবিনকে। আবার এদিকে হামাস ১৯৯৬ সালের নির্বাচন বয়কট করে এবং ইসরাইলের বিভিন্ন স্থানে সুইসাইড বোম্বিং করে।
ব্যাটেল অফ গাজা
বছর বছর ধরে এভাবেই ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন যুদ্ধ যুদ্ধ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলো। আবার ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে পিএলও এবং হামাসের মধ্যেও উত্তেজনা দিনদিন বাড়ছিলো। এর মাঝেই ২০০৬ সালের ফিলিস্তিন নির্বাচনে খুবই অল্প ব্যবধানে জিতে যায় হামাস। যা দুই দলের উত্তেজনা আর বাড়িয়ে দেয়। গাজা অঞ্চলে হামাসের সংখ্যা গরিষ্ঠতা পাওয়া যায়, আর পশ্চিম তীর পিএলও। নির্বাচনে জয়লাভের পর এই উত্তেজনার মাঝে এক বিশাল বড় বিল্ডিং এর ছাদ থেকে পিএলও এর এক নেতাকে হামাসের কিছু কট্টরবাদী ফেলে হত্যা করলে শুরু হয় হামাস এবং পিএলও এর গৃহযুদ্ধ। যা ব্যাটেল অফ গাজা নামেই পরিচিত। ২০০৭ সালের জুনের ১০-১৫ তারিখ পর্যন্ত চলমান এই গৃহযুদ্ধই ব্যাটেল অফ গাজা নামে পরিচিত। আর সেই থেকেই গাজা স্ট্রিপ হামাসের দখল দারিত্বে এবং পশ্চিম তীর অঞ্চল পিএলও এর কন্ট্রোলে। আর তাই আমরা যখনই ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন সম্পর্কিত কোন খবর দেখি সেখানে গাজা নামটা খুবই কমন থাকে। এবং যেসব মিসাইল ছোড়ার খবর দেখি সবই গাজা থেকেই। অপরদিকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না হলেও পশ্চিম তীর অঞ্চল অনেকটাই শান্তিপূর্ণ এবং নিজেদের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। অপর দিকে রক্তের নেশায় বুদ হয়ে থাকা দিনদিন তলিয়ে যাচ্ছে গাজা। প্রতিবেশি দুই দেশ মিশর এবং ইসরাইল দুই দেশের নিষেধাজ্ঞার চাপে পিস্ট হতে হতে গাজার পার ক্যাপিটা ইনকাম বর্তমানে এসে দাড়িয়েছে ১০০ ডলারেরও নিচে। একমাত্র এয়ারপোর্ট যেটা আছে সেটাও ব্যবহারের অযোগ্য। মাত্র পাঁচটা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে চলা গাজা। সেগুলোর সবও বন্ধ। কারন তরুন সকলেই যে যুদ্ধে ব্যস্ত৷ গত দশ বছরে স্কুল বেড়েছে যার মাত্র ১০০ টির মত। যদিও সঠিক ভাবে পরিচালিত হয় না সেগুলোও।
এই হল ফিলিস্তিন আর ইসরাইলের গত প্রায় ১০০ বছরের রক্তাক্ত ইতিহাস। যেভাবে যাচ্ছে সবকিছু তাতে করে আগামী একশ বছরেও এই রক্তের নেশা থামবে বলে মনে হয় না। একদিকে ইসরাইল যেমন পশ্চিম তীর অঞ্চলে কলোনাইজেশনের দোষে দুষ্ট, তেমনি অপরদিকে গাজা অঞ্চলে হামাস তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের দোষে। হামাস যতদিন গাজা দখল করে রাখবে আর ইসরাইলকে স্বীকৃতি না দেবে আর ইসরাইলের প্রতি অনমনীয় থাকবে ততদিন পর্যন্ত এই সংঘর্ষ থেকে মুক্তির কোন আশাই নেই। এখন পর্যন্ত যা দেখা যায় তাতে তো মনে করা হয় হয় গাজা পুরোপুরি বিলীন হবে নয়তো ইসরাইল। তার আগ পর্যন্ত মুক্তি নেই এই ধ্বংসলীলা থেকে। আর জাতিসংঘের ফিলিস্তিন ও ইসরাইল বাটোয়ারা? ইসরাইল এতটাই বসতি স্থাপন করেছে পশ্চিম তীরে তাই ওটা থাকুক ইতিহাসের পাতায় আর সাধারণ ফিলিস্তিনিদের স্বপ্নেই…
লেখক- প্রবাসী বাঙালি ব্লগার
সারাবাংলা/আরএফ/