মানুষ ফিরুক মানুষের জগতে
২৩ জুলাই ২০২১ ২৩:৩৭
সম্প্রতি যৌন নির্যাতনের শিকার এক নারী গণমাধ্যমে বলেন, ‘এতকাল জেনে আসছি পুরুষের নানা পরিচয়- বাবা, ভাই, চাচা, মামা, বন্ধু, প্রেমিক বা স্বামী। কিন্তু সেই পুরুষই হয়ে উঠছে ধর্ষক, যা খুনের চাইতেও নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্য অপরাধ। কাউকে খুন করা মানে মানুষটি আর থাকল না কিন্তু যাকে ধর্ষণ করা হয় সে শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও ধর্ষণের অপূরণীয় ক্ষতি সারাজীবন বয়ে বেড়ায়।’ ধর্ষণের শিকার ওই নারী দুঃখ, অপমান, লজ্জা ও মনোকষ্ট থেকে রক্ষা পেতে মাটিকে বারবার মিনতি করছেন দু’ভাগ হয়ে তাকে ফিরিয়ে নিতে। এই অসহায়ত্ববোধ মনে করিয়ে দেয় রামায়ণের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘ধরণী, দ্বিধা হও, আমি তন্মধ্যে প্রবেশ করি!’
রাবণের কাছ থেকে প্রিয়তমা পত্নীকে উদ্ধার করে আনার পর সীতার সাথে সুখের সংসার করে রাম। কিন্তু সেই সুখ স্থায়ী হলো না। কেননা, অযোধ্যায় সীতাকে নিয়ে নানান কুৎসা রটতে শুরু করে। ক্ষিপ্ত প্রজার দাবি, যেহেতু সীতা রাবনের হাতে বন্দী ছিল দীর্ঘদিন তাই সীতাকে তার সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হবে। রামও এখানে সীতাকে কোনো সহায়তা না করে প্রায় বিনা বাক্যে প্রজাদের দাবিই বরং মেনে নিলেন। তাতে অপমানে, লজ্জায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় সীতা মাটিকে বলেন তাকে ফিরিয়ে নিতে। পৃথিবী দু’ভাগ হয়ে সীতাকে ফিরিয়ে নিল।
মাসল, ম্যান, মানি- এই তিন ম’য়ের চাপে ক্ষত-বিক্ষত নারী। অথচ তা হওয়ার কথা ছিল না। একটি সুন্দর জীবনযাপনে এক ‘ম’ এর অভাব হলেই জীবনের স্বাভাবিক সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু আজ আমাদের নারীরা এই তিন ‘ম’ এর পৈশাচিকতাতে পিষ্ট। নারী মানে সদ্য জন্ম নেওয়া পুংলিঙ্গের বিপরীতে স্ত্রী লিঙ্গের অধিকারী মানবশিশু থেকে সাত সন্তানের জননী, কেউ বাদ পড়ছে না অনিয়ন্ত্রিত যৌন নির্যাতনের।
এটি বিহেভিয়ারিয়াল ডিজিজ বা আচরনজনিত রোগ। আদর্শবিচ্যুতি। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, নৈতিক অবক্ষয়ই সামাজিক ব্যাধি। প্রমথ চৌধুরীও বই পড়া প্রবন্ধে বলেছেন- ‘ব্যাধিই সংক্রমণ, স্বাস্থ্য নয়।’ তা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে মোক্ষম প্রতিবিধান হতে পারে যৌন শিক্ষায় নৈতিকতা বিষয়ক শিক্ষা- শিশুকে গুড টাচ এবং ব্যাড টাচ শেখানো। সে সঙ্গে সন্তানকে পঙ্কিলতা থেকে সুরক্ষিত রাখতে যে লেসনও অত্যাবশ্যকীয়, তা হলো- হেলথ্ এডুকেশন এবং সেক্স এডুকেশন।
এ ব্যাপারে যৌন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যৌন ধারণার অভাবে অনেক শিশু ও কিশোর-কিশোরীরাই জানে না সে পারিবারিক যৌন সহিংসতার শিকার। তাছাড়া মা-বাবার যৌন অসাবধানতাও সন্তানদের দিগভ্রান্ত করছে। এক্ষেত্রে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদের বক্তব্যও প্রণিধানযোগ্য। তার মতে, ‘অপরাধীরা তাদের ধর্মীয়, নৈতিক, পারিবারিক ও জীবনঘনিষ্ঠ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব রয়েছে।’
প্রতিমন্ত্রী জুনাইদের বক্তব্যটি হতে পারে ‘ফাইনাল টাচ’। কোনো সমাজে যৌন ও নারী সহিংসতার উপস্থিতি নিঃসন্দেহে সেই সমাজের মানব উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত শুধু নয়, অন্যান্য আর্থ-সামাজিক সমস্যার চেয়েও অধিক গুরুতর সমস্যা। সেজন্যই মূল্যবোধ পরিপন্থী কোনো কার্যক্রম সমাজে গৃহীত হয় না। যে কারণে মানবজাতি মহাবিপর্যয়ে শ্রেষ্ঠত্বের অন্বেষণ করে।
যৌন নিপীড়নরোধে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই শ্রেয়। যৌনতা থাকবে কিন্তু হিংস্রতা ও অবাধ নয়। যৌন সহিংসতা বর্বরতার কুৎসিত রূপ। নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও সংবেদনশীলতার সংকীর্ণতা যৌনতায় হিংস্ররূপ পেয়েছে। নৈতিকতা যৌনতার রক্ষাকবচ।
ধর্ষনের এমনই একটা বিকৃত যৌনক্ষুধা ও নৈতিক বিপর্যয় যে- আদর্শ পরিবার, কল্যাণরাষ্ট্র, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রীতিমূলক সমাজব্যবস্থা, মন্দের ওপর কল্যাণ ও দুষ্টের ওপর শিষ্টের বিজয়চিহ্ন নিশ্চিত করতে জীবনাচরণে নৈতিক চরিত্রে বিকাশ সাধনে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ছাড়া শুধু আইন আর শাসন দিয়ে সম্পূর্ণ শুধরানো সম্ভব নয়। মানবজাতির গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান তিনটি- রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার। এর মধ্যে রাষ্ট্র এগিয়ে এসে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হলেও সংকটের স্থায়ী সমাধানে সমভাবে এগিয়ে আসতে হবে সমাজ ও পরিবারকেও। মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকা সত্ত্বেও দেশে যৌন ও নারী সহিংসতা থামছে না। প্রত্যেকটা পেশায় এখন নৈতিকতা-মূল্যবোধের ধ্বস নেমেছে। মনুষ্য মনন থেকে বিবেক যেন উধাও!
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, জন্মের সময় বহু কোষবিশিষ্ট মাংসপিন্ডে মস্তিষ্কে পরিচালিত অনেকটা বংশগত গুণাগুণ নিয়ে পৃথিবীতে আসে শিশু। পরবর্তীতে পরিবেশের প্রভাবে প্রভান্বিত হয়ে ভবিষ্যতের কর্মসূচি নির্বাচিত করে। চেতন, অবচেতন ও অচেতন মনে পরিবেশের স্থায়ী প্রভাব তার জীবনে রয়ে যায়। এ মূল পরিবেশকে কেন্দ্র করে পারিপার্শ্বিকতার পটভূতিতে যে শিশু তাল সামলাতে পারে না, সেই শিশু কালক্রমে পঙ্কিলতায় পা বাড়ায়। অপরাধে ঝুঁকে।
যে কোনো সমস্যার সমাধানে কেবল বিচার নয়, কঠিন সাজা দেয়াও নয়; সমস্যাটি যাতে সমাজে উৎপত্তি না হয় তার পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা অগ্রগণ্য। চিরস্থায়ী এই সামাজিক সংগঠন থেকেই মানবজাতির বিকাশ হয়েছে। শিশুকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রাথমিক কেন্দ্রবিন্দু হল সুগঠিত পরিবার, যা সমাজ জীবনের ভিত্তিস্বরূপ। পারিবারিক পরিবেশে শিশুরা মৌলিক শিক্ষা লাভ করে। যৌনতা অতি স্পর্শকাতর বিষয়। ধর্মীয় মূল্যবোধ, শিষ্টাচার ও শালীনতাসহ নারীর মর্যাদা- অধিকার চিত্ত জাগরূকের মোক্ষম ক্ষেত্র কিন্তু পরিবারই।
সর্বোপরি মানুষ প্রকৃতিগতভাবে ষড়রিপুর দ্বারা আক্রান্ত। অর্থাৎ মানবচরিত্রের প্রবৃত্তি ছয়টি– কাম বা যৌনক্ষুধা, রাগ, লোভ, মোহ, মদ বা দম্ভ ও মাৎসর্য বা পরশ্রীকাতরতা। এ প্রবৃত্তিগুলো মানবের জ্ঞান ও বিবেককে বাধাগ্রস্ত করে বলে তা রিপু তথা শত্রু নামে পরিচিত। অন্যদিকে মানবদেহে ১৪টি ইন্দ্রিয় রয়েছে- চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, ত্বক বা দেহকোষ, বাক বা কথা, হাত, পা, পায়ু বা মলদ্বার, উপস্থ বা জননেন্দ্রিয় মন, বুদ্ধি বা জ্ঞান, অহংকার, আত্মা বা চিত্ত। দেহের এই ১৪টি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও প্রাণশক্তি, যা দিয়ে বাহ্য বা বাইরের বিষয়ের জ্ঞান অনুভূতি উপলব্ধি হয়।
রিপুদমনই আত্মসংযম। এই প্রবৃত্তি ও ইন্দ্রিয়ের সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষকে সভ্য ও উন্নতর জীবন দেয়। প্রকৃত শিক্ষা পশুকে মানুষ হিসেবে দাঁড় করায়। অন্যদিকে এসব প্রবৃত্তি ও ইন্দ্রিয় প্রভাবান্বিতের অপার দৈবযোগে মনুষ্যত্ববোধ লোপ পায়। দিকভ্রান্তিতে যৌনতার যথেচ্ছাচার ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষকে পশুরও অধম করে দেয়। নিমজ্জিত করে অধঃপতনের অতল তলে।
মানুষও কিন্তু প্রাণি। তবে মানবীয় গুণাবলি বিদ্যমান থাকায় মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। জন্তু ও মানুষের মধ্যে স্বভাব ও প্রকৃতিগত পার্থক্য বিদ্যমান। জন্তুর সব স্বভাব বিরাজমান মানুষের মধ্যেও। যেমন- হিংসা, বিদ্বেষ, পাশবিকতা, হিংস্রতা, লোলুপতা ইত্যাদি। তবে প্রীতি, মমত্ব, সুস্বভাব, সচ্চরিত্র, বিবেক, মনুষ্যত্ব, মূল্যবোধ- এসব গুণাবলির জন্য মানুষ জন্তু থেকে আলাদা। মানুষের মধ্যে সমাজ চেতনার যে উত্তরণ, জন্তুর মধ্যে তা নেই। সেই স্বভাব গড়ে ওঠে বংশগত, পরিবেশগত ও শিক্ষার ওপর। তবে মনোজগতের অধিবাস বন্যের মধ্যে হলে ব্যক্তি কেবল নয়, মানবসমাজও পায় বুনো রূপ।
ইসলামসহ বেশ কিছু ধর্ম অনুযায়ী প্রত্যেক প্রথম মানুষ আদম (আ.) । নারী-পুরুষ সমাজদেহের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ইসলামমতে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা নারী-পুরুষকে একে অপরের পরিপূরক ও মুখাপেক্ষী বানিয়েছেন। এই মুখাপেক্ষীতা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও যৌনতা- সব দিক দিয়েই। তারা একে অপরের প্রতি সদাচার করতে বাধ্য। সামাজিক অগ্রগতির প্রেক্ষাপটে সামাজিক, পারিবারি ও অর্থনৈতিকসহ নানা ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা প্রধান হয়ে উঠেছে। কিন্তু সমাজের পুরুষরা অনেকেই সেটি মেনে নিতে পারছে না। তাই সামাজিক জীবনের সুষ্ঠু-সুস্থতা ও উন্নতি একান্তভাবে নির্ভর করে নারী সম্পর্কে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। এ উন্নত দৃষ্টিভঙ্গি গড়তে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও রাখতে পারে বলিষ্ঠ ভূমিকা।
মানুষের পরিচয় জানার পর এবং নারী ও পুরুষ সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধির পর সামষ্টিক জীবনের দাবি হল, একে অপরের সাথে সমান তালে চলবে। সামাজিক জীবনের উন্নতি ও অগ্রগতি একান্তভাবে নির্ভর করে নারী-পুরুষের সুষ্ঠু সম্পর্কের ওপর। উভয়েই সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতির নির্মাতা। নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে সংসার গঠনে, সুস্থ জাতি ও সুষ্ঠু সমাজ বিনির্মাণে।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে না আনলেই নয়। প্রযুক্তির যুগে গেইম, কার্টুন, ইউটিউব ইত্যাদির অজুহাতে মোবাইলশ নানা বৈদ্যুতি যন্ত্রপাতি এখন বাচ্চাদের হাতে জায়গা করে নিয়েছে। তাই না চাইতেও অভিভাবকরা ছোটদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন করোনায় অনলাইন ক্লাস যুক্ত হওয়াতে। ইন্টারনেট জগতটা ওয়েব ভিজিটর বাড়াতে চারিদিকে পাল্লা দিয়ে নোংরামিতে পর্ণোসাইটও বেড়ে চলায় এদিক-সেদিক ক্লিক করতেই অজান্তে নানান অ্যাডাল্ট সাইট ওপেন হয়ে যাচ্ছে, যা খুবই বিব্রতকর ও ভয়ঙ্কর এবং বাচ্চাদের মানসিক ও মূল্যবোধ বিকাশের জন্য বিরাট বাধা। নতুন ও আগামী প্রজন্ম সুস্থ মস্তিষ্কে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে শিশুকে ‘গুড টাচ ও ব্যাড টাচ’ শেখানোর পাশাপাশি সন্তানকে ‘হেলথ্ এডুকেশন ও সেক্স এডুকেশন এবং বড়দের ক্ষেত্রে আত্মশুদ্ধিও হতে পারে ভেরি মাচ। সেই সঙ্গে সব অভিভাবককে ডিভাইসে অ্যাডাল্ট কনটেন্ট বন্ধ করার পদ্ধতিও জানতে হবে। ইউটিউবসহ মূল হ্যান্ডসেটেই প্যারেন্টাল কন্ট্রোল করা যায়।
এই দুর্দিনে মানুষের ভরসা তো নিজের আত্মোপলব্ধি। তার আত্মবিশ্লেষণ। সেই আত্মজিজ্ঞাসার চিরায়ত কথক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাণীতে আহ্বান তাই- ‘মানুষ ফিরুক মানুষের জগতে…’।
সারাবাংলা/এসবিডিই/আরএফ