Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সমন্বিত পরিকল্পনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিন এখনই

সফিউল আযম
১ জুন ২০২১ ২০:৫৫

করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ায় গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে স্কুল, কলেজসহ সব ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হলেও আজ অবধি চালু হয়নি। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ভয়াবহ ক্ষতি থেকে কিছুটা হলেও উত্তরণের জন্য সীমিত পরিসরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। যদিও গত ২৬ মে এক ভার্চুয়াল আলোচনায় শিক্ষামন্ত্রী আভাস দিয়েছেন, প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১৩ জুন খুলে দেওয়ার বিষয়টি ভাবছে সরকার। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া হবে সব শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর ভ্যাকসিনপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার পর। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার বিষয়টি এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নয়, যা নির্ভর করবে সার্বিক বিষয়ের ওপর।

বিজ্ঞাপন

কিছুদিন আগে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কৌতূহলবশত বিভিন্ন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গে একান্তে আলাপের সুযোগ হয়। সবার মধ্যেই দীর্ঘশ্বাস আর কান্না। গ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থা বলা যায় অনেকাংশেই ভেঙে পড়েছে। গণস্বাক্ষরতা অভিযানের সাম্প্রতিক জরিপে উঠে এসেছে, দীর্ঘ সময় অনলাইন ও সংসদ টিভিতে ক্লাস চললেও ডিভাইস ও নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় ৬৮ শতাংশ শিক্ষার্থীর কাছে সেই সেবা পৌঁছায়নি। দীর্ঘদিন শিক্ষা কার্যক্রম থেকে দূরে থাকার কারণে এখন ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ও ৭৬ শতাংশ অভিভাবক চাইছেন স্কুলগুলো স্কুলে দেওয়া হোক।

বিজ্ঞাপন

গ্রামের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের কথা বলি। তিনি জানান, এ বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থী ১৮৬ জনের মধ্যে বাড়ি বাড়ি গিয়েও মাত্র ১০১ জন শিক্ষার্থীকে রেজিস্ট্রেশন করাতে সক্ষম হয়েছেন। এই ১০১ জন শিক্ষার্থীকেও শেষ পর্যন্ত পাওয়া যাবে না বলে মনে করছেন তিনি। কারণ তাদের বেশিরভাগই শিক্ষকের অনুরোধে রেজিস্ট্রেশন করেছে।

এদিকে, সম্প্রতি প্রকাশিত এডুকেশন ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিকে ৩৮ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার পরও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যেতে পারে। ২০ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়ার হার বাড়বে এবং ৮ দশমিক ৭ শতাংশ মনে করেন, শিক্ষার্থীরা শিশুশ্রমে নিযুক্ত হতে পারে। মাধ্যমিকে ৪১ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, বেশি শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতে পারে। শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে এখনই প্রয়োজন বহুমুখী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ। আগামী বাজেটেও পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখতে হবে।

অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, পড়ালেখা না থাকায় সে ঢাকায় পাড়ি জমায়। একটি গ্যারেজে চাকরি নেয়। সামান্য আয়ে দরিদ্র পরিবারকে কিছুটা হলেও সহায়তা করতে পারে। ওই শিক্ষার্থী জানায়, তার পড়ালেখায় ফেরার সুযোগ কম। তার পরিবারের আগ্রহ কম তো বটেই, সে নিজেও টাকা-পয়সা উপার্জনের পথ খুঁজে পাওয়ায় পড়ালেখায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।

এ কথা ঠিক যে করোনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশুশ্রমের হার অনেক বেড়ে যাবে। আগের মতো শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে দেখা যাবে না। আগের বছরগুলোর চেয়ে এবার ঝরে পড়ার হার নিশ্চিতভাবেই বাড়বে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা করোনাকালে বিভিন্ন কাজে যুক্ত হয়েছে, তাদের অনেকেই আর স্কুলে ফিরবে না। সেজন্য পরিবারগুলোকে প্রণোদনা দিয়ে হলেও স্কুলমুখী করার ব্যাপক কার্যক্রম নিতে হবে। ২০১৯ সালে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ, মাধ্যমিকে ৩৭ দশমিক ৬২ শতাংশ। করোনা পরিস্থিতিতে পরিবারে অভাবের কারণে শিশুরা ঝুঁকেছে শ্রমের দিকে। এসডিজি অর্জনে সরকার শিশুশ্রম নিরসনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম ও ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম বন্ধের পরিকল্পনা সরকারের থাকলেও বাস্তবে কতটা সম্ভব, তা আজ প্রশ্নের উদ্রেক করে।

ঢাকায় এক প্রতিবেশী জানালেন, নিজের সন্তানকে আগে মোবাইল, ট্যাব কিংবা ল্যাপটপ হাতে তুলে দিতেন না। কিন্তু অনলাইন ক্লাস করতে করতে তারা মোবাইলে এখন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। সারাদিন বাসায় থাকতে থাকতে মানসিকভাবেও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত। গেমসের আসক্তি বেড়েছে। খিটখিটে মেজাজ সারাদিন থাকে। চাঁদপুরে সপ্তম শেণিতে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর অভিভাবকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, গত দেড় বছর ধরে তিনি বাড়িতে তার ছেলেকে পড়ার টেবিলে বসাতেই পারছেন না।

এদিকে, গ্রামের স্কুলে কোনো ধরনের অনলাইন ক্লাসও নেই। সারাদিন ঘুরে বেড়ায়। রাতে বাসায় ফিরলেও পড়ার টেবিলে নেওয়া যায় না। এমনকি প্রহার করলেও না। এমন অবস্থায় এই অভিভাবক বুঝে উঠতে পারছেন না কী করবেন। এ কথা ঠিক যে দীর্ঘসময় বাড়িতে থাকায় শিশুদের মানসিক গঠনে নেতিবাচক প্রভাব পরছে। তারা অনেকাংশে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। তাদের মধ্যে উদ্বেগ, আতঙ্ক, বিষন্নতা, হতাশা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আচরণগত সমস্যা দেখা যাচ্ছে। সন্তানের এই আচরণগত দিকটির প্রতি বিশেষ নজর রাখতে হবে।

ব্র্যাক, ইউএন উইমেন ও নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির যৌথভাবে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, করোনাকালে বিয়ের মধ্যে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ বা ৭৭ শতাংশ কনের বয়স ১৮ বছরের নিচে, যা ২০১৮ সালে জরিপকৃত জাতীয় বাল্যবিয়ের হার ৫১ শতাংশের চেয়েও ২৬ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘বাল্যবিয়ের অবস্থা দ্রুত বিশ্লেষণ: করোনাকাল ২০২০’ বিষয়ক জরিপ প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতিবছর বাংলাদেশের ৫১ শতাংশ নারীর বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে। বাল্যবিয়ের এই চর্চা সামাজিক ও প্রথাগতভাবে হয়ে থাকে। তবে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে আরও নেতিবাচক অবস্থা দেখা যাচ্ছে। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সাত মাসে বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে ১৩ হাজার ৮৮৬টি। যেকোনো সময়ের চেয়ে এই মাত্রা অনেক বেশি। বিদ্যালয় বন্ধ থাকার মারাত্মক কুফল এই বাল্যবিবাহ। এই সামাজিক ব্যধি দূর করতে এখনই কর্মপরিকল্পনা করতে হবে।

এডুকেশন ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়, দ্রুত ক্লাসে ফিরে যেতে চায় ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। ৭৬ শতাংশ অভিভাবক ও ৭৩ শতাংশ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দ্রুত স্কুল খোলার পক্ষে মত দিয়েছেন। ৫৮ শতাংশ শিক্ষক ও ৫২ শতাংশ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা একই মত দিয়েছেন। ৮২ শতাংশ শিক্ষক স্কুল খুলে দেওয়ার আগে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা তথা মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যবহার এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। শিক্ষা ব্যবস্থা ঠিক রাখতে ধাপে ধাপে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করা প্রয়োজন। এই কাজটি যত দ্রুত করা যায় ততই দেশের জন্য মঙ্গল হবে।

প্রতিটি শ্রেণির সিলেবাস যেহেতু শিশুদের বয়স ও বিকাশ অনুযায়ী তৈরি করা, সুতরাং কোনো রকম পড়ালেখা ছাড়াই পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলে শিশুর সঠিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। পরবর্তী শ্রেণিতে পড়ার ধারাবাহিকতা না পেলে শিক্ষার্থীদের সামনে এগিয়ে যাওয়া অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন হতে পারে। তবে বিদ্যালয় খোলার আগে শ্রেণিভিত্তিক সিলেবাস পর্যালোচনা করে অতি প্রয়োজনীয় বিষয় ও অধ্যায়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে সংক্ষিপ্ত পাঠক্রম তৈরি করা প্রয়োজন। সরকার এরই মধ্যে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস তৈরি করেছে বলে জানা গেছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও গ্রামের শিক্ষার্থীদের পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। শহর কিংবা মফস্বলের শিক্ষার্থীরা কিছুটা হলেও পড়ালেখায় থাকলেও গ্রামের শিক্ষার্থীর এসব থেকে বঞ্চিত।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া, শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ এবং শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার, সামাজিক অস্থিরতা, মাদকের ভয়াবহতা, মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। সুন্দর ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে না পারলে বাংলাদেশ নারী শিক্ষা, মাতৃমৃত্যু, শিশুশ্রম রোধ ও বাল্যববিাহ রোধে যেসব অর্জন এরই মধ্যে সারাবিশ্বে সুনাম অর্জন করেছে, তা নিমেষেই শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর শিক্ষা ব্যবস্থার এমন ক্ষতি কখনো হয়নি। এখন প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে বহুমুখী পদক্ষেপ।

লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক। ইমেইল: [email protected]

সারাবাংলা/টিআর

কোভিড-১৯ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষা ব্যবস্থা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর