Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শিক্ষা ও স্বাস্থ্যবিধি সমন্বয় জরুরি

গোপাল অধিকারী
১ জুন ২০২১ ২১:১৮

মানুষের মৌলিক চাহিদা ছিল পাঁচটি— খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। বর্তমানে আরও একটি বিষয় যোগ হয়েছে— নিরাপত্তা। মৌলিক চাহিদাগুলো সবকয়টিই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপনের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ শিক্ষা ছাড়া সঠিক পথ উপলব্ধি করা যায় না, আবার সুস্থতা ছাড়াও সঠিক পথ গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব না।

করোনাকালে এই দু’টি বিষয় নিয়েই দুশ্চিন্তা রয়েছে। করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতের নাজুক পরিস্থিতি আমরা দেখেছি। করোনা পরিস্থিতি সুবিধাজনক স্থানে থাকায় নিরাপদে স্বাস্থ্য বিভাগ। কিন্তু অনিয়ম পিছু ছাড়ছে না স্বাস্থ্য বিভাগের। তবে করোনাকালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থার। গত বছরের ৮ মার্চ দেশে করোনার সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পর ১৮ মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হয়। সংক্রমণের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি দফায় দফায় বাড়ানো হয়। সবশেষ ১২ জুন পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা আছে। গত ২৬ মে দুপুরে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি আগামী ১২ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এরপর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে। আমাদের সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে ক্লাস নিতে পারব।’

বিজ্ঞাপন

এর ঠিক দুই দিন পর শনিবার (২৯ মে) জাতীয় প্রেস ক্লাবে জাতীয় প্রত্যাশা সংগঠনের আয়োজনে প্রয়াত আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরুর স্মরণসভায় শিক্ষামন্ত্রী বলেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আগামী ১৩ জুন থেকে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে। সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে নামলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর পরিস্থিতি খারাপ হলে শিক্ষার্থীদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হবে না।

বিজ্ঞাপন

জীব ও জগতে উদ্ভিদ ও প্রাণী একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। ঠিক একইভাবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। সুস্থতা ছাড়া শিক্ষা লাভ হবে না, আবার শিক্ষাহীন সুস্থ সমাজও কাম্য নয়। একইভাবে সবকিছুর ক্রিয়া-বিক্রিয়া আছে। যেমন— এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে শিশুরা। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খোলার পক্ষে মত আছে অনেকের। কিন্তু স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে গিয়ে শিক্ষায় ঝুঁকি হতে পারে কি না, সেটিও কিন্তু ভাবনার বিষয়।

করোনার থাবায় দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। করোনা মহামারিতে প্রায় ১৫ মাস ধরে বন্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরাসরি পাঠদান। বন্ধ আছে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা। থেমে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যক্রম। স্কুল-কলেজে অভ্যন্তরীণ কিছু পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে অনলাইনে। কিন্তু তাতে শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্দেশ্য পুরোপুরি পূরণ হচ্ছে না। ক্লাস বন্ধ থাকায় সরকার সংসদ টেলিভিশন, বেতার ও অনলাইন ক্লাসের উদ্যোগ নেয়। তবে সব শিক্ষার্থী এ সুবিধা পাচ্ছে না। শহুরে কিছু শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাস করতে পারলেও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা নানা সমস্যার কারণে মোটেও অনলাইন ক্লাস করতে পারেনি। মফস্বলের শিক্ষকরাও অনলাইন ক্লাস নেন না। ফলে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। এই বন্ধের ফলে চরম ক্ষতির শিকার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যায়ের প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থী ও ৫০ লাখ শিক্ষক। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতিও কম নয়। করোনার প্রভাবে ব্যাপক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, বেড়েছে বাল্যবিয়েও। শহুরে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে থাকতে দেখা দিয়েছে শারীরিক ও মানসিক নানা সমস্যাও।

করোনায় শিক্ষা খাতের ব্যাপক ক্ষতির চিত্রও উঠে এসেছে কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার ভিন্ন ভিন্ন জরিপে। গণসাক্ষরতা অভিযানের সমীক্ষা অনুযায়ী, ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ও দূরশিক্ষণ বা বেতার, টেলিভিশন, অনলাইনের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দেওয়া পাঠদানের আওতায় এসেছে। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি ৯২ শতাংশ আর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী টেলিভিশনের পাঠদানের আওতায় এসেছে।

পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রাথমিকের ১৯ শতাংশ ও মাধ্যমিকের ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী করোনার এই সময়ে নিয়মিত পড়ালেখার একদম বাইরে রয়েছে। সম্প্রতি পরিচালিত এই গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের ৯৭ শতাংশ অভিভাবক তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চান। এসজিডি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম পরিচালিত এক জরিপে ২৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার তথ্য উঠে এসেছে। ফলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার বাইরে রাখলে শিক্ষা নিয়ে ঝুঁকিও কম হবে না। সরকার শিক্ষার হার বাড়াতে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। শিক্ষার্থীরা এখন মাসিক বৃত্তি ও অন্যান্য সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু করোনায় যদি ঝরে পরার পরিসংখ্যান বাড়ে, তাহলে ক্ষুণ্ন হবে সরকারের শিক্ষা নিয়ে ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের এই বিষয়টিও ভাবতে হবে।

শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খোলার পক্ষে মত বেশি আছে। তাহলে রাজপথে যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবি করছে, তারা কারা? জরিপে যে তথ্য এসেছে, সেগুলোর কী হবে? ভেবে দেখা দরকার। কারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার পক্ষে আর কারা খোলার পক্ষে— তা বিবেচনা করা দরকার। আর সবকিছু খোলা রেখে ৫ শতাংশ কিভাবে সম্ভব, সেটি আমার বোধগম্য নয়। ভেবে দেখা দরকার শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশের দিক থেকেও।

দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা এসময় বাইরে ঘোরাঘুরি করছে, টিভি দেখে সময় ব্যয় করছে। করোনার সময়ে বেশ কয়েকজন অভিভাবক একটি বিষয়ে তাদের উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন— সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা ও শিক্ষার্থীদের বাসায় অবস্থানের কারণে ইন্টারনেট ও ডিজিটাল ডিভাইসগুলোর ব্যবহার কয়েক গুণ বেড়েছে। ইন্টারনেট ও ডিজিটাল সামগ্রী হাতের কাছে পেয়ে তার অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে আমাদের ছাত্রসমাজ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডিজিটাল ডিভাইসের স্ক্রিন বা মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকায় চোখের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। ফলে অল্প বয়সী বাচ্চাদের আজকাল ভারী চশমা ব্যবহার করতে দেখা যায়। ইন্টারনেট আসক্তির কারণে শিক্ষার্থীদের অনিদ্রা, ক্ষুধামান্দ্য, হজমে সমস্যা, ঘাড় ও কোমর ব্যথা, মোটা হয়ে যাওয়াসহ নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এই আসক্তি তাদের খিটখিটে মেজাজ, অল্পতেই ধৈর্যচ্যুতি, টেনশন বোধ, বিষণ্নতা, পারিবারিক সৌজন্যবোধের অভাবজনিত বিভিন্ন মানসিক সমস্যা তৈরি করছে। এছাড়া মোবাইল ব্যবহার করে করোনাকালীন শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ সময় ধরে ইন্টারনেট ব্যবহারজনিত আসক্তি বেড়ে যাচ্ছে, যা তাদের পড়ালেখা থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। এই আসক্তি থেকে বের হতে না পারলে শিক্ষার পরিণতি হবে আরও ভয়াবহ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার এই সংকটকালীন চর কিংবা হাওর অঞ্চলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়বে আশঙ্কাজনক হারে। গবেষণা বলছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের অভিভাবকদের মধ্যে একদিকে যেমন রয়েছে সচেতনতার অভাব, অন্যদিকে রয়েছে আর্থিক অসঙ্গতি। করোনাকালের এই দুর্যোগে পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তারা সন্তানদের কাজে পাঠিয়ে বাড়তি আয়ের চেষ্টা করবেন— এটাই স্বাভাবিক। তাদের মতে, যুব সমাজের একটি অংশ শিক্ষা, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন তৎপরতায় সক্রিয় আছে। অন্য একটি অংশ রয়েছে বিচ্ছিন্ন অবস্থায়। কেউ মাদকে যুক্ত, কেউ অবসাদে ভুগছে। আর এই বাস্তবতাই বলে দিচ্ছে— শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার শঙ্কাই বেশি। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হলে কীভাবে তাদের সক্রিয় করা যায়, তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। এই কারণ বিশ্লেষণ করলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা যুক্তিযুক্ত মনে হবে। তবে সবচেয়ে উত্তম হবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উভয়ের সমন্বয়।

যদি একসঙ্গে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা না যায়, তাহলে যেখানে যখন পরিস্থিতি উন্নতি হবে, সেখানে আগে খুলে দেওয়া যেতে পারে। দিন ও শ্রেণি ভাগ করে দেখা যেতে পারে।  এভাবে প্রথমে গ্রাম, তারপর উপজেলা ও জেলা শহরের স্কুলগুলো খুলে দেওয়া যেতে পারে। সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধির প্রতি কঠোর নজরদারি করা হোক। এভাবেই কিন্তু স্বাভাবিকের দিকে আসতে হবে। এটাই বাস্তসম্মত পদক্ষেপ হতে পারে। কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখলেও ঝুঁকি কিন্তু কমছে না বা কমবে না। কারণ সবই খোলা। তাছাড়া শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে না গেলেও বাড়িতে থাকছে না। তাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যবিধির সমন্বয়ই হতে পারে সঠিক সিদ্ধান্ত। কমাতে পারে শিক্ষার ঝুঁকিও। সঠিক সময়ের সময়োপযোগী  সিদ্ধান্ত  খুবই জরুরি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইমেইল: [email protected]

সারাবাংলা/টিআর

করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর