মুজতবা বন্দনা
৫ জুন ২০২১ ০২:১২
সৈয়দ মুজতবা আলীর একটি বিখ্যাত উক্তি রয়েছে, “রুটি,মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়তমার নীল চোখ ঘোলা হয়ে যাবে কিন্তু বই অনন্তযৌবনা। ” তবে এ উক্তিটি নিয়ে একটি বিতর্ক রয়েছে অনেকেই বলে থাকেন এটি ওমর খৈয়ামের উক্তি। তবে এই উক্তিটি সৈয়দ মুজতবা আলীর এটি বলার একটি বিশেষ উপলক্ষ রয়েছে।অনেকের মধ্যেই এই বিভ্রাটটি রয়েছে যাদের অধিকাংশই মনে করেন এটি ওমর খৈয়ামের উক্তি। এমনকি গুগলে উক্তিটি সার্চ করলেও খুব সহজেই ওমর খৈয়ামের নামটি চলে আসে তবে আমাদের সাহিত্যিক জ্ঞানের পরিসর আর ব্যাপ্তিটা যে আমরা এই একবিংশ শতাব্দীতে শুধুই গুগল আর বইয়ের পাতার কয়েকটি লাইনে সীমাবদ্ধ রেখেছি এটি কিছুটা তারই পরিণতি।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, সৈয়দ মুজতবা আলী বাংলা সাহিত্যের একজন অন্যতম ঔপন্যাসিক, অনুবাদক ও রম্যরচয়িতা। বহুভাষাবিদ সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনা একইসঙ্গে পাণ্ডিত্য এবং রম্যবোধে পরিপুষ্ট। বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট অনুবাদক হিসেবে তার যথেষ্ট খ্যাতি রয়েছে। অপরদিকে ওমর খৈয়াম ছিলেন
একজন বিজ্ঞানী ও দার্শনিক। অথচ সারাজীবন বিজ্ঞানের সাধনা করা মানুষটি কবি হিসেবেই অধিক পরিচিত কেননা তার কবিতা শুধুই ভাষা আর ভাবের ফুলঝুরি নয় রচিত হয়েছিল গভীর দার্শনিক অনুভূতি থেকে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিদ্রোহী বাণের তীরে পারস্যের প্রেম ও বিরহের কবি হিসেবে তিনি অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ওমর খৈয়ামের সমগ্র কবিতা সংকলনকে একটি পুস্তকে সংঘবদ্ধ করা হয় এবং কিতাবটির নাম দেওয়া হয়, “রুবাইত ই ওমর খৈয়াম”। পারস্যের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও দার্শনিক ওমর খৈয়াম ততদিন পর্যন্ত কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিতই ছিলেন না যতদিন না তার লেখা কবিতা এডওয়ার্ড ফিট্সজেরাল্ড অনুবাদ করেছিলেন। এডওয়ার্ড ফিট্সজেরাল্ড তার অনুবাদের মাধ্যমে নিজে প্রতিষ্ঠিত হন এবং ওমর খৈয়ামকে প্রেম বন্দনার কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। সে সময়ের বিশিষ্ট সাহিত্যবেত্তারা উপলব্ধি করেন যে এক ভাষার ছন্দ তর্জমা করে সেটাকে ঠিক একই ছন্দে অন্য ভাষার ছাঁচে ঢেলে দেওয়া ঠিক কতটা কঠিন ও দূরহ ব্যাপার। কারণ এখানে কবিতার মূল বিষয়টি শুধুই বস্তকেন্দ্রিক নয়, ছন্দ, ভাষা ও গতির মেলবন্ধনেই সুরেলা কবিতার ছন্দময়তা মানব মনকে আন্দোলিত করে। ফিট্সজেরাল্ডও তাই ঠিকমত তর্জমা করেননি, মূলভাবটা দিয়ে সেই কবিতাকে নতুন ভাবে সৃষ্টি করেছেন।
কিন্তু এখানে ওমর খৈয়ামের কবিতা অবলোকন করে কবিতা হওয়ায় মূল লেখক হিসেবে ওমর খৈয়ামের নামই বারবার বর্তায়। ওমর খৈয়ামের কবিতা থেকে এডওয়ার্ড ফিট্সজেরাল্ড অনুবাদ করেন, আবার সেখান থেকে ভারতীয় অনুবাদক কান্তিচন্দ্র ঘোষ এডওয়ার্ড ফিট্সজেরাল্ডের কবিতা অনুবাদ করেন।
ফিট্জেরাল্ড যেখানে লিখেছেন,
Here with loaf of bread
beneath the bough,
A flask of wine, a book of
verse and thou,
Besides me singing in the wilderness
And wilderness is paradise enow.
কান্তিচন্দ্র সেখানে লিখেছেন,
সেই নিরালা পাতায় ঘেরা
বনের ধারে শীতল ছায়
খাদ্য কিছু, পেয়ালা হাতে
ছন্দ গেঁথে দিনটা যায় !
মৌন ভাঙ্গি মোর পাশেতে
গুঞ্জে তব মঞ্জু সুর –
সেইতো সখি স্বপ্ন আমার,
সেই বনানী স্বর্গপুর !
এখানে খেয়াল করবেন, ফিট্সজেরাল্ডের কবিতার সঙ্গে কান্তিচন্দ্রের ভাষার ছাঁচ ও তর্জমায় ঠিক কতটা ফারাক রয়েছে। কিন্তু এখানে ভারতীয় সাহিত্যবেত্তারা অনুবাদ হলেও কান্তিচন্দ্রকে সাহিত্য সংকলনের স্তুতিগাথার সম্মান দেখিয়েছেন এবং তাকে তার ভাষার ছন্দ ছাঁচের কারণে অনন্য হিসেবে স্থান দিয়েছেন। ওমর খৈয়ামের “রুবাইত ই ওমর খৈয়াম” কবিতাসমগ্র প্রথম বাংলায় অনুবাদ করেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। পরবর্তীতে আলাদা আলাদা অংশ স্তবক আকারে নির্দিষ্ট কিছু কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হয়। ওমর খৈয়ামের কবিতার আদলে গ্রন্থ হওয়ায় সৈয়দ মুজতবা আলীর ছন্দের জলধারাকে ঠিক জলাঞ্জলি দিয়ে এর সম্পূর্ণ ক্রেডিট দেওয়া হয় সরাসরি ওমর খৈয়ামকে। এমনকি সিংহভাগ ওয়েবসাইট ও পোর্টালেও ওমর খৈয়ামেরই বর্ণনা পাওয়া যায়। যদিও কিছু কিছু জায়গায় মুজতবা আলীর নামমাত্র উল্লেখ রয়েছে কিন্তু এটি কেন শুধুই তার নিজস্ব উক্তি এ ব্যাপারে কেউ জোরালো কোনো বক্তব্য পেশ করতে পারেননি।
অপরপক্ষে কান্তিচন্দ্রকে ভারতীয়রা নিজস্বতা প্রদান করে এবং এডওয়ার্ড ফিট্সজেরাল্ডকে তো পুরো বিশ্ববাসী সাহিত্যের বেতাব বাদশার গদিটি পর্যন্ত একটা সময়ের জন্য দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু যখন সৈয়দ মুজতবা আলী তার নিজস্ব ভাষার রসলীলা ও তর্জমা বাংলা সাহিত্যকে উপহার দিলেন ঠিক সেসময়ে বাংলা সাহিত্যের নবযুগের অভ্যন্তরীণ দ্বান্দ্বিক রোষানলে পড়ে সাহিত্যের নবায়নে আড়াল হন।
তরুণ প্রজন্ম সাহিত্যকে ঠিক কিভাবে দেখছে এটি এখন আর গৌণ বিষয় নয়, কেননা সাহিত্যের শ্রাবণধারা আমাদের জনজীবনের প্রবঞ্চনার সঙ্গে নির্লিপ্তভাবে সম্পৃক্ত। জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রগাঢ় বন্ধনই কেবল আমাদের মুক্তির পথের সঞ্চারিত শক্তি। সাহিত্যের নবায়নে প্রযুক্তি ভিত্তিক প্রলুব্ধতা আমাদের জাতীয়তাবাদী শক্তির জন্য একটি বিরাট বাধা। আমাদের যেমনই প্রযুক্তি নির্ভর রাষ্ট্র প্রয়োজন ঠিক ততোটাই সমৃদ্ধ সাহিত্য ভিত্তিক সমাজ প্রয়োজন। কেননা ভবিষ্যতে সমাজ সম্ভারে প্রযুক্তি ও শিল্প সাহিত্যের সমান তালে মেলবন্ধন না ঘটলে হাজার বছর পূর্বের ন্যায় মানুষ ক্রমেই অসামাজিক হয়ে পড়বে, বাড়বে সামাজিক বিশৃঙ্খলা।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/আইই