শিক্ষা ব্যবস্থায় করোনার ধাক্কা ও আমাদের করণীয়
৩ আগস্ট ২০২১ ২১:২৮
এখন করোনাভাইরাস আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই ভাইরাসকে সঙ্গি করেই আমাদের জীবন-যাপন করতে হচ্ছে এবং হবে। কিন্তু আমাদের জীবন-যাপনের সবচেয়ে বড় অংশটাই এখন স্তব্ধ, জর্জরিত। আপনি নিশ্চই বুঝতে পারছেন আমি কোন বিষয় নিয়ে লিখছি। হ্যাঁ, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বলছি। করোনার ভয়াল থাবায় বলতে গেলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটা আজ লণ্ডভণ্ড। প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থী এবং ৫০ লাখ শিক্ষক আজ ঘরবন্দি হয়ে বিপাকে পড়েছেন। বেসরকারি শিক্ষকদের জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার। হয়তো আমরা সেভাবে খোঁজ রাখি না তাদের। আমরা আসলে কোন বিষয়টার প্রতি নজর দেব? শিক্ষকদের তো সসমস্য আছেই। কিন্তু শিক্ষার্থীদের বিষয়? এদের ভবিষ্যৎ? এটাতো আরও বড় ধাক্কা।
দেশের ইতিহাসে প্রথমবার এই করোনা পরিস্থিতির জন্য পরীক্ষা ছাড়াই অটোপাস দেওয়া হয়েছে এইচএসসির শিক্ষার্থীদের। শুধু কি তাই? এসব শিক্ষার্থীদের এতদিনে অনার্স প্রথম বর্ষে থাকার কথা। অথচ তাদের এখন ভর্তি পরীক্ষাই হয়নি। গত ২৮ জুলাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স প্রথম বর্ষের ভর্তির আবেদন শুরু হয়েছে। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এছাড়াও গত বছর এসএসসি পাস করা শিক্ষার্থীরা একদিনও ক্লাসে বসতে পারেনি। এটি একদিকে যেমন আমাদের শিক্ষা খাতের উপর প্রভাব পড়ছে, অন্যদিকে আমাদের দেশের উপরেও এর প্রভাব পড়ছে। কারণ একটি দেশ তখনই এগিয়ে যায় যখন সেদেশের শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে শিক্ষা পায়। আজ আমাদের দেশের শিক্ষার বেহাল দশা দেখে ভয় হয় আমার। এই প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা কতদিনে তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারবে সে প্রশ্নও থেকে যায়।
আমরা হয়তো এখনও বুঝতে পারছি না করোনাভাইরাস শিক্ষায় কত বড় আঘাত করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার আশংকা রয়েছে মারাত্বকভাবে। এছাড়াও এই করোনায় বেড়েছে বাল্যবিয়ে। যা অস্বীকার করার কোনো পথ নেই। শিক্ষার্থীরা ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে থাকতে নানা মানসিক সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এসব নিয়ে অভিভাবক মহলও বেশ চিন্তিত।
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে সব স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। একজন শিক্ষার্থীর জীবন থেকে প্রায় দেড় বছরের শিক্ষা জীবন কেড়ে নেওয়া কতটা কষ্টের এবং ক্ষতির সেটা এখনও সেভাবে আমাদের উপলব্ধি হয়নি। আপনি হয়তো বলতে পারেন অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার বিষয়। সরকার সংসদ টিলিভিশনে, বেতারে এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইনে ক্লাস করিয়েছে। কিন্তু আদৌ কি এটা ক্ষতির ধাক্কা সামলাতে পেরেছে! সব শিক্ষার্থী অনলাইনে ক্লাসের সুবিধা পেয়েছে এটাও বলা যাবে না। কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার জরিপেও এই বিষয়টি স্পষ্ট ভাবে উঠে এসেছে। তাদের জরিপে বলা হয়েছে মাত্র ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন বা বেতার, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে পাঠদানের আওতায় এসেছে।
যদিও দৈনিক সমকালে গত ২৩ মে একটি রিপোর্টে লেখা হয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থী আর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী টিলিভিশনের পাঠদানের আওতায় এসেছে। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার এবং ব্র্যাক ইনষ্টিটিউট অব গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে প্রাথমিকের ১৯ শতাংশ ও মাধ্যমিকের ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী করোনার এই সময়ে নিয়মিত পড়াশোনার একদম বাইরে রয়েছে। এ গবেষণায় এমন প্রেক্ষাপটে মা-বাবাদেও চিন্তাভাবনার চারটি মৌলিক দিক উঠে এসেছে। এগুলো হলো- শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমে যাওয়া, স্কুল-কলেজ খোলার সময় নিয়ে চিন্তা এবং পড়াশোনার পাশাপাশি কর্মসংস্থানজনিত উদ্বেগ।
যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে, তাদের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। একদিকে পরিবারের হাল ধরার চাপ, অন্যদিকে গ্রজুয়েশন কমপ্লিট করার চাপ। কিন্তু এর কোনোটাই সে পারছে না। সবচাইতে বড় কষ্টের বিষয় হচ্ছে বয়স কিন্তু থেমে থাকছে না। এইযে বয়স বৃদ্ধি হচ্ছে, অন্যদিকে সেশনজট, করোনা এসবের বেড়াজালে আটকে কত তরুণের শিক্ষাজীবন এবং কর্মজীবন দুটোই শেষ হয়ে যাচ্ছে সেটা হয়তো আমাদের জানা নেই। কত স্বপ্ন মাটির নিচে রোজ চাপা পড়ে যাচ্ছে সে খবরও হয়তো আমরা জানি না। এভাবে চলতে থাকলে এর মাত্রা আরও বাড়তে থাকবে। এজন্য সরকারের নিকট একটা চাওয়া থাকবে, চাকরির পরীক্ষার আবেদনের বয়স বাড়ানোর জন্য। নয়তো একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মজীবনে যাওয়ার আগেই বয়সের বেড়াজালে আটকে যাবে।
পরিশেষে বলতে চাই, করোনার এই ভয়াল থাবার উপর আমাদের কারো হাত নেই। তবে এরজন্য শিক্ষাখাতের এমন অবস্থা মেনে নেওয়া যায় না। শিক্ষাজীবনে সকল শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনতে অতিশিগগরই করোনার ভ্যাকসিন সকল শিক্ষর্থীদের উপর প্রয়োগ করতে হবে। সেইসাথে শিক্ষার্থীদের এই দেড়-দুই বছরের ক্ষতিটা কীভাবে পুষিয়ে দেওয়া যায় সেটার বিকল্প চিন্তা শিক্ষামন্ত্রণালয়কে করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি আমাদের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী যথেষ্ট শিক্ষাবন্ধব এবং সচেতন মানুষ। তিনি শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সাথে সাথে স্বাস্থ্যের বিষয়টাও গুরুত্ব সহকারে দেখেন। তাই মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর নিকট আবেদন আমাদের হারিয়ে যাওয়া বছরগুলো যেন বিকল্প কোনোভাবে পুষিয়ে দেওয়া যায় সে বিষয়টা ভেবে দেখবেন। সেই সাথে এসব শিক্ষর্থীদের কর্মসংস্থানের বিষয়টাও মাথায় রাখতে হবে সরকারের। তবেই আমাদের শিক্ষাখাত এবং শিক্ষার্থী দু-ই বাঁচবে।
লেখক- শিক্ষার্থী, বিবিএ-অনার্স, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ওমরগণি এমইএস কলেজ, চট্টগ্রাম
সারাবাংলা/এসবিডিই/আরএফ