অনুভূতির আওয়ামী লীগ, জনগণের আস্থার প্রতীক
২৩ জুন ২০২১ ১২:০০
বাংলার মানুষের মুক্তি আর অধিকার আদায়ের জন্য গঠিত হয় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। পুরান ঢাকার বিখ্যাত রোজ গার্ডেনে দলটির জন্মলাভের মধ্য দিয়েই রোপিত হয়েছিল বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ। বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ, স্বাধীনতা— এই তিন শব্দ অমলিন, অবিনশ্বর, অবিনাশী। ইতিহাসে এই তিনটি শব্দ একই সূত্রে গাঁথা। সংগ্রাম, ঐতিহ্য, গৌরব ও ইতিহাসের নানা বাঁক পেরিয়ে ৭২ পেরিয়ে ৭৩-এ বছরে পা দিলো হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী আর বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া আওয়ামী লীগ। তবে বর্তমানে বঙ্গবন্ধুকন্যা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সাধারণ জনগণের মনিকোঠায় আস্থা ও নির্ভরতার এক মানবিক প্রতীক হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। তাই আওয়ামী লীগ শুধু একটি রাজনৈতিক দলই নয়, আওয়ামী লীগ এ দেশের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির হৃদয়ের অনুভূতি।
১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন রোজ গার্ডেনে নতুন দল গঠন করা হচ্ছে। বিষয়টি জানাজানি হলে তৎকালীন সরকার ভীত হয়ে পড়ে। ওই সম্মেলনকে কেন্দ্র করে মওলানা ভাসানীকে গ্রেফতার করার আশঙ্কা দেখা দেয়। তখন নতুন সংগঠন গড়ে তোলার কারিগররা মওলানা ভাসানীকে আত্মগোপনে রাখার ব্যবস্থা করেন এবং সম্মেলনের অন্তত দু’দিন আগে তাকে রোজ গার্ডেনে নিয়ে আসা হয়। মওলানা ভাসানীকে বোরকা পরিয়ে (মতান্তরে কম্বল জড়িয়ে) ঘোড়ার গাড়িতে করে রোজ গার্ডেনে নিয়ে যান সংগঠনটি দাঁড় করানোর অনুঘটক শওকত আলী।
এরপর আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি, শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক এবং কারাবন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ম-সম্পাদক করে নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করে। সম্মেলনে দলের নাম দেওয়া হয় ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’। পরদিন ২৪ জুন ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে প্রকাশ্য জনসভার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের কর্মসূচি শুরু হয়। বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে কখনো বিরোধী দলে, কখনো সরকারে থেকে দেশ গঠনে অনন্য অবদান রেখে চলেছে মাটি ও মানুষের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ।
ভাষা আন্দোলন, গণআন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধসহ স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের পাতার পরতে পরতে একটিই নাম আওয়ামী লীগ। সব পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের হার না মানা নেতৃত্ব। এই দলের নেতাকর্মীদের ত্যাগ-তিতীক্ষা ও অঙ্গীকারদীপ্ত সংগ্রামী ভূমিকা ইতিহাসবিদিত। স্বভাবতই বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রের নির্মাতা আওয়ামী লীগের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। সামান্য বিচ্যুতি কিংবা ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তারা।
জনগণের অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও সমর্থন নিয়েই বিকশিত আওয়ামী লীগ। স্বাধীনতা সংগ্রাম যেমন, ঠিক তেমনি দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিরও সমার্থক হয়ে রয়েছে দলটি। আর তার পেছনে রয়েছে সেই জনসমর্থন। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সীমানা পেরিয়ে এ উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ এবং জনসমর্থনপুষ্ট প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, মানব কল্যাণকামী রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের পরিচিতি অর্জনে সক্ষম হয়েছে। বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা, বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্বায়ত্তশাসন সর্বশেষ স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে গড়ে ওঠা আওয়ামী লীগ তার আদর্শ এবং উদ্দেশ্যে অটল থেকেও সময়ের বিবর্তনে বৈজ্ঞানিক কর্মসূচির মাধ্যমে একটি আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আজ প্রতিষ্ঠিত।
রোজ গার্ডেনে দলটি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে। ১৯৫৫ সালে ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত দলীয় কাউন্সিলে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘আওয়ামী লীগ’ নামকরণের মাধ্যমে দলটি অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়। এককথায় বলতে গেলে, বাঙালি জাতির সব মহান অর্জনের নেতৃত্বে ছিল জনগণের প্রাণপ্রিয় এই সংগঠন, যার মহানায়ক ছিলেন রাজনীতির মহামানব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি ও স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উৎরাই ও প্রাসাদসম ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে দলটি আজ এ দেশের গণমানুষের ভাব-ভাবনার ধারক-বাহকে পরিণত হয়েছে। অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক ভাবধারার আস্থার প্রতীকে পরিণত হয়েছে দলটি। জন্মের পর থেকে অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ঐতিহ্যবাহী দলটি বেঁচে আছে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে।
আওয়ামী লীগের জন্মলাভের পর মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ’৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছয় দফা, ’৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ’৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে এই দলের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি ক্রমশ এগিয়ে যায় স্বাধীনতার দিকে। এই দলের নেতৃত্বেই ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ নিজেদের স্থান দখল করে। আর এসব আন্দোলনের পুরোধা ও একচ্ছত্র নায়ক ছিলেন ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দীর্ঘ ২১ বছর বিরোধী দলে অবস্থান করে আওয়ামী লীগ। এরপর ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করেছিল। এর আগে এই দলের আন্দোলন সংগ্রামেই প্রতিষ্ঠিত হয় সংসদীয় গণতন্ত্র, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান অনুযায়ী পূর্ণ মেয়াদ শেষে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নির্বাচনে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ।
২০০১ সালের পহেলা অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পরাজয়ের পর বিরোধী দলে অবস্থানকালে আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন ও নেতৃত্বশূন্য করতে বেশ কয়েকবার মারণাঘাত চালায় ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট। ২১ আগস্ট ভয়াল গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনাসহ দলের শীর্ষস্থানীয় সব নেতা অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে গেলেও ঝরে যায় অসংখ্য তাজা প্রাণ। ওয়ান-ইলেভেনের পর আবারও ঝড় আসে আওয়ামী লীগের ওপর। দীর্ঘ ১১ মাস কারাপ্রকোষ্ঠে বন্দি রেখেও বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া আওয়ামী লীগকে ভাঙতে পারেনি নেপথ্যের কুশীলবরা। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি আসনে দেশের জনগণ ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছিল আওয়ামী লীগকে।
ষড়যন্ত্র এখানেই থেমে থাকেনি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বানচালে মরিয়া হয়ে ওঠে বিএনপি-জামায়াত জোট। হেফাজতের তাণ্ডবের পর নির্বাচন বানচালে শত শত মানুষকে ভয়াল ও নৃশংস কায়দায় পেট্রোল বোমা মেরে ও গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে পৈশাচিক কায়দায় হত্যার মহোৎসব দেখেছে দেশবাসী। এমনকি নির্বাচনের দিনেও শতাধিক স্কুল-কলেজে আগুন দিয়ে ভস্মীভূত, প্রিজাইডিং অফিসারকে কুপিয়ে ও আগুন দিয়ে হত্যা চেষ্টার পরও সাহসী বীর বাঙালি ৪০ ভাগেরও বেশি ভোট দিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এনেছিল ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগকে।
এরপর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনের পর ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মতো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের মানসকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি, মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ হাজারেও লড়াই-সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতীক্ষা অতিক্রম করে আজ এ পর্যায়ে এসেছে। আশা করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব গুণে আওয়ামী লীগ সফলতার ধারাবাহিকতা ধরে রাখবে। বাংলাদেশকে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলবে।
লেখক: সাংগঠনিক সম্পাদক, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগ
সারাবাংলা/টিআর