ঠাকুরগাঁও রোড থেকে বালিয়াডাঙ্গি যাওয়ার পথটা বেশ প্রশস্ত খোলামেলা। রাস্তার দু’ধারে বিস্তীর্ণ ফসলি জমি। যতদূর চোখ যায় জমিতে কাটা ধানগাছের অর্ধাংশ আকাশমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শেষ বিকেলের গোধূলির রং গায়ে জড়িয়ে এটি এমন উজ্জ্বল রং ধারণ করেছে যে পাকা সোনার রংও অতটা ঝলমলে হয়ে অক্ষীর সামনে ধরা দেয় না। ধান কাটা হয়ে গেছে, তবে এখনো পাকা ধানের ঘ্রান নাকে ভেসে আসে। সেইসঙ্গে চলার পথে বাতাসের তীব্র গতি শরীরকে পবিত্র করে দেয়। এমনই মনোমুগ্ধকর পথের খানিকটা যেতেই একটা ব্রিজ। ব্রিজটি অতিক্রম করার সময় একটা ত্রিভুজাকৃতির সাইনবোর্ড, লেখা ‘ভক্তি নদী’। তার মানে এই ব্রিজের নিচ দিয়েই প্রবাহিত ভক্তি নদী।
সেই ব্র্রিজ লাগোয়া একটি বাজার যার নাম ভেলাজান বাজার। তবে আমার চোখ স্থির হয়ে আছে সেই সাইনবোর্ডটাতেই। সেটি দেখার পর থেকেই মনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে শুরু করলো। এই যেমন নদীটির উৎপত্তি, জীবন, কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে ইত্যাদি। এই নদীর বুকেই ধানের জমি, যা দেখে মনে হয় দু’একদিন আগেই কাটা হয়েছে পাকা ধান। একফোঁটা জল নেই নদীতে। এর অস্তিত্ব নিয়ে ভাবতে ভাবতে চোখের ভিতর ততক্ষণে জোয়ার শুরু হয়ে গিয়েছে। ভাবতে ভাবতেও মানুষ অনেক সময় ক্লান্ত হয়ে যায়।
তথ্যমতে, ভক্তি নদী মূলত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ঠাকুরগাঁও জেলার সদর ও পীরগঞ্জ উপজেলার একটি নদী। সর্পিলাকার এই নদীটি মূলত কুলিক নদীর উপনদী যা কুলিক নদীর বাম তীরে এসে মিলিত হয়েছে। নদীটির দৈর্ঘ্য ২৫-২৬ কিলোমিটার।
এই নদীর উৎপত্তি ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রুহিয়া ও চিলারং ইউনিয়নের বিভিন্ন নিম্নভূমি থেকে। তিনটি প্রবাহ থেকে চিলারং গ্রামের দক্ষিনে একটি প্রবাহে এসে মিশে গেছে। নদীটি ভেলাজান, শিহিপুর, দেহন, মাহাপুর পেরিয়ে শালিখসা গ্রামে নেহারা নদীতে এসে মিলিত হয়েছে। প্রবাহ পথে রুহিয়া, আখানগর, চিলারং এবং রায়পুর ইউনিয়নও অতিক্রম করেছে। নদীর একেবারে তীরে ভেলাজান বাজার, আখানগর রেল স্টেশন, দেহন উচ্চ বিদ্যালয় অবস্থিত।
বর্তমানে শুকনো মৌসুমে এতে একেবারেই পানির প্রবাহ থাকে না। তখন সেখানে দিব্যি চলে চাষাবাদ। নদীটির স্বাভাবিক প্রবাহ এখন নেই বললেই চলে! যেটুকু আছে তা বর্ষাকালে চোখে ধরা দেয়। বলা যায় নদীটির অস্তিত্ব দিন দিন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আর কমে যাচ্ছে এর স্বাভাবিক প্রবাহ।
শহরে এবং গ্রামের ভিতর এইরকম অনেক ছোট ছোট নদী আছে যেগুলো জলশূন্য আর মৃতপ্রায়। শহরের ভিতরের নদীগুলো ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে প্রভাবশালীদের কবলে শহরে কিংবা গ্রামে এই ছোট নদীগুলোর অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার পথে।
মানুষ তো নদী তৈরি করে নি, তাহলে মানুষ কেন নদীগুলোকে নষ্ট করছে! আজ পর্যন্ত কোন মানুষকে দেখিনি একটা নদী বানাইছে! বরং নদীগুলোকে এমন বাজেভাবে ব্যবহার করেছে যে এখন এগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আবর্জনার স্তুপ এবনং মানুষের নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহারে নদীগুলোর ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা এখন মরতে বসেছে গ্রামের এই নদীগুলো।
বর্ষাকালে ভরা জল থাকা মানেই নদীর প্রবাহ স্বাভাবিক আছে এমনটি নয়। শুকনো মৌসুমে নদীতে পানি থাকাটাও জরুরি। এছাড়াও এইসব অঞ্চলে শুকনো মৌসুমে প্রচুর রবিশস্যের চাষ হয়। ফলে শুকনো মৌসুমে এই নদীগুলোর বেঁচে থাকা বা স্বাভাবিক প্রবাহ থাকাটা আবশ্যক আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই।
এই নদীটি এখন মৃতপ্রায়। গ্রামের ভিতরে এইসব নদীগুলো ফসল উৎপাদনের প্রাণ। নদীগুলোকে বাঁচানোর জন্য শুধুমাত্র সরকারি উদ্যোগ নয় স্থানীয় প্রসাশন এবং সরকারের যথেষ্ট উদ্যোগ দরকার । শুধু ভক্তি নদী নয় গ্রামের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত অনেক ছোট ছোট নদী মৃতপ্রায়, বেঁচে আছে শুধু সাইনর্বোডে।