আওয়ামী লীগের ৭২ বছরের অনিন্দ্য পথচলা
২৩ জুন ২০২১ ২৩:৫৯
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। এর ঠিক ১৯২ বছর পর বাংলার মানুষের মুক্তি আর অধিকার আদায়ের জন্য ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে আত্মপ্রকাশ ঘটে বাংলার গৌরবগাঁথা ঐতিহ্যবাহী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাগণ যেন দলের আত্মপ্রকাশের দিন হিসেবে ইতিহাস থেকে ২৩ জুন তারিখটি বেছে নিয়েছিলেন বাঙালির পরাজয়ের সে গ্লানিকে চিরতরে ম্লান করে দেওয়ার জন্যে। আওয়ামী লীগ নামটির সঙ্গেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে এক মহাপুরুষের নাম। মহাকালের সেই মহানায়ক হাজার বছরের অগ্নিপুরুষ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ইতিহাসের স্বর্ণালি সন্ধিক্ষণে বাঙালি জাতির জন্য মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে আজও শোষিত বঞ্চিত নিপীড়িত নিষ্পেষিত শৃঙ্খলিত মানুষের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ— যার শিরদাঁড়া স্থাপন করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আজ ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৫৫ সালে ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনটি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ থেকে হয়ে ওঠে দল মত নির্বিশেষে সকলের পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। ১৯৫২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দিগ্বিজয়ী সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ঠিক তার পরের বছরই বঙ্গবন্ধুর উপরে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয় । ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ১৩ বছর সদর্পে কর্মবীরের ভূমিকায় বঙ্গবন্ধু সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৬৬ সালের কাউন্সিলে দলের সভাপতি পদে নির্বাচিত হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬২’র ছাত্র আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র যুগান্তকারী নির্বাচন সবই হয়েছে আওয়ামী লীগের হাত ধরে। এদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে আওয়ামী লীগের ভূমিকা প্রত্যুজ্বল। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এক অবিস্মরণীয় নাম। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় যে সাধারণ ছাত্র সভা অনুষ্ঠিত হয় তাতে নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের সময় পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন কারাগারে। কারাগারে থাকলেও তৎকালীন ছাত্র প্রতিনিধিদের সঠিক দিক নির্দেশনা ও পথ বাতলে দেওয়ার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনের চিরায়ত সার্বিক কর্মপ্রণালী বাস্তবায়ন ও আন্দোলন সংগ্রামের নেপথ্য প্রণেতা হিসেবে বিরাজমান ছিলে ন৷ ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলনের প্রথম বার্ষিকীতে ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে ঘোষণা ও বাংলাকে অবিলম্বে রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে আহ্বান জানান। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধুর উত্থাপিত বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপী বঙ্গবন্ধুর ন্যায় সংগ্রামের পথে তীব্র আন্দোলনের সূচনা হয়। আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় পুলিশ ও ইপিআর এর গুলিতে তৎকালীন ১১জন নেতাকর্মী নিহত হন। পুলিশের হাতে গ্রেফতারের পূর্বে বঙ্গবন্ধু পেয়ে যান অভাবনীয় জনসমর্থন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে গণমানুষের সোচ্চার কণ্ঠস্বর। পরবর্তীতে বাঙালি জাতির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার নিমিত্তে কুচক্রী পাকিস্তানি শাসকের বেশে শোষকেরা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার নাট্যমঞ্চ চিত্রায়িত করে। কিন্তু যার রক্তে বারুদ স্বরূপ স্পর্ধা প্রথিত রয়েছে তাকে দমানোর সাধ্য কার! বাংলার আপামর বীর সন্তানেরা বিক্ষোভে বিপ্লবের অনলে ফেটে পড়ে এক ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের গোড়াপত্তনের মাধ্যমে আইয়ুব শাহীর পতন ও বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে ইতিহাসের কালপঞ্জিকায় এক নজিরবিহীন ঐশ্বর্যের সূত্রপাত ঘটালেন আর ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে গণমানুষের অধিকার আদায়ের বাতায়ন। পরবর্তীতে ১৯৭০’র নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের জন্য ছয় দফার পক্ষেই গণরায় দেয় তৎকালীন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ। কিন্তু ছলচাতুরী আর কালোপর্দার ঘোমটা থেকে যেন পাকিস্তানি শোষকেরা নিভৃত হতেই পারছিল না। ক্ষমতার পালাবদল আর রিকনসিলেশনের কথা বলে আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু ও আপামর বাঙালিদের সঙ্গে ভ্রষ্টতা যেন পাকিস্তানের রক্তকোষ ও রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবহমান ছিল।
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি হর্তাকর্তাদের দুরভিসন্ধিমূলক ষড়যন্ত্রের উপলব্ধি থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং ৭ মার্চ উত্তাল গণসমাবেশে ১৮ মিনিটের এক ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে বাঙালিদের মাঝে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সঞ্জীবনী শক্তির সঞ্চার ঘটান। বজ্রনিনাদিত কণ্ঠে ও দ্রোহের স্ফুরণের সম্মেলনের সেই ভাষণ পাকিস্তানি প্রেতাত্মাদের অন্তরে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। পরবর্তীতে বাঙালিরা সেই স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে, মুক্তির ঘোর অমানিশায় প্রদীপ্ত থেকে বাঙালির মহত্তম মহাযজ্ঞ মুক্তিযুদ্ধে সামিল হয়। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্ত বন্যার ফলাফল হিসেবে বাংলাদেশ বিজয়ের স্বাদ গ্রহণ করে ও স্বাধীনতার অভীষ্ট লক্ষ্যে পদার্পণ করে। পাকিস্তানের সূচনালগ্ন থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রতিটি নবসূর্যের আভায় বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত রয়েছে।
জাতির জন্য যখন যা প্রয়োজন সেটিই বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। স্বাধীনতা উত্তর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার জনকল্যাণধর্মী দুঃখী ও বঞ্চিত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে নেওয়া দূরদর্শী উন্নয়ন কৌশলের নৈতিক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় ১৯৭২ সালে গৃহীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের মাধ্যমে। ‘রাষ্ট্রীয় মূলনীতি’র অংশ হিসেবে অর্থনীতি ও সমাজে সাম্য নিশ্চিত করা, গ্রামীণ অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করা, খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মতো মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা, নারীর ক্ষমতায়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণের মতো অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ এই সংবিধানে স্থান করে নেয়। সময়ের প্রয়োজনে শুরুতে রাষ্ট্রীয় খাতকে প্রাধান্য দিলেও ধীরে ধীরে সমবায় ও ব্যক্তিখাতের বিকাশের জন্য উপযুক্ত নীতি সংস্কারেও তিনি হাত দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা উত্তর বঙ্গবন্ধু সরকার গণমুখী শিক্ষার বিষয়কে শুধুমাত্র সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েই থেমে থাকেনি, বরং নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এ লক্ষ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যেতে থাকা একটি নবীন জাতি যেন হঠাৎই বাকরুদ্ধ আর স্তব্ধ হয়ে যায় এক বিদঘুটে কালো রাতের ভয়াল নৃশংসতায়।১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একটি সদ্য জন্মলাভ করা জাতিকে তার জনকের লাশ বহন করতে হয়। হন্তারকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও তার রেখে যাওয়া জীবনাদর্শকে মুছে ফেলতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এখন লালন করে কোটি কোটি বাঙালি—এমনকি বাংলার আকাশ-বাতাস-বায়ু-গিরি।
৭৫ পরবর্তীতে বাঙালি জাতির বুকে নেমে আসে এক কৃষ্ণবিবর। ৭৫-পরবর্তী নানা আন্দোলন সংগ্রামে যখন আওয়ামী লীগকে মুছে দেওয়ার জন্য বারবার চেষ্টা করা হয়েছে তখন আওয়ামী লীগ কর্মীদের রক্তের স্রোতের মাধ্যমে সেই অপচেষ্টাকে প্রতিহত করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের চলার পথ মসৃণ হয়েছে অসংখ্য কর্মীর শরীর থেকে ঝরা রক্ত দিয়ে। ১৯৮১ সালে দেশরত্ন শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাল ধরলে দলটির অন্তরের ভেতরে উদ্বেলিত বারুদ আবারও ফুঁসে ওঠে। জনমানুষের হয়ে দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে বঙ্গবন্ধু তনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবারও সুসংগঠিত হয়।স্বৈরাচার, অগণতন্ত্রের বিরুদ্ধে হাজারো সংগ্রাম সাধনার পর ১৯৯৬ সালের আবারও সেই ২৩ জুনেই আওয়ামী লীগ সরকার পুনরায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। দেশের অভ্যন্তরীণ অবকাঠামোগত সকল উন্নয়নের কর্মপ্রক্রিয়া বাস্তবায়নের রোডম্যাপ সে সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের মাধ্যমেই সম্পাদন করা হয়।
কিন্তু বরাবরই শর্ষের ভেতরে ভূত হয়ে আসে পাকিস্তানি প্রেতাত্মাদের দোসর ও তাদের উত্তরসূরিরা। স্বাধীনতা বিরোধী চক্র জগদ্দল পাথরের মতো জাতির ঘাড়ে চেপে বসে জাতির সকল অর্জনকে ভূলন্ঠিত করার পায়তারা করেছে।
২০০১ সাল থেকে ২০০৮ সাল বিএনপি-জামাতের জোট সরকারের আমল ছিল নৈরাজ্য, দুঃশাসন, দুর্নীতি আর জাতির কপালে কালিমা লেপনের এক অন্ধকারতম অধ্যায়। বাঙালির ভাগ্যাকাশে নিগৃহীত এই কলঙ্কময় অধ্যায় জাতির অর্জনকে নিমেষেই জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল। দেশজুড়ে অরাজকতা ও সন্ত্রাসের কালো ছায়ায় বাংলাদেশ যেন বিপন্ন প্রায়। বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে বারংবার হত্যাচেষ্টায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ঢাল হয়ে সকল অপঘাতকে রুখে দেয়। এ যাবত পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু তনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে প্রায় ১৯ বার হত্যা করবার অপচেষ্টা করা হয়। প্রতিবারই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রুদ্রমূর্তি ধারণ করে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতে জ্বলে উঠে প্রতিরোধ করেছে।
দেশে রাজনৈতিক সংকটের পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে পুনরায় সরকার গঠন করে। ২০০৯ সাল থেকে টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের টানা এক যুগের শাসনামলে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন দেশ-বিদেশে আলোচিত হয়েছে। মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। মহাকাশে নিজস্ব স্যাটেলাইট প্রেরণ করা হয়েছে। কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে সাফল্য এসেছে। জঙ্গি দমনে সাফল্য সারা বিশ্বে আলোচিত। এদেশে আওয়ামী লীগই একমাত্র দল যেটি দেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে একক এবং নিরবচ্ছিন্ন ভূমিকা রেখেছে। দেশের বিভিন্ন সংকট ও দুর্যোগে অন্যদলগুলো যখন নানা নাটকীয়তায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে সময় ক্ষেপণ করেছে, আওয়ামী লীগ তখন তার অবস্থানে অটল থেকে জনগণকে সংগঠিত করেছে। অন্যদলগুলো যখন ইতিহাসের সাক্ষী হওয়া নিয়ে অহংকারে ব্যস্ত, আওয়ামী লীগ তখন নির্মাণ করছে নতুন ইতিহাস। যুগে যুগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এই আলোর পথে অভিযাত্রা অব্যাহত থাকুক আওয়ামী লীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এতটুকুই প্রত্যাশা।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/আইই