‘নতুন বাংলাদেশ গড়বো মোরা’
১৫ জুলাই ২০২১ ১৩:৪৭
আমি এতো আগে জন্মেছি যে, এরশাদের শাসন আমলের পুরো সময় কালটাই আমার দেখা। বাইককে তখন আমরা হোন্ডা বলতাম। যেকোনো চকলেটকে মিমি বলতাম, আর প্রেসিডেন্টকে বলতাম এরশাদ। নয় বছর ধরে তিনি আমাদের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
টিভিতে তখন বাতাবিলেবুর চাষের বদলে এরশাদ আর রওশন এরশাদের ছবি দেখাত। বিটিভিকে বলা হতো রাজা রানীর বাক্স। এরশাদের জন্মদিনে স্কুলে ইংরেজি অক্ষর লেখা এ, বি, সি, ডি কুকিজ খেতে দিত। তখন আমরা কুকিজ শব্দটা জানতাম না মনে হয়, আমরা বিস্কুট বলতাম।
অষ্টাশিতে প্রবল বন্যা হলো। ১৯৮৮। প্রেসিডেন্ট এরশাদ তখন সাফারি পরে বন্যাকবলিত এলাকায় গিয়ে ত্রাণ দিতেন। টিভিতে এন্ড্রু কিশোর গাইতেন এরশাদের লেখা গান—
তোমাদের পাশে এসে বিপদের সাথী হতে, আজকের চেষ্টা অপার,
তোমাদের সাথে মিশে, সব ব্যথা বুকে নিয়ে, আমিও ও যে হব একাকার,
আজকের চেষ্টা অপার।
এরশাদের পেছনে ছাতা নিয়ে লোক ছুটত। কিন্তু রোদের তোয়াক্কা না করে বুট পায়ে তিনি এগিয়ে যেতেন বৃদ্ধ বন্যার্তদের কাছে। কপালে থাকতো তার দুর্গত মানুষের জন্য দুশ্চিন্তার ভাঁজ।
লেখকের মেয়ের সঙ্গে এরশাদের সেলফি
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতনের পর পত্রিকাগুলো প্রাণ খুলে কার্টুন আঁকলো। এরশাদকে নিয়ে করা ট্রল দিয়ে আমার একটা স্ক্র্যাপবুক ছিল । আফসোস সেটা এক সময় বোঝা ভেবে ফেলে দিয়েছি।
এরশাদ ছয় বছর পর জেল থেকে বের হওয়ার পর প্যাকেজ নাটক ‘দীপান্বিতা’র প্রিমিয়ার শোতে তাকে দেখেছিলাম। নাটকে খলনায়ক জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় দুই বছর পর জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন। তিনি একটু পর পর ডায়ালগ দিতেন, ‘দুই বছর পর দেশে ফিরছি, কথাটা মনে রাখিস’। জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় যতবার এই ডায়ালগটা দিতেন, দেখছিলাম এরশাদ ততবারই সজোরে হাসছিলেন। তিনিও যে ছয় বছর পর দেশে ফিরেছিলেন।
এরশাদের সময় বের হলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে গাওয়া মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গানগুলোর ক্যাসেট আর লং প্লে ডিস্ক। বাসায় এল পি রেকর্ডারে আমরা শুনতাম আপেল মাহমুদের, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’। সমর দাশের সুরে নয়ীম গহরের লেখা— ‘নোঙ্গর তোলো তোলো’ বাজত কোরাসে। তখনই নিজের কানে প্রথম শুনলাম বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা, তার ভাষায় ‘…অন বিহাফ অব আওয়ার গ্রেট ন্যাশনাল লিডার, দ্য সুপ্রিম কমান্ডার অফ বাংলাদেশ, শেখ মুজিবুর রহমান’। ভাষণ শেষে তিনি বললেন, ‘জয় বাংলা’।
ছোটবেলায় গানের কথাগুলোও কী সুন্দর মনে থাকতো। অবশ্য একটামাত্র চ্যানেলে সারাদিন বাজতো সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া ‘এরশাদের লেখা’ গান, ‘নতুন বাংলাদেশ গড়বো মোরা, নতুন করে আজ শপথ নিলাম। ভোলার কথাও না।’
টিভিতে দেখতাম নতুন কুঁড়ির ফালানীর অভিনয় দেখে এরশাদ ফেলত চোখের জল। ফেলানীদের ‘পথকলি’ নাম দিয়ে তিনি ‘গান লেখেছিলেন’— ‘… জীবন যাদের কাটে অভিশাপে, নাম দিয়েছি পথকলি’।
দৈনিক বাংলায় মনে হয় নিয়মিত ছাপা হতো তার কবিতা। আমার বাবা পত্রিকা অফিস কাজ করতেন। একদিন দেখলাম অফিস থেকে একটা উপহার নিয়ে এলো। এরশাদ বিশিষ্ট সাংবাদিকদের উপহার পাঠিয়েছেন ‘তার লেখা’ কবিতার বই। নাম—‘কনক প্রদীপ জ্বালো’।
মোহাম্মদ রফিক নামে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের এক শিক্ষক সেই সময় লেখেছিলেন, ‘সব শালা কবি হবে, পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে উড়বেই, দাঁতাল শুয়োর এসে রাজাসনে বসবেই’। কবিতাটা নিষিদ্ধ হয়েছিল। পটুয়া কামরুল হাসানও সেই সময়েই এঁকেছিলেন তার বিখ্যাত স্কেচ, ‘দেশ আজ বিশেষ বেহায়ার খপ্পরে’।
এরশাদ তার দীর্ঘজীবনে প্রায় সব সময়ই এতো ‘হ্যাপেনিং’ ছিলেন যে উনি যে নেই, মনেই থাকে না। উনার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে মনে পড়ে গেল ছোট ছোট কত কথা। এরশাদের হাত ধরে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়া অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র থেকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। জানি না এর জন্য পরকালে তার জন্য কী উপহার বরাদ্দ হয়েছে। কামনা করি ‘এরশাদের গানের’ মতো বাংলাদেশ এগিয়ে যাক’—
মাটি আর মানুষের সমন্বয় সাধনে
সুখ সমৃদ্ধি আসবে জীবনে
এগিয়ে চলবো সমুখের পানে,
স্রষ্টার কাছে এই শক্তি নিলাম।
লেখক: গ্রামীণফোন কর্মকর্তা
সারাবাংলা/আইই