ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংকটের আদ্যোপান্ত
২১ মে ২০২১ ১৮:৪৯
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ফিলিস্তিন ছিল তুরস্কের অটোমান বা উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে। সেখানে তখন মুসলিম, স্থানীয় ইহুদী, স্থানীয় খ্রিস্টান এবং আরও ক্ষুদ্র কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠীর (যেমন দ্রুজ) জনগণ শান্তিতে বসবাস করতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানরা জার্মানির পক্ষ নেয়, ফলে বিশ্বযুদ্ধ শেষে হার মানা উসমানীয় সাম্রাজ্যের এলাকা ভাগাভাগি হয়ে যায় ফ্রান্স আর ব্রিটেনের মধ্যে। ফিলিস্তিন পড়ে যায় ব্রিটেনের অধীনে, যার পোশাকি নাম ছিল ব্রিটিশ ম্যান্ডেট অব প্যালেস্টাইন। তাদের এই ম্যান্ডেট দিয়েছিল বর্তমান জাতিসংঘের পূর্বপুরুষ— লিগ অব নেশনস।
এখন একটু পেছনে যাই আবার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধেরও আগে ইউরোপীয় ইহুদীদের মধ্যে জায়োনিজম নামের এক মতবাদের উদ্ভব ঘটে। যে মতবাদে বলা হয় যে, ইহুদী ধর্ম শুধুই একটি ধর্ম নয়, বরং এটি একটা জাতীয়স্বত্ত্বা। অর্থাৎ ইহুদীধর্মের অনুসারীদের একটি দেশ প্রয়োজন। ইহুদীদের ধর্ম পরিচয়ের কারণে পুরো ইউরোপজুড়ে যেভাবে নাজেহাল করা হতো, তাতে তাদের মধ্যে এমন ভাবনা অমূলক ছিল না। সেলফ প্রিজার্ভেশন, অর্থাৎ নিজেদের বাঁচানোর তাগিদ থেকেই তাদের মধ্যে এই একজোট হওয়া চিন্তা ভাবনা শুরু হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই ইউরোপ থেকে কিছু কিছু ইহুদীরা ফিলিস্তিনে মাইগ্রেট করা শুরু করে। তবে সংখ্যাটা ছিল নগন্য। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ব্রিটিশদের প্রয়োজন পড়ল ইহুদীদের। বিশেষ করে বিত্তবান আমেরিকান ইহুদীদের অর্থনৈতিক সমর্থন। ইহুদীদের মন গলাতে ব্রিটেন দিল বেলফোর ডিক্লারেশন, যেখানে বলা হলো যে, ভবিষ্যতে সুযোগমতো ফিলিস্তিনে ইহুদীদের জন্য একটি দেশ তৈরি করার চেষ্টা করবে ব্রিটেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ‘একদিন এখানেই আমাদের দেশ হবে’ এই আশ্বাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে (মূলত ইউরোপের বিভিন্ন দেশ) ইহুদীরা ব্রিটিশ ফিলিস্তিনে অভিবাসিত হতে শুরু করে এবং স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে জমিজমা কিনে চাষবাস শুরু করে। পরে অভিবাসীর সংখ্যা বাড়তে থাকায়, আর স্থানীয়দের সঙ্গে কিছুটা ঝগড়াবিবাদ শুরু হওয়ার কারণে ব্রিটিশরা অভিবাসীর সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেয় ১৯৩০ সালের দিকে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ইহুদীরা ফিলিস্তিনি ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী (মিলিশিয়া) গঠন শুরু করে। ফিলিস্তিনিরাও নিজস্ব বাহিনী তৈরি করে, তবে তারা মূলত ইহুদীদের সঙ্গেই সংঘাতে যায়, ব্রিটিশদের সঙ্গে নয়।
এর মধ্যে শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং হিটলারের গণহারে ইহুদীনিধন। ফলাফল হিসাবে লাখ লাখ ইহুদী ইউরোপ থেকে পালিয়ে চলে এলো ফিলিস্তিনে, আর ইহুদীদের প্রতি সহমর্মিতায় ফিলিস্তিনিদের ইহুদীদের জন্য একটি ‘হোমল্যান্ড’ স্থাপনের সমর্থনও বিশ্ব মোড়লদের মধ্যে তৈরি হলো। ওদিকে অভিবাসী ইহুদী আর স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংঘাত বেড়েই যাচ্ছিল, যা ব্রিটিশরাও সামলাতে পারছিল না। এমন অবস্থায় জাতিসংঘের মাধ্যমে ব্রিটেন ১৯৪৭ সালে প্রস্তাব করল— ব্রিটিশ ম্যান্ডেটেরি ফিলিস্তিনে দুটি দেশ। একটি ইহুদীদের জন্য ইসরাইল, আর একটি বাকি আরবদের জন্য ফিলিস্তিন। এ দুটি দেশ স্থাপন করে তারা ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাবে, যেভাবে তারা ভারত আর পাকিস্তান রেখে গিয়েছিল। তবে জেরুজালেমকে জাতিসংঘ এই দুই দেশের কোনোটাতেই অন্তর্ভুক্ত না করে একটা বিশেষ আন্তর্জাতিক এলাকা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার কথা বলেছিল। কাগজে কলমে (এবং হাইন্ডসাইটে) অবস্থার বিবেচনায় বেশ ভালো প্রস্তাব ছিল সেটি।
ম্যান্ডেট ফর প্যালেস্টাইন। এর বলেই ফিলিস্তিন শাসন করে যাচ্ছিল ব্রিটেন।
কিন্তু ইহুদীরা এই প্রস্তাবে রাজী থাকলেও স্থানীয় আরবরা এবং আশেপাশের আরব দেশগুলো (যারা নিজেরাও স্বাধীন হয়েছে মাত্র কয়েক বছর আগে) এই প্রস্তাবে রাজী ছিল না। ব্রিটিশরা অনেক চেষ্টাচরিত্র করেও দুই পক্ষের মতের মিল করতে না পেরে ঘোষণা দিল যে, তারা ১৯৪৮ সালের ১৫ মে সৈন্যসামন্ত গুটিয়ে চলে যাবে, তার পরে ফিলিস্তিনের কী হবে সেটার দায়িত্ব তারা নেবে না। ১৯৪৭ সালের দেওয়া দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা আর ‘৪৮ সালে ব্রিটিশদের ম্যান্ডেট শাসন শেষ হওয়ার মধ্যকার সময়ে ইহুদী আর ফিলিস্তিনি আরবদের সাংগঠনিক কার্যকলাপ ইতিহাসের পথ বদলে দেয়। যার ফলাফল আজও আমরা দেখছি।
ফিলিস্তিনে সেসময়ে থাকা ইহুদীদের মধ্যে একটা বড় অংশ ছিল উচ্চশিক্ষিত ইউরোপীয়ান ‘আশকেনাজি’ ইহুদী, যারা স্থানীয় আরবদের চেয়ে জ্ঞান, বিদ্যা, বুদ্ধিতে অগ্রসর এবং সাংগঠনিকভাবে অনেক গোছানো। তাদের নেতৃত্বগুণও ছিল ভালো। কয়েক বছর আগেই ঘটে যাওয়া হলোকাস্টের স্মৃতি তাদের কাছে ভয়ালরকম জীবন্ত এবং এটাই তাদের একাট্টা করে রেখেছিল। প্রয়োজনে তারা জীবন দিতে প্রস্তুত ছিল, কিন্তু একটি ইহুদী দেশ স্থাপনের দ্বারপ্রান্তে এসে সেই স্বপ্ন হারাতে রাজী ছিল না। ব্রিটিশরা চলে গেলে আরবদের (শুধু আরব মিলিশিয়া নয়, আশেপাশের আরব রাষ্ট্রগুলোর প্রতিষ্ঠিত সামরিক বাহিনীও) সঙ্গে তাদের সর্বাত্মক যুদ্ধ করতে হবে, এটা তারা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিল এবং ভেতরে ভেতরে তারা সেভাবেই ব্যাপক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। তারা ইহুদী এলাকাতে গোপন অস্ত্র কারখানা স্থাপন করে রেখেছিল অনেক আগেই। আমেরিকান ইহুদীদের অর্থ সহায়তায় গোপনে অস্ত্র কিনে জাহাজে লোড করে বসেছিল— ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যাতে সেগুলো আনা যায়। শুধু তাই নয়, তারা এই সময়ে যুদ্ধবিমানও কিনে বসিয়ে রেখেছিল ব্রিটিশদের চলে যাওয়ার অপেক্ষায়।
দুই পক্ষের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের দুই রাষ্ট্র স্থাপনের সিদ্ধান্তের ঘোষণা আসার সাথে সাথেই। এবং আরবদের পক্ষে আরব লিবারেশন আর্মি, আর্মি অফ দ্যা হোলি ওয়ার আর অন্য পক্ষে হাগানাহ, পালমাখ, ইরগুন, লেহি এসব বাহিনী পুরো ফিলিস্তিন জুড়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছিল। আর ব্রিটিশরা যুদ্ধ করছিল দুই দলের সাথেই। তবে ইহুদীদের প্রস্তুতিপর্বের পার্থক্যই দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণ করে দেয়। ইহুদীরা সুপিরিয়র প্ল্যান নিয়ে জানবাজী রেখে লড়েছিল, পক্ষান্তরে আরব দেশগুলোর সেনাবাহিনী ইহুদীদের সামরিক ক্ষমতা আন্দাজ করতে পারেনি। ইহুদীদের দেওয়া সামরিক সারপ্রাইজ আরবদের হতবিহ্বল করে দিয়েছিল। ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসা সাত আরব দেশের মধ্যে মন দিয়ে কেবল যুদ্ধ করেছিল মিশর আর জর্ডান। তাদের মধ্যেও আবার জর্ডান নিজস্ব এজেন্ডা (প্যালেস্টাইনের জমি দখল করে নিজ দেশের আয়তন বাড়ানো) নিয়ে যুদ্ধ করছিল।
১৫ মে ব্রিটিশদের প্রত্যর্পণের ৮ ঘণ্টা আগে ১৪ মে বেন গুরিয়ন জাতিসংঘের ১৮১ নম্বর রেজোল্যুশন মোতাবেক ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম ঘোষণা করেন। যেটুকু ভূমি ইহুদী রাষ্ট্রকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল সেটুকু নিয়েই রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়। কিন্তু যেহেতু আরবলিগ এই রেজোল্যুশন, অর্থাৎ ফিলিস্তিনের ভূমিতে ইহুদী রাষ্ট্রের অবস্থানকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, আরব লীগের সদস্য সাতটি দেশের সেনাবাহিনী সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসরাইলকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যুদ্ধ করতে ১৫ তারিখ মিশর, জর্ডান, সিরিয়া আর লেবানন সীমান্ত দিয়ে মধ্যরাতে ফিলিস্তিনে ঢুকে পড়ে।
শুরুতে ইসরাইলের পক্ষে যুদ্ধ করার মতো সেনা সংখ্যা ছিল প্রায় ২৯ হাজার, যারা সবাই ছিল মিলিশিয়া। আর অন্যদিকে আরবদের পক্ষে প্রশিক্ষিত যোদ্ধা ছিল প্রায় ১৩ হাজার, আর সাথে ৩৫০০ আরব/ফিলিস্তিনি মিলিশিয়া। তবে ২৯ হাজার যোদ্ধা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকলেও ইসরাইলের কাছে অস্ত্র ছিল ১৩ হাজার যোদ্ধার জন্য। যুদ্ধের বর্ণনায় না গিয়ে বলি, ইহুদীদের জান বাজী রেখে যুদ্ধ করার প্রবণতা থেকে তারা প্রতিটি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রচণ্ড প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যার জন্য আরব বাহিনীগুলো প্রস্তুত ছিল না। ১৫ মে থেকে চলা যুদ্ধ ১১ জুনে প্রথম যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছায়। যুদ্ধবিরতির ফাঁকে ইহুদীরা দ্রুত তাদের সৈন্য সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন ভারী অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদের চালান সংগ্রহ করে, যার মধ্যে ছিল যুদ্ধবিমানও। যুদ্ধের শুরুতে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠিত সেনাবাহিনী ছিল না, কিন্তু এক মাসের যুদ্ধবিরতি শেষে যখন আবার যুদ্ধ শুরু হয়, তখন তাদের বেশ ভালোভাবে সজ্জিত এবং সুগঠিত সেনাবাহিনীর পাশাপাশি বিমানবাহিনী এবং ছোট আকারের একটা নৌবাহিনীও গঠিত হয়ে গিয়েছিল।
অন্যদিকে আরব সেনাবাহিনীগুলো সেন্ট্রাল কমান্ডের অধীনে ছিল না, কোনো সমন্বয় ছাড়াই যে যার মতো যুদ্ধ করছিল। এসবের ফলাফল হিসেবে ১৯৪৯ সালে যখন আরবদের সাথে ইসরাইলের শান্তিচুক্তি হলো, তখন দেখা গেল পূর্বতন ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা থেকে গেছে মিশরের অধীনে, পশ্চিম তীর থেকে গেছে জর্ডানের অধীনে, আর পূর্বতন ফিলিস্তিনের বাকি অংশ দখল করে বসে আছে ইসরাইল। এই যুদ্ধের শেষে দেখা গেলো ইসরাইলের জন্য বরাদ্দকৃত ভূমির বাইরে জাতিসংঘ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য যেটুকু ভূমি বরাদ্দ দিয়েছিল, তার ৬০ শতাংশ এখন ইসরাইলের দখলে।
জেরুজালেমের এক অংশ চলে গেল ইসরাইলের হাতে, আর আল আকসা কমপ্লেক্সসহ পূর্ব জেরুজালেম রইল জর্ডানের অধীনে। সুতরাং কার্যত ফিলিস্তিন দেশের কোনো অস্তিত্ব আর মানচিত্রে থাকলো না। পুরোটাই হয় ইসরাইল, নয়তো মিশর, নয়তো জর্ডানের দখলে। ১৯৫০ সালে জর্ডান অফিসিয়ালি পশ্চিম তীর এলাকাকে জর্ডানের অন্তর্ভুক্ত করে আইন প্রণয়ন করে এবং সেখানে অবস্থানরত সকল ফিলিস্তিনিদের জর্ডানের নাগরিকত্ব দেয়। যুদ্ধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রায় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু হয়ে বিভিন্ন দেশের শরণার্থী ক্যাম্পে অবস্থান নেয়, যাদের সংখ্যা বর্তমানে ৭০ লাখ। সেই থেকে শুরু হলো ফিলিস্তিন সংকট।
জাতিসংঘের প্রস্তাবিত ইহুদী রাষ্ট্র ও আরব রাষ্ট্রের মানচিত্র।
মাঝে ইসরাইলের জাহাজকে চলাফেরায় বাধা দেওয়ার কারণে ১৯৫৬ সালে ইসরাইল একবার তৎকালীন আরব দেশগুলোর মধ্যে সাময়িকভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী মিশরের সিনাই উপত্যকায় দখলদারি হামলা চালায় এবং পরে ইসরাইলি জাহাজের চলাফেরায় বাধা দেওয়া হবে না এই শর্তে মিশরের দখলকৃত এলাকা ছেড়ে দিয়ে নিজেদের সীমান্তে ফিরে আসে। কিন্তু শক্তিমত্তার চিন্তায় উন্মত্ত মিশর আবারও ১৯৬৭ সালের জুনে ঘোষণা দেয় যে, তারা ইসরাইলি জাহাজকে তিরান প্রণালীতে বাঁধা দেবে। ইসরাইল এই ঘোষণাকে উস্কানীমুলক আক্রমণ ধরে নিয়ে পূর্বে দেওয়া হুমকিকে বাস্তবায়ন করে মিশরের বিমান ঘাটিগুলোতে অতর্কিত হামলা চালিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে কার্যত মিশরীয় বিমানবাহিনীকে অচল করে দেয়। এবং ইসরাইল এয়ার সুপিরিওরিটি প্রতিষ্ঠিত করে, যা পরবর্তীতে তাদের গ্রাউন্ড অ্যাটাকের সময়ে নির্বিঘ্নে এয়ার সাপোর্ট দিতে সহায়তা করে। ছয় দিনের যুদ্ধে কাগজে কলমে পরাক্রমশালী মিশরীয় বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে মিশরের কাছ থেকে মিশরের দখলে থাকা ফিলিস্তিনিদে গাজা উপত্যকাসহ মিশরের নিজের এলাকা সিনাই উপত্যকা আবার ছিনিয়ে নেয় ইসরাইল। ওদিকে মিশর আর জর্ডানের মধ্যে ছিল প্রতিরক্ষা চুক্তি, এবং জর্ডানের সেনাবাহিনীকে মিশরের কমান্ডে দেওয়া হয়েছিল। জর্ডান সেনাবাহিনী মিশরীয় কমান্ডে ইসরাইলকে আক্রমণ করে এবং ইসরাইল এখানেও এয়ার সুপিরিওরিটি প্রতিষ্ঠা করে জর্ডান বাহিনীকে ধাওয়া করে জর্ডান নদীয় পূর্ব পাশে তাড়িয়ে দিয়ে পুরো পশ্চিম তীর দখল করে নেয়। আর সিরিয়া ৬ দিনের যুদ্ধের চতুর্থ দিনে গোলান হাইটস থেকে আর্টিলারি হামলা করার মাধ্যমে যুদ্ধ অংশগ্রহণ করে।
একই প্রক্রিয়ায় সিরিয়ান বিমানবাহিনীকে পঙ্গু বানিয়ে দুই দিনের মধ্যে গ্রাউন্ড অ্যাটাকের মাধ্যমে গোলান হাইটসও সিরিয়ার কাছ থেকে দখল করে নেয় ইসরাইল। যুদ্ধ জয়ের পরে তৎকালীন ইসরাইলি সেনাপ্রধান ইজহাক যার্বিন তার দেশের এই ভয়ানক আক্রমণ এবং সফলতার কারণ হিসাবে বলেছিলেন, যখন যুদ্ধে না জেতা মানে নিজেদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া, তখন যুদ্ধে জেতার স্পৃহা বহুগুণ বেড়ে যায়। ইসরাইলিদের এই সেলফ প্রিজারভেশন থেকে উদ্ভূত আগ্রাসনই তাদের সবগুলো যুদ্ধে বিজয় এনে দেওয়ার কারণ। এবং ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে চলমান সংঘাতেরও কারণ। ইসরাইল সবসময় দাবী করে যে, নিজেদের রক্ষা করতেই তারা আক্রমণ করে।
যাইহোক, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পরে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, যুদ্ধ করে ইসরাইলকে নিশ্চিহ্ন করে সেখানে অখণ্ড ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠা করা তো অসম্ভবই বরং চেষ্টা করলে নিজের দেশের ভূখণ্ড ইসরাইলের কাছে হারানোর আশঙ্কা আছে। তারপরেও ১৯৭৩ সালে মিশর একবার চেষ্টা করেছিল ইসরাইলের কাছে ছিনতাই হয়ে যাওয়া সিনাই উপত্যকা নিজেদের দখলে ফিরিয়ে আনার। শুরুতে ইসরাইলকে চমকে দিতে পারলেও আবারও হার মানতে হয় মিশরকে। এর পরেই মিশর ইসরাইল ইস্যুতে হাত পা ধুয়ে ফেলে শান্তি বজায় রাখার নীতি নেয় এবং পরে ইসরাইলের সঙ্গে অফিসিয়ালি শান্তি চুক্তি করার মাধ্যমে সিনাই উপত্যকা নিজেদের অধীনে ফেরত পায়। অর্থাৎ ইসরাইল তার দখলে থাকা সিনাই উপত্যকা ছেড়ে দিয়ে আবার ১৯৪৯ সালের সীমান্তে ফিরে যায়।
কিন্তু ইসরাইল গাজা উপত্যকাকে আর ফেরত দেয়নি মিশরের কাছে। পূর্বতন ফিলিস্তিনের বাকি অংশের মতো গাজা উপত্যকা থাকে ইসরাইলের দখলে। যেটুকু অংশ নিয়ে ফিলিস্তিন নামের দেশটা হওয়ার কথা ছিল, তার পুরোটাই চলে গেল ইসরাইলের দখলে। ফিলিস্তিন দেশটা রইল কাগজে কলমে আর মানচিত্রে।
সাত রাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরাইলের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরের অবস্থা। পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকা ও দক্ষিণ পশ্চিমের অল্প কিছু এলাকা বাদে পুরো ফিলিস্তিনই চলে গেছে ইসরাইলের দখলে।
শুরুতে ফিলিস্তিনিরা যখন প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে, পিএলও বা অন্যান্য সংগঠনগুলোর প্রত্যেকের লক্ষ্য ছিল ইসরাইলকে নিশ্চিহ্ন করে সেখানে একক ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠা করা। এই অসম্ভব বাস্তবতায় বসবাস করাও হচ্ছে ইসরাইল ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান না হওয়ার মূল কার। এই আশা যে অবাস্তব, তা প্রথমে বুঝতে পারেন ইয়াসির আরাফাত। তার অধীনে পিএলও আর ইসরাইলের মধ্যে চুক্তি হওয়ার মাধ্যমেই দেশ হিসাবে ফিলিস্তিনের আত্মপ্রকাশের একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা দেখা দেয়— যদিও তখন দেরী হয়ে গেছে অনেক। পশ্চিম তীরে অনেক ইসরাইলি সেটলার ইতিমধ্যে ঢুকে গেছে। ইয়াসির আরাফাতের এই দুই দেশের সহাবস্থানের নীতি নির্বাসনে থাকা ফিলিস্তিনিরা ভালোভাবে নেয়নি। তবে অল্প কিছু উগ্র ডানপন্থী সংস্থা এবং তাদের সমর্থকরা বাদে ইসরাইলে আটকে পড়া ফিলিস্তিনিরা শুরুতে একে স্বাগত জানায়। কিন্তু যারা দুই দেশের সহাবস্থান মেনে নিতে চান না, অখণ্ড ফিলিস্তিন স্থাপনের স্বপ্ন দেখেন, তারা ভাবতে চান না ইসরাইলের বর্তমান নাগরিকদের কী হবে— যাদের মধ্যে ইসরাইলের ১৮ শতাংশ মুসলিম নাগরিকরাও আছে। অন্যদিকে ইসরাইল তার অস্তিত্ব রক্ষায় ছাড় দিতে নারাজ। ইসরাইলের জনগণের একাংশ দুই রাষ্ট্রের সহাবস্থান মেনে নিতে চাইলেও সেখানের ডানপন্থী এবং জায়োনিস্টরা এটা মেনে নেয় না। এবং ইসরাইলের ভেতর আটকা পড়া (গাজা এবং পশ্চিম তীর নিয়ে গঠিত ফিলিস্তিনের নাগরিক, যা মূলত ইসরাইলের দখলে) ফিলিস্তিনিদের কী হবে এই প্রশ্নের উত্তরও ইসরাইলিরা খোঁজার চেষ্টা করে না। এসব সমস্যার পাশাপাশি যোগ হয়েছে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ। ধর্মীয় কারণে হামাসের মতো সংগঠন চায় সকল ইহুদীদের খতম করতে, একই কারণে উগ্রবাদী জায়োনিস্টরা চায় ফিলিস্তিনি মুসলিমদের ‘ফাইনাল সলিউশন’ ধরিয়ে দিতে। যুগ যুগ ধরে অত্যাচারিত ফিলিস্তিনিরাও আর কিছু না করতে পেরে হামাসের মতো সংগঠনকে সমর্থন দেয়, কারণ তারা দেখে একমাত্র হামাসই ইসরাইলের গায়ে যা একটু আঘাত করতে পারছে। কিন্তু এই আঘাতের ফলে যে তাদের পুরো দেশের জনগণকে আরও বেশি ভোগতে হচ্ছে সেটা বুঝতে পারছে না, অথবা তাদের বুঝতে দেওয়া হচ্ছে না।
পশ্চিম তীরের বর্তমান অবস্থা।
বাস্তবতা হচ্ছে, ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের দুই দেশের নাগরিকদের বাস্তুহারা করা যাবে না। সহাবস্থানের বাস্তবতা মেনে নেওয়াই এখানে শান্তি আনার একমাত্র পথ। যতদিন পর্যন্ত এখানে একক দেশ, সেটা একক ফিলিস্তিন হোক, কিংবা একক ইসরাইল স্থাপনের খায়েশ লোকে ত্যাগ করতে পারবে না, যতদিন পর্যন্ত এখানে একক রাষ্ট্র স্থাপনের খায়েশে উস্কানি দেওয়ার লোকের অভাব না হবে, ততদিন এই সমস্যার কোনো শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে না। আর সামরিক সমাধানও যে হবে না সেটাও অনেক আগে থেকেই পরিষ্কার।
পশ্চিম তীরে যত বেশি সময় ইসরাইলি দখলদারিত্ব থাকবে, ইসরাইল তত বেশি ফিলিস্তিনি ভূমি খেতে পারবে। পশ্চিম তীরে এরিয়া এ বি এবং সি বলে যে ভাগ করা হয়েছিল, তার সি অংশে ইসরাইল প্রতিনিয়ত দখন বাড়াচ্ছে। ইসরাইলের সঙ্গে পিএলওর শান্তিচুক্তি মোতাবেক পশ্চিম তীরের সি এরিয়াগুলো ফিলিস্তিন সরকারের কাছে ফেরত দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করা প্রয়োজন ইসরাইলের উপর। কিন্তু সেটা কখনোই সম্ভব হবে না যতক্ষণ না গাজা ইসরাইলের প্রতি হুমকি হয়ে থাকে।
সমস্যা হচ্ছে, সমস্যা সমাধানের যে অল্প কয়টা পথ খোলা আছে, সেগুলো অজনপ্রিয় রাস্তা। কেউই সেই পথে যেতে চায় না, বরং বিপরীতে কাজ করার জন্য উৎসাহ দেওয়ার লোকের অভাব নেই। সুতরাং ইসরাইলি এবং ফিলিস্তিনি, দুই তরফের লোকেরই মানসিকতায় যতদিন পর্যন্ত আমূল পরিবর্তন না আসবে, ততদিন এই সমস্যার সমাধান হবে না।
আরও পড়ুন- ইয়াসির আরাফাতের পথই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পথ
ফিলিস্তিন-ইসরাইলের প্রায় শত বছরের রক্তাক্ত ইতিহাস