লকডাউন শিথিলতায় চাঙ্গা হবে গ্রামীণ অর্থনীতি
১৪ জুলাই ২০২১ ২৩:০৫
প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রায় এক কোটি পশু, বিশেষ করে গরু কোরবানির জন্য খামারি/কৃষকরা উৎপাদন করেছেন। খামারিদের কথা বাদ দিলে আনুমানিক প্রায় ৮০ লাখ দরিদ্র পরিবারের প্রায় প্রতিটিই একটি করে পশু কোরবানির জন্য লালন করে। এরা সবাই কোরবানির পশু উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। সারাবছর কোরবানির কথা মাথায় রেখে পশু খামারিরা বা দরিদ্র কৃষকেরা এই এক কোটি পশু উৎপাদন করেছেন।
আসুন, খামারিদের কথা বাদ দিয়ে আমরা পশু উৎপাদনকারী ৮০ লাখ দরিদ্র মানুষের কথা মাথায় রেখে চিন্তা করি। ধরে নিই, প্রতিটি কোরবানির পশুর গড় উৎপাদন ব্যয় ৬০ হাজার টাকা এবং একজন কৃষক ৫ হাজার টাকা লাভ করবেন। তাহলে কোরবানি উপলক্ষে ৮০ লাখ পরিবার পাচ্ছে প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা, যা বিত্তশালীদের পকেট থেকে দরিদ্র অসহায়দের পকেটে যাচ্ছে।
আবার এই এক কোটি পশুকে গ্রাম বা প্রান্তিক অঞ্চল থেকে বিভিন্ন শহরে এনে বিক্রি করার জন্য ব্যবসায়ী গ্রুপ তৈরি হবে, যাদেরকে আমরা বলি ব্যপারি। তাদের সংখ্যাটি আনুমানিক ৭ বা ৮ লাখ। ধরি একেকজন ব্যপারি ১০ থেকে ১৫টি গরুর ব্যবসা করবেন। ব্যাপারিরা যদি প্রতিটি পশু থেকে এক হাজার টাকাও লাভ করেন, তাও তাদের পকেটে যায় ১,০০,০০,০০০ x ১,০০০ টাকা অর্থাৎ এক হাজার কোটি টাকা। এই টাকাও বিত্তশালীদের পকেট থেকে দরিদ্রদের পকেটে যাবে।
আবার এসব পশু পরিবহনের সঙ্গে যদি ১০ লাখ ট্রাক বা পিকআপ জড়িত থাকে, তাহলে একজন চালক আর একজন সহকারী মিলে প্রায় ২০ লাখ লোক যুক্ত। তাদের প্রতিজনের পকেটে গড়ে ১৫০০ টাকা গেলেও মোট ২০,০০,০০০ x ১,৫০০ টাকা অর্থাৎ ৩০০ কোটি টাকা। এই টাকাটিও বিত্তশালীদের পকেট থেকে দরিদ্রদের পকেটে যাবে।
এবার আসুন কোরবানির হিসাবে। এই এক কোটি পশুর মধ্যে প্রায় ২০ লাখ পশু শহর এলাকায় কোরবানি হবে। এর জন্য লাগবে কসাই। একটি গরু কোরবানি করতে যদি একজন কসাই ৫ হাজার টাকাও নেন তাহলে কসাইদের পকেটে যাচ্ছে ২০,০০,০০০ x ৫,০০০ টাকা অর্থাৎ এক হাজার কোটি টাকা।
আর বাকি ৮০ লাখ গরু গ্রাম অঞ্চলে কোরবানি হলেও প্রতিটি গরুর পেছনে গড়ে দু’জন করে শ্রমিক কাজ করবেন। তাদের গড় মজুরি এক হাজার টাকা। তাহলে এই প্রান্তিক শ্রমিকদের পকেটে যাচ্ছে ১,৬০,০০,০০০ x ১,০০০ টাকা অর্থাৎ ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
এবার আসুন চামড়া নিয়ে কথা বলি। কোরবানি একটি ধর্মীয় বিষয় এবং সে রীতি অনুযায়ী চামড়া বিক্রির টাকাটি যায় গরীব-মিসকিনদের পকেটে। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে অনেক এতিমখানা বা লিল্লাহ বোর্ডিং চলেই এই চামড়া বিক্রির টাকা দিয়ে। লকডাউনে আমি-আপনি বাসায় আছি, আরাম-আয়েশে খাচ্ছি। কিন্তু এতিমখানার যে শিশুটির বাবা-মা নেই, কেউ তার দায়িত্ব নিতে নারাজ। তার তো এতিমখানা ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। এই করোনার মধ্যেও সে এতিমখানাতেই আছে। আপনাদের সহযোগিতায় তার জীবন চলছে। এখন প্রতিটি পশুর চামড়ার দাম যদি আমি গড়ে এক হাজার টাকা ধরি, তাহলে এতিমখানা বা গরীব মিসকিনদের পকেটে যাচ্ছে ১,০০,০০,০০০ x ১,০০০ টাকা অর্থাৎ আরও এক হাজার কোটি টাকা।
আমরা যদি কোরবানি উপলক্ষে বিত্তশালীদের কাছ থেকে প্রান্তিক দরিদ্র খেটে খাওয়া অসহায় মানুষদের পকেটে যাওয়া টাকার মোট হিসেব করি, তাহলে অঙ্কটি দাঁড়ায় ৫৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকায়। এই করোনাকালে এ এক অবিশ্বাস্য প্রণোদনা।
আর খামারিরা যে ২০ লাখ কোরবানির পশু পালনে যুক্ত, তাদের পকেটে যাচ্ছে ২০,০০,০০০ x ৬৫,০০০ টাকা অর্থাৎ ১৩ হাজার কোটি টাকা।
কোরবানি উপলক্ষে আনুমানিক ৬৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা দেশের বিত্তশালীদের কাছে থেকে পশু উৎপাদন ও লালনকারী এবং পশুখাদ্য ব্যবসায়ীর কাছে যাবে।
ভাবা যায়! এই করোনাকালীন সময়ে দেশের বিত্তশালীদের কাছ থেকে এই টাকাটি দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে যাবে। সরকার প্রদত্ত প্রণোদনা বা আর্থিক সাহায্য নিয়ে এদিক-সেদিক করার সুযোগ থাকলেও কোরবানি উপলক্ষে এই টাকা বিনা বাধায় চলে যাবে প্রান্তিক অসহায় ও জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ জনগোষ্ঠীর কাছে।
কোরবানির ঈদ তথা পশুর হাট যথাযথভাবে গড়ে ওঠা এবং কোরবানির পশু স্থানান্তরে যেন কোনোরকম বিঘ্ন না ঘটে, সেজন্য সরকার লকডাউন শিথিল করেছে। এজন্য সরকার সাধুবাদ পাওয়ার দাবি রাখে। এই লকডাউন শিথিলতায় কেবল প্রান্তিক পশু উৎপাদনকারীদেরই উপকার হবে না, দেশের আরও অন্যান্য খাতের দরিদ্র ও অসহায় মানুষেরও স্বস্তির সুযোগ হবে এবং গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হবে।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কোরবানির প্রভাব অসীম। একজন অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে যদি বলি, কোরবানি যেভাবে অর্থনীতিকে নাড়া দেয় তা এককথায় অবিশ্বাস্য। আর করোনাকালে তা এক অসীম নেয়ামত। কেননা, বিত্তশালীদের কাছে থেকে টাকা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে স্থানান্তরের এক নির্মোহ প্রক্রিয়ার নাম কোরবানি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৯ সালের তথ্য মতে দেশে দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং হতদরিদ্রের হার ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ। এই দরিদ্র ২০ দশমিক ৫০ শতাংশ মানুষের শরীরে আমিষের ঘাটতি প্রবল। তাছাড়া হতদরিদ্র যে ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ পরিবার, তারাও গরুর মাংস খাওয়া বলতে কেবল কোরবানির সময় মানুষের সাহায্য থেকে পাওয়া মাংসটুকুই বোঝেন। তাদের কথাও আমাদের ভাবতে হবে।
তবে একইসঙ্গে স্বাস্থ্যবিধির কথাও ভুলে গেলে চলবে না। নিজের স্বার্থেই মেনে চলতে হবে স্বাস্থ্যবিধি। অসচেতনভাবে চলাফেরা ডেকে আনতে পারে বড় বিপদ।
লেখক : আরিফুর রহমান, সিনিয়র সহকারী সচিব; এমএসএস (অর্থনীতি), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই